আমেরিকায় দীর্ঘদিন থাকার কারণে এ দেশের অনেক সংবাদ কাছ থেকে দেখা হয়ে গেছে। আমি সাংবাদিক নই। একজন দর্শকের দৃষ্টিকোণ থেকে নিজের ভাষায় আমেরিকার কিছু মজার বা বিস্ময়ের সংবাদ তুলে ধরছি। প্রথম এবং শেষ সংবাদে বাংলাদেশের যোগ আছে। সংবাদগুলো সময়ক্রম হিসেবে সাজানো হয়নি।
কিছু এলেবেলে সংবাদ
১. টেক্সাস তরুণীর বাংলাদেশে হাজতবাস
১৯৯৬ সাল। সবেমাত্র এ দেশে এসেছি। টেক্সাসে নিবাস। টেলিভিশনে দেখাচ্ছে টেক্সাসের এক মেয়ে, লিয়া ম্যাককর্ডকে ‘ব্যাংলাডেশ’ নামের এক দেশে আটক করেছে। তিনি নাকি মাদক চোরাকারবারি। দেশের পেপার তখন অনলাইনে পড়া যেত না। আসলে অনলাইন তখন হয়নি। গুগল সৃষ্টি হয়নি, ফেসবুক সৃষ্টি হয়নি। এখানে টিভিতে দেখাচ্ছে যেন অদ্ভুত এবং অশ্রুত একটা দেশে গিয়ে তাদের সাদাসিধা সাদা মেয়েটি বিপাকে পড়ে গেছে। লোকমুখে শুনলাম কবি ত্রিদিব দস্তিদার নাকি তাঁকে বিয়ে করার ইচ্ছা পোষণ করেছেন। সেটা অবশ্য এ দেশের খবরে আসেনি।
দেখলাম কংগ্রেসম্যান বিল রিচার্ডসন গেলেন ‘ব্যাংলাডেশ’ থেকে মেয়েটিকে উদ্ধার করতে। তদানীন্তন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করলেন। সেই টেক্সান মেয়েটিকে শেষে ক্ষমা করে দেওয়া হলো। প্রাণ নিয়ে ঘরের মেয়ে ঘরে, অর্থাৎ টেক্সাসে ফিরে এলেন। স্থানীয় চ্যানেলে ঘটা করে এই সব দেখাচ্ছিল।
আর আমি ভাবছিলাম, এটা তো অখ্যাত কোনো দেশ নয়? এটা তো বাংলাদেশ!
২. জ্যানেট জ্যাকসনের ওয়ার্ডরোব গন্ডগোল
২০০৪ সালে ফুটবলের সুপার বলের হাফ টাইমের অনুষ্ঠানে এলেন জাস্টিন টিম্বারলেক ও জ্যানেট জ্যাকসন। দুজন নেচে নেচে গান করছেন। নাচের একটি মুদ্রায় জাস্টিন টিম্বারলেক জ্যানেট জ্যাকসনের বুকের কাছে হাত নিয়ে যেতেই তাঁর বিশেষ ধরনের কাপড় খুলে গিয়ে স্তন উন্মুক্ত হয়ে যায়। সেই দৃশ্যটি আধা সেকেন্ডের মধ্যেই ঢেকে দেওয়া হয়। এর তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। শালীনতা নিয়ে টিভিতে উত্তপ্ত কথাবার্তা শুরু হয়। সিবিএস চ্যানেলে খেলাটি দেখানো হচ্ছিল। এফসিসি সিবিএসকে ৫ লাখ ডলার জরিমানা করে।
জ্যানেট জ্যাকসন বললেন, ‘ওয়ার্ডরোব ম্যালফাংশান’ বা ওয়ার্ডরোবের গন্ডগোল। কিন্তু কারও বুঝতে বাকি নেই যে জ্যানেট প্রচার পাওয়ার জন্য এ কাজটি করেছেন।
সে সময় অসংখ্য মানুষ তাঁর নাম সার্চ করে আবার ওই দৃশ্য দেখার চেষ্টা করছিল। এর ফলে জ্যানেট জ্যাকসন ২০০৪ ও ২০০৫–এ সবচেয়ে বেশি সার্চ পায়। একই কারণে তাঁর নাম গিনেস বুকেও ওঠে।
৩. ফ্লোরিডার ভুয়া পাগল বিজ্ঞানী
২০০৯ সালে কলোরাডোর ফোর্ট কলিন্সে রিচার্ড হিন ও স্ত্রী মায়ুমি হিনের বাসা থেকে একটি অতিকায় হিলিয়াম গ্যাস বেলুন উড়ে গেল। এরপর তাঁরা পুলিশ ও গণমাধ্যমে জানালেন যে, তাঁদের ছয় বছর বয়সী ছেলে ফ্যালকন ওই বেলুনে আটকা পড়েছে। সঙ্গে সঙ্গে হেলিকপ্টার বেলুনের পেছনে ছোটা শুরু করল। পুলিশও গাড়ি নিয়ে নিচ দিয়ে অনুসরণ করতে লাগল। মিডিয়ায় ব্যাপারটা চাউর হয়ে গেল। একটা ভিডিওতে দেখা গেল, বেলুনের বাঁধন ছেঁড়ার আগে রিচার্ড ছেলেকে ধমক দিয়ে বেলুন থেকে নামতে বলছেন। এরপর বেলুনটি উড়ে যায়।
ঘণ্টা দেড়েক পরে বেলুন মাটিতে নেমে এল। কিন্তু ফ্যালকন সেখানে নেই। পথে কোথাও পড়ে গেছে কি না, এ নিয়ে বিস্তর খোঁজাখুঁজি। এর মধ্যে সেই দম্পতি ঘোষণা দিলেন, ফ্যালকনকে পাওয়া গেছে। সে ভয়ে চিলেকোঠায় লুকিয়ে ছিল। এ ব্যাপারে কথা বলতে ওই দম্পতিকে টিভি চ্যানেলে আনা হলো। ল্যারি কিং সাক্ষাৎকার নিলেন। সাংবাদিকের কথার প্যাঁচে ফ্যালকন স্বীকার করে যে তাকে তার বাবা লুকিয়ে থাকতে বলেছিলেন। পুলিশ খাপ্পা হয়ে জেরা করলে আসল কথা বের হয়ে আসে। তাঁরা সস্তা খ্যাতির জন্য এ কাজ করেছেন। ফ্যালকন ওই বেলুনে ওঠেনি। ওই চ্যানেল রিচার্ড হিনকে মানুষের সামনে পাগল বৈজ্ঞানিক হিসেবে উপস্থাপন করত। যে বেলুন দিয়ে ভিনগ্রহের ইউএফও খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে। এবার তাঁদের সব জারিজুরি ফাঁস হয়ে গেল। এ কারণে তাঁদের ৯০ দিনের জেল হয়ে গেল।
কিছু দুর্ঘটনা ও দুঃসংবাদ
৪. মিনিয়াপোলিস ব্রিজ ধস
২০০৭ সাল। কাজ থেকে ফিরছে মানুষ। মিনিয়াপোলিস ব্রিজের ওপর অনেক গাড়ি। হঠাৎ ব্রিজটি মাঝ বরাবর ধসে পড়ল। সব গাড়ি নদীতে পড়ে গেল। তীব্র বেগে গাড়ি আছড়ে পড়ল মিসিসিপি নদীতে। সেই দুর্ঘটনায় ১৩ জন মানুষ নিহত, ১৪৫ জন আহত হন। তবে পানিতে গাড়ি নিয়ে পড়েও অনেকেই বেঁচে গেছেন।
৫. ৪০ বছর পর পানির নিচ থেকে গাড়ি উদ্ধার
১৯৭০ সালের নভেম্বর মাস। ওকলাহোমার ছোট্ট শহর স্যায়ার। তিন হাজার মানুষের বাস। দুই বন্ধুকে নিয়ে জিমি এলেন উইলিয়াম নতুন কেনা গাড়িতে করে বেরিয়ে গেলেন। যাবেন পাশের শহরে, সেখানে কলেজ ফুটবল খেলা হচ্ছে তাই দেখবে। কিন্তু তাঁরা কেউই আর ফিরে এলেন না। অনেক খোঁজা হলো, পুলিশ তদন্ত, মিসিং পারসনের ছবি টাঙিয়ে দেওয়া। এভাবে ৪০ বছর পেরিয়ে গেছে। যাঁরা তাঁদের খোঁজ করেছিলেন তাঁদের অনেকেই আর বেঁচে নেই।
২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাস। স্যায়ার শহর থেকে ২০ মাইল দূরের ফস লেকে কিছু গবেষক শব্দ যন্ত্র (সোনার) দিয়ে পানি গবেষণা করছিলেন। তাঁরা দেখলেন, স্পিডবোট বেঁধে রাখার পাটাতন থেকে ৩০ হাত দূরে পানির নিচে অনেক পুরোনো একটি গাড়ি ডুবে আছে। পানি তত গভীর নয়, ২০ ফুট মাত্র। হইচই পড়ে গেল। গাড়ি তোলা হলো। ভেতরে তিনটি কঙ্কাল। ডিএনএ টেস্টে জানা গেল তাঁরা হারিয়ে যাওয়া জিমি এলেন ও তাঁর দুই বন্ধু। এর পাশেই আরেকটি পুরোনো গাড়ি পাওয়া গেল। সেখানেও তিনটি কঙ্কাল। এই হতভাগ্যরা ১৯৬৯ সালে হারিয়ে গিয়েছিল। ৪১ বছর পর তাদেরও খোঁজ মিলল।
৬. টেরি সিয়াভোর মৃত্যু অধিকার নিয়ে মামলা
টেরি সিয়াভো নামের ফ্লোরিডার এক বিবাহিত নারী হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকের পর নির্বাক নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। কৃত্রিম উপায়ে খাবার দিয়ে তাঁকে বাঁচিয়ে রাখা হলো। একে বলে ‘ভ্যাজিটেটিভ স্টেট’। অবস্থার কোনো উন্নতি নাই, হবেও না বলে ডাক্তার মত দিয়েছেন। বছরের পর বছর হাসপাতালে পড়ে আছেন। তিনি হয়তো কষ্টই পাচ্ছেন—এই যুক্তি দেখিয়ে তাঁর খাদ্য নল খুলে দেওয়ার আবেদন জানিয়ে আদালতে গেলেন টেরির স্বামী। তিনি বললেন, ‘সে কথা বলতে পারলে এটাই চাইত বলে আমার বিশ্বাস।’
এদিকে টেরির স্বামীর বিরুদ্ধে আদালতে গেলেন টেরি সিয়াভোর বাবা-মা। তাঁরা বললেন, চিকিৎসকের ডায়াগনোসিস ভুল, সে একদিন সুস্থ হয়েও উঠতে পারে। শুরু হলো আইনের যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে ধীরে ধীরে গভর্নর, রাজনীতিবিদ এমনকি প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত জড়িয়ে পড়লেন। ১৯৯০ সালের সেই মামলার চূড়ান্ত রায় হলো ২০০৫ সালে। রায় গেল টেরির স্বামীর পক্ষে। টেরি সিয়াভোর নল খুলে ফেলা হলো, সে মারা গেল। টেরি সিয়াভোর এই ঘটনা গোটা আমেরিকায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল।
রাজনৈতিক মজার খবর
৭. ব্রিজগেট কেলেঙ্কারি
নিউইয়র্ক ও নিউজার্সির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগমাধ্যম জর্জ ওয়াশিংটন ব্রিজ। ব্রিজের কর্মকর্তারা ২০১৩ সালের ৯ সেপ্টেম্বর একটি লেন বন্ধ করে দিলেন। ফলাফল ভয়াবহ। মাইলের পর মাইল গাড়ি আটকে আছে। যানজট পৌঁছাল পাশের ছোট্ট শহর ফোর্ট লিতে। হাজারো গাড়ি রাস্তায় থেমে আছে। ফোর্ট লি কার্যত অচল। বন্ধ লেনটি খোলা হলো চার দিন পর, ১৩ সেপ্টেম্বর।
ব্রিজ কর্তৃপক্ষ বলছে, ট্রাফিক প্যাটার্ন নিয়ে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য লেনটি বন্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু তদন্তে বেরিয়ে এল রাজনৈতিক প্রতিহিংসা। যাঁরা লেন বন্ধ করেছেন, তাঁরা নিউজার্সির তৎকালীন সিনেটর ক্রিস ক্রিস্টির লোক। তখন সিনেটর পদে পুনর্নির্বাচন চলছে। ক্রিস্টি দলমত-নির্বিশেষে নিউজার্সির মেয়রদের কাছে সমর্থন চেয়েছেন। ফোর্ট লির ডেমোক্রেটিক মেয়র মার্ক সোকোলিক তাঁকে সমর্থন দেননি। এতেই তাঁর অনুগত ব্রিজ কর্মকর্তারা শাস্তিস্বরূপ এই পন্থা অবলম্বন করেন। তদন্তে তাঁদের ই–মেইল পাওয়া গেল। একজন আরেকজনকে লিখেছেন, ‘ট্রাফিক জ্যাম তাহলে শুরু করছি।’ আরেকজন বলেছে ‘হ্যাঁ, করো।’
রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে তাঁরা হাজারো নারী, পুরুষ, শিশু, সুস্থ-অসুস্থ মানুষকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্রিজের আটকে রেখেছিলেন। এ ঘটনায় মামলা হলো। চার বছর পর তিনজনের জেল হলো। গভর্নর ক্রিস ক্রিস্টির কিছু হলো না।
৮. সারা পলিনের রাশিয়া দর্শন
সারা পলিনের কথা কে না জানে। তখনকার আলাস্কার গভর্নর। সবাই তাঁর বিদ্যাবুদ্ধি নিয়ে সন্দিহান। ২০০৮ সালে তিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে দাঁড়ালেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলো, তিনি কোন পেপার পড়েন। তিনি উত্তর দিতে পারলেন না।
আরেকবার জিজ্ঞেস করা হলো, রাশিয়ার সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক নিয়ে তাঁর কী ধারণা? তিনি বললেন, ‘রাশিয়া আলাস্কার একদম কাছেই, ওখান থেকেই তো আমি রাশিয়া দেখতে পাই।’ সারা পলিন তাঁর বাড়ি থেকে রাশিয়া দেখছেন এমন ভিডিও বানানো হলো। ‘স্যাটার ডে নাইট লাইভে’ হাসির ফোয়ারা ছুটল। তবে সেবার সারা পলিন জয়ী হতে পারেননি।
৯. রিক প্যারির বিস্মৃতি
রিক প্যারি, টেক্সাসের সাবেক গভর্নর। তিনি প্রেসিডেন্ট পদের জন্য প্রাইমারিতে দাঁড়ালেন। তাঁর বিদ্যাবুদ্ধি নিয়েও মানুষের বিশেষ সন্দেহ আছে। একবার সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দিতে না পেরে তিনি মাতালের মতো অভিনয় করতে থাকলেন, যদিও তিনি মাতাল ছিলেন না। তারপর হঠাৎ চশমা পরা শুরু করলেন। ট্রাম্প তখনো প্রেসিডেন্ট হননি। ট্রাম্প বললেন, নিজেকে যেন বুদ্ধিমান দেখা যায়, সে জন্য রিক প্যারি চশমা পরা ধরেছে। গিয়ে দেখ, চশমার কোনো পাওয়ার নেই।
রিক প্যারিকে প্রেসিডেন্সিয়াল বিতর্কে সাংবাদিক প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি তিনটি সরকারি সংস্থা বিলুপ্ত করবেন বলেছেন, কোন তিনটি?’ তিনি দুটির নাম বলে আমতা-আমতা করতে লাগলেন। তৃতীয় যেই সংস্থাটি বিলুপ্ত করবেন তার নাম কিছুতেই মনে করতে পারলেন না। পরে তিনি জানিয়েছেন সেই তৃতীয়টি হলো জ্বালানি মন্ত্রণালয়।
বর্তমানে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের জ্বালানি মন্ত্রী হিসেবে কাজ করছেন।
১০. একজন হিরো
প্রয়াত সিনেটর জন ম্যাককেইন নির্বাচনী প্রচারণায় গিয়েছেন মিনেসোটায়। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী বারাক ওবামা। টাউন হলে প্রচারণা চলছে। সেখানে এক বৃদ্ধা তাঁকে বললেন, ‘বারাক ওবামাকে বিশ্বাস করা যায় না, আমি শুনেছি সে আসলে আরবের লোক...।’
সঙ্গে সঙ্গে মাথা নাড়িয়ে ওই বৃদ্ধার কাছ থেকে মাইক নিয়ে ম্যাককেইন বললেন, তাঁকে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই, সে একজন ভদ্র মানুষ।
জন ম্যাককেইন ও তাঁর স্ত্রী সিন্ডি ম্যাককেইনের ব্রিজেট নামের একজন বাংলাদেশি পালিত কন্যা আছে। ২০০০ সালের নির্বাচনে কিছু মানুষ ব্রিজেটকে অবৈধ সন্তান হিসেবে আখ্যা দিয়ে সমস্যার সৃষ্টি করেছিল। তারপরও তাঁরা নিজের মেয়েদের মতোই ব্রিজেটকে ভালোবাসা এবং মর্যাদা দিয়েছেন। এমন একজন রাজনীতিবিদ সবার শ্রদ্ধার পাত্র।