ভাষা আন্দোলন থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং সাম্প্রতিক শাহবাগ। নিরন্তর লড়াই-আন্দোলনের সেনানী কামাল লোহানীর জীবনসংগ্রাম থামিয়ে দিল করোনাভাইরাস। ২০ জুন সকাল ১০টা নাগাদ ঢাকার এক বেসরকারি হাসপাতালে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর।
তিনি ছিলেন বাংলাদেশে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা। বহুমাত্রিক সৃষ্টিশীল জীবনে ছিলেন একাধারে সাংবাদিক, অন্যদিকে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব। কামাল লোহানীর মৃত্যুতে দেওয়া শোকবার্তায় প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আব্দুল হামিদ বলেছেন, ‘সাংস্কৃতিক আন্দোলনসহ বাঙালি সংস্কৃতি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশে তিনি ছিলেন একজন পুরোধা ব্যক্তি।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শোকবার্তায় বলেছেন, ‘আমরা একজন প্রগতিশীল ব্যক্তিত্ব এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনার অসাধারণ যোদ্ধাকে হারালাম।’
চিরবিদ্রোহী কামাল লোহানীর জন্ম ১৯৩৪ সালের ২৬ জুন সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার খান সনতলা গ্রামে। তাঁর নাম রাখা হয়েছিল আবু নঈম মহম্মদ মোস্তফা কামাল খান লোহানী। ছাত্রাবস্থায় ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে রাজনীতিতে হাতেখড়ি কামাল লোহানীর। ১৯৫৩ সালে স্বৈরশাসন তাঁকে কারাবন্দী করে। কারাগার থেকে মুক্তির কয়েক মাস বাদেই ১৯৫৪ সালে তিনি ফের গ্রেপ্তার হন। ওই সময়ে তিনি কমিউনিস্ট মতাদর্শের সংস্পর্শে আসেন, যা আজীবন বহন করেছেন।
পূর্ব পাকিস্তানে, যা এখন বাংলাদেশ, তখন আইয়ুব খানের স্বৈরশাসন। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষ পালনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে সেই স্বৈরশাসন। শাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেই ঢাকায় রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্য ‘শ্যামা’ মঞ্চস্থ করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন কামাল লোহানী। তিনি নিজে এই নৃত্যনাট্যে বজ্রসেনের চরিত্রে অভিনয় করেন। ছায়ানট আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে হাজার হাজার শিল্পী ও মানুষের অংশগ্রহণ গোটা উপমহাদেশকে আলোড়িত করে। ১৯৬২ সালে তিনি ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদক হন।
এর পর ১৯৬৭ সালে তিনি গড়ে তোলেন সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ক্রান্তি’। স্বাধীন বাংলাদেশেও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট গড়ে স্বৈরশাসক-বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার ভূমিকা পালন করেন তিনি। ছায়ানট, উদীচী, ক্রান্তিসহ বহু সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। পরবর্তীকালে তিনি উদীচীর সভাপতিও হন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে যুক্ত হয়ে কলকাতা থেকে প্রচারিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বার্তা বিভাগের প্রধানের দায়িত্ব নেন কামাল লোহানী। পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয়ের সংবাদ তিনিই প্রথম ঘোষণা করেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে। স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি দায়িত্ব নেন ঢাকা বেতারের। কিন্তু দু বছর বাদেই ১৯৭৩ সালে ‘দৈনিক জনপদ’ সংবাদপত্রে যোগ দেন। এরপর ‘বঙ্গবার্তা, ‘দৈনিক বাংলার বাণী’, ‘দৈনিক বার্তা’, ‘দৈনিক সংবাদ’সহ বহু পত্রপত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন। ১৯৯১ সালে তিনি শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটেরও উপদেষ্টা ছিলেন তিনি।
বাংলাদেশ ছাড়া তাঁর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করা হয়েছে ওপার বাংলার বহু রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং বিশিষ্ট ব্যক্তির পক্ষ থেকে। পশ্চিম বাংলার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার গভীর শোক জানিয়ে বলেছেন, ‘বাংলাদেশের প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধা এবং সংস্কৃতি-যোদ্ধা কামাল লোহানী প্রয়াত হয়েছেন। তাঁর স্মৃতির প্রতি আমার প্রণাম। তাঁর স্নেহ পেয়েছিলাম, তা আমার জীবনের স্মরণীয় সম্বল।’
সিপিআই (এম) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র ২০ জুন টুইটারে বলেছেন, ‘উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আত্মনিবেদিত ছিলেন কামাল লোহানী। রাষ্ট্রযন্ত্রের ভ্রুকুটির তোয়াক্কা না করে গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার লড়াকু সৈনিকের মৃত্যু এক অপূরণীয় ক্ষতি। শ্রদ্ধায়, স্মরণে সমবেদনা জানাই পরিজনদের।’
পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘের সাধারণ সম্পাদক রজত বন্দ্যোপাধ্যায় ওই দিন এক শোকবার্তায় বলেন, ‘বাংলাদেশের বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, মুক্তিযুদ্ধের অগ্রণী সৈনিক, বামপন্থী ও প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের নেতা, এই উপমহাদেশের সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আন্দোলনের আপসহীন যোদ্ধা ছিলেন কামাল লোহানী।’ আর ভারতীয় গণনাট্য সংঘ শোকবার্তায় বলেছে, ‘বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর অন্যতম প্রাণপুরুষ, বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেনানী, বিশিষ্ট সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানীর প্রয়াণে ভারতীয় গণনাট্য সংঘ, পশ্চিমবঙ্গ মর্মাহত ও গভীর শোকাহত।’
কামাল লোহানী শিক্ষা-সংস্কৃতি, ভাষা, রাজনীতিসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে অনেকগুলো বই লিখেছেন। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন পদকে ভূষিত হয়েছেন। সর্বশেষ ২০১৫ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন। কামাল লোহানী একজন ভদ্র, নম্র, বন্ধুবৎসল ব্যক্তি হিসেবে গণ্য ছিলেন। সাম্যবাদের অনুসারী হিসেবে মানবতা, মানবিক চরিত্র ও বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তা-চেতনার যেসব গুণাবলি একজন ব্যক্তিকে পূর্ণ কমিউনিস্টে পরিণত করে, কামাল লোহানীর মধ্যে তার সবকিছুই দৃষ্ট হয়েছিল। অলৌকিক অন্ধবিশ্বাসে বিশ্বাসী ছিলেন না। তাই তাঁর মরদেহ মানবতা ও বিজ্ঞানের সেবায় হাসপাতালে দান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। করোনা-আক্রান্ত হওয়ায় তাঁর সে আশা পূরণ হতে পারেনি। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তাঁর জীবনের লালিত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্বপ্ন অপূরণ রয়ে গেছে। সেটি হলো, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে বাংলাদেশ তিনি দেখবেন বলে আশা করেছিলেন, সে বাংলাদেশ তিনি দেখে যেতে পারেননি।