বাংলায় কাজিন বোঝাতে হলে বলতে হবে ‘খালাতো, মামাতো, চাচাতো এবং ফুফাতো ভাই বোনেরা।’
আবার ইংরেজিতে ওরা কাজিন শুনেই সন্তুষ্ট। খালার মেয়ে, না মামার মেয়ে, না চাচার বা ফুফার তা জানতে চায় না। সব কাজিনই মনে হয় তাদের কাছে এক। অদ্ভুত ব্যাপার!
সদ্য আমেরিকায় এসেছি। একজন আরেকজনকে দেখিয়ে ‘ব্রাদার’ বলাতে আমি অভ্যাস বশে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ইওর ওন ব্রাদার?’ (মানে-আপন ভাই?) সে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে কী যেন চিন্তা করল, তারপর বলল, ‘আপন ছাড়া আর কী ধরনের ভাই আছে?’ তখন বুঝলাম, মামাতো ভাই হলে সে বলত কাজিন। পাড়াতো হলে বলত নেইবার। সৎ ভাই হলে বলত হাফ ব্রাদার। শুধু ‘ভাই’ সে নিজের ভাই ছাড়া কোনোক্রমেই বলবে না।
আর আমরা এক কাপ চা এক সঙ্গে খাওয়ার পর, লোকটার ঘাড়ে হাত দিয়ে আরেকজনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই, ইনি হচ্ছেন আমার বড় ভাই। কাজেই ‘আপন ভাই’ না ‘চা-তো ভাই’, জিজ্ঞেস না করে উপায় থাকছে না। তারপর কোনোটা আবার এক শব্দে ওদের আছে, আমাদের নেই। যেমন, ‘আমি চাবি ঘরের ভেতরে রেখে দরজা বন্ধ করে দিয়ে বাইরে এসেছি, এখন খুলতে পারছি না।’ এ দেশে আসার প্রথম দিকে আমার নিজের এমন এক ঘটনা ঘটেছিল। আমার প্রতিবেশী জিজ্ঞাসা করল কী হয়েছে? আমি তাঁকে দুই তিন বাক্যে ব্যাপারটা বলেছিলাম। তিনি মৃদু হেসে শুধু বলছিলেন, ‘ইউ লকড আউট’। তখন বুঝিনি, কারণ সহজে তো বুঝতে চাই না। শুধু বুঝতেই চাই। পরে দেখলাম তাঁরা ব্যাপারটা সহজ করে রেখেছে, এক কথায় প্রকাশ, ‘লকড আউট’।
তারপর এই প্রথম জানলাম পায়ের আঙুলকে তাঁরা আঙুলই বলে না। বলে ‘টো’। ‘টো’ কথাটা কে না শুনেছে। পায়ের সামনের অংশ। কিন্তু পায়ের বুড়ো আঙুলটা ‘বিগ টো’, শেষের আঙুলটা ‘ফিফ্থ টো’ হবে কেন? ‘ফুট ফিঙ্গার’ না কেন?
একদিকে মামাতো আর চাচাতো বোন সমান, অন্যদিকে পায়ের আঙুল আর হাতের আঙুলে বিরাট ভেদাভেদ। সম্পূর্ণ ভিন্ন শব্দের ব্যবহার! আশ্চর্য কথা!
এখন মনে হচ্ছে, পায়ের আঙুলের দিকে যখন তারা তাকায়, তখন তাকে আঙুল হিসেবে দেখতে পায় না। অন্য রকম একটা বর্ধিত অংশ হিসেবে দেখে। ব্যাপারটা খুব ভুলও না। আঙুলের যে বিশেষত্ব, কোনো কিছু ধরতে পারা, এদিক-ওদিক ইঙ্গিত নির্দেশ করতে পারা, কাঁচ কলা বা থাম্বস আপ দেখানো, সেসব তো পায়ের আঙুল দিয়ে করা যায় না। তাহলে আঙুল হলো কী করে? কষ্ট করে হয়তো কলম জাতীয় কিছু পায়ের আঙুলেও ধরে ফেলা যাবে, কিন্তু সেই বিচারে টিয়া পাখির নখগুলোকেও আঙুল বলতে হয়। তাহলে দেখা যাচ্ছে, ভাষা শুধু নাম শেখাচ্ছে না, জিনিসটার সম্পর্কে একটা বোধ মাথায় ঢুকিয়ে দিচ্ছে। বোধটা ভুলও হতে পারে। অন্তত পক্ষে বিভিন্ন ভাষায় বিভিন্ন হতে পারে। আবার এক ভাষায় হয়তো একটা শব্দই নেই, তখন বোধটাও সম্পূর্ণ অনুপস্থিত।