করোনাভাইরাসের তাণ্ডবে গত এক মাসে বদলে গেছে নিউইয়র্কের নগর জনপদ। ৮ মার্চ যেখানে আমেরিকায় মারা গিয়েছিল ১৯ জন, সেখানে নিউইয়র্কে আক্রান্ত হয়েছিল ৭৬ জন! এক মাস পর ৮ এপ্রিল নিউইয়র্কে আক্রান্তের সংখ্যা দাড়িয়েছে দেড় লাখের বেশি, মৃত্যু হয়েছে ছয় হাজারের বেশি মানুষের।
নিউইয়র্কের এই বদলে যাওয়া কোথায় গিয়ে ঠেকবে, এ নিয়ে চলছে নানা আলোচনা। এর মধ্যেই নিউইয়র্কের সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী যাত্রীসেবা ইয়েলো ট্যাক্সিক্যাব ইতিহাস হয়ে যাবে—এমনটাই আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ নিয়ে নিউইয়র্ক টাইমস প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
নিউইয়র্ক নগরের ট্যাক্সিক্যাব ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে জড়িত লোকজন বলছেন, সরকারের জরুরি হস্তক্ষেপ ছাড়া নগরের ইয়েলো ক্যাব শিগগিরই ইতিহাসের দূর পাঠ হয়ে দাঁড়াবে। কোভিড-১৯ হানা দেওয়ার পর ২২ মার্চ থেকে নিউইয়র্ক লকডাউনে চলে যায়। জরুরি যান চলাচল অব্যাহত থাকে। নাগরিকদের চলাচলের সুবিধোর্থে নগরের ট্যাক্সি ও লিমোজিন কমিশন নিয়ন্ত্রিত ইয়েলো ক্যাব চালু রাখা হয়।
এমনিতেই উবার, লিফটের মতো অ্যাপসভিত্তিক ক্যাব চালুর পর ইয়েলো ক্যাব ব্যবসায় ধস নেমেছিল। কোভিড-১৯ ইয়েলোক্যাব ব্যবসার কফিনে যেন শেষ পেরেক মারতে বসেছে। নিউইয়র্ক টাইমস প্রতিবেদনে বলেছে, লকডাউন শুরু হওয়ার পর নগরীর ইয়েলো ক্যাবে যাত্রী পরিবহন ৯১ শতাংশ কমে এসেছে। সবকিছু বন্ধ, হোটেল-রেস্তোরাঁয় লোক নেই, বিমানবন্দরে যাত্রী নাই, বাইরের দেশ থেকে বা অন্য কোন রাজ্য থেকেও নিউইয়র্কে লোকজন আসছে না। মৃতপ্রায় নগরে ইয়েলো ক্যাবের দেখা পাওয়া যায়। যাত্রীর সন্ধানে নিঃসঙ্গ অভিযাত্রীর মতো ক্যাবচালকেরা খুঁজছেন যাত্রী।
৩ এপ্রিল লেক্সিংটন অ্যাভিনিউ আর ২৮ স্ট্রিটে পাওয়া গেল আহমেদ বাবু নামে বাংলাদেশি ক্যাবচালক এক ক্যাব চালককে। ইয়েলো ক্যাবের স্টিয়ারিঙে হাত রেখে বিমর্ষ বাবু বললেন, ১০ ঘণ্টার শিফটে দুজন যাত্রীও পাওয়া যাচ্ছে না। আগের দিন পুরো শিফট কাজ করেছেন নানা আতঙ্ক নিয়ে। আয় করেছেন মাত্র ৬০ ডলার। ম্যাডেলিয়নের মর্টগেজ, বিমা, গাড়ির পেমেন্ট এসব নিয়ে উদ্বিগ্ন এ ক্যাবচালক জানান, জানি না ভবিষ্যতের জন্য কি আছে। আদৌ কোন ভবিষ্যৎ আছে কি না। নিজেই এমন প্রশ্ন রেখে শূন্যে তাকিয়ে থাকলেন।
এর মধ্যে প্রণোদনা প্যাকেজ, নাগরিক ও ক্ষুদ্র সহযোগিতার যেসব প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়েছে, তা নিয়ে সন্তুষ্ট নয় আরেক ক্যাবচালক স্যামুয়েল। বললেন, সবই শুভংকরের ফাঁকি। এসব অর্থ আমাদের দেওয়া হচ্ছে। আবার বিভিন্নভাবে নিয়ে যাবে। ম্যাডেলিয়নের মর্টগেজ, ক্যাব চালনার জন্য টিএলসি ফি—এসব বাতিল করা না হলে এ শুভংকরের ফাঁকিতে আমরা হারিয়ে যাব, জানালেন ক্যারাবীয় এ ইয়েল ক্যাবচালক।
টিএলসির দেওয়া তথ্য মতে, গত সপ্তাহান্তে শুক্র ও শনিবারে নগরে ২০ হাজার ৫৯৬ রাইডের রেকর্ড পাওয়া গেছে। অন্য সময়ের তুলনায় তা মাত্র ৯ শতাংশ। লকডাউন শুরুর আগে এমন সময়ে নগরের ইয়েলো ক্যাব ২ লাখ ১৭ হাজার ৫৪০টি রাইড রেকর্ডে আছে।
ট্যাক্সি অ্যালায়েন্স ইউনিয়নের নির্বাহী পরিচালক ভৈরভি দেশাই বলেন, এভাবে চলতে থাকলে একজন ক্যাবচালক সপ্তাহে সাড়ে তিন শ ডলার আয় করতে পারবে না। গাড়ি ভাড়া, মর্টগেজ, ইনস্যুরেন্স, টিএলসি ফি দিয়ে নিজের থাকার জন্য ঘর ভাড়া, পরিবারের ব্যয় নির্বাহ—ক্যাবচালকদের জন্য এসব এখন দুঃস্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব ক্যাবচালক চরম স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
নগরের ইয়েলোক্যাবের জন্য জরুরি নগদ অর্থ সহযোগিতার আবেদন জানিয়েছেন ক্যাবচালকেরা।
স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশসহ জরুরি বিভাগের মতো ক্যাবচালকেরা জীবন বাজি রেখে নগরকে কিছুটা হলেও চালু রাখছেন। অগুনতি অসুস্থ লোকজনকে সেবা দিচ্ছেন। তাদের দাবি, আগের ছয় মাসের সব ফি, সার চার্জ মওকুফ করা হোক, মর্টগেজ দেওয়া ব্যাংককে অন্তত ছয় মাসের জন্য পেমেন্ট স্থগিত রাখার নির্দেশ দেওয়া হোক। ট্যাক্সি ড্রাইভার অ্যালায়েন্সের পক্ষ থেকে বিনা সুদে ঋণ দেওয়াসহ পরিস্থিতি ভালো না হওয়া পর্যন্ত সব ধরনের ফি বাতিল করা এবং এ বছরে আদায় করা ফি ফেরত দেওয়ার দাবি উঠেছে।
নিউইয়র্কের আইন প্রণেতারাও নগরের এই ইয়েলো ক্যাবকে রক্ষার পক্ষে। গভর্নর অ্যান্ড্রু কুমো ইতিমধ্যেই ফেডারেল সহযোগিতা থেকে ক্যাবচালকসহ অন্যান্য স্বাধীন পেশাজীবীর সাহার্যার্থে একটি প্যাকেজ নিয়ে কাজ করছেন। নিউইয়র্কে অনেকেই আবেদন করেছেন বা করছেন। অনেকেই জানেন না, কীভাবে এই সহযোগিতার জন্য আবেদন করবেন। এ নিয়ে ট্যাক্সি বা ম্যাডেলিয়ন ব্রোকাররা এখনো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়নি। নিউইয়র্কের পরবর্তী নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী, বর্তমান স্পিকার কোরি জনসন ক্যাবচালকদের জন্য আলাদা একটি সহযোগিতার প্রস্তাব নিয়ে কাজ করছেন। তাঁর প্রস্তাবে ক্যাবচালকদের জন্য কর্মহীন ভাতা নিশ্চিত করা এবং প্রতি ক্যাবচালককে আলাদা সাড়ে ৫০০ ডলারের নগদ অর্থ এবং তাদের অল্পবয়সী সন্তানদের জন্য ২৭৫ ডলার করে চাইল্ড ক্রেডিট দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া ক্যাবচালকদের চিকিৎসাসেবায় জড়িত লোকজনকে পরিবহনের কাজে লাগানো হতে পারে। হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ডাক্তার, নার্স পরিবহন ও সরঞ্জাম সরবরাহের কাজে লাগিয়ে ক্যাবচালকদের অর্থ দেওয়া হতে পারে। এর মধ্যে টিএলসি থেকে উবার–লিফটের চালকদের এমন কাজে লাগানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
টিএলসির মুখপাত্র নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন, বেশ কিছু প্রস্তাব নিয়ে দায়িত্বশীলরা কাজ করছেন। ২০১১ সালের ভয়াল ১১ সেপ্টেম্বর, হ্যারিকেন স্যান্ডির পর ইয়েলো ক্যাবের চালকেরা নগরী চালু রেখেছেন। এবারেও ইতিহাসের সবচেয়ে কালো অধ্যায়েও নগরের এই পরিশ্রমী পেশাজীবীরা চালু রেখেছেন নিজেদের পেশা। তাদের এই প্রয়াসকে প্রণোদনা দেওয়া হবে, এমন প্রত্যাশাই করছেন ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে জড়িত লোকজন।
নিউইয়র্কে প্রায় ১৩ হাজার ইয়েলো ক্যাবের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন প্রায় চল্লিশ হাজার চালক। এর মধ্যে প্রায় ২০ হাজার বাংলাদেশি আছেন বলে ধারনা করা হয়।