মুখের কথা সব সময়ই গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে যেমন-তেমন হলেও, রাজনীতিবিদদের ক্ষেত্রে পান থেকে চুন খসলেই বিপদ। কিন্তু এ সরু সুতোর ওপর দাঁড়িয়েও দিব্যি সাধারণ মানুষকে নাচিয়ে যেতে পারেন কিছু ‘কথার ফুলঝুরি’ ফোটানো নেতা। কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারি সে কথার জাদুর মোহ কাটতে শুরু করেছে। তবে কি এমন নেতাদের দিন ফুরিয়ে আসছে?
কথার ফুলঝুরি ফোটানো এই নেতাদের আরেকটু ভালোভাবে বোঝাতে গেলে বলতে হয় ‘লোকরঞ্জনবাদী’ নেতা। এ ঘরানার নেতারা যেমন কথায় রঙ চড়ান, ঠিক তেমনিভাবেই লোকরঞ্জনবাদী শব্দটিকে কিছুটা সরলীকরণ করা হয়েছে। তবে অর্থ কিন্তু বদলায়নি।
একবার ভেবে দেখুন তো—ডোনাল্ড ট্রাম্প, বরিস জনসন, জইর বোলসেনারো, নরেন্দ্র মোদি, জোকো উইদোদো, রদ্রিগো দুতের্তে প্রমুখ নেতাদের নামের পাশে কি শব্দটি বেমানান হয়?
করোনাভাইরাস প্রায় ১৪ মাস ধরে বিশ্বে প্রতাপ ধরে রেখেছে। মহামারিকাল এখনো চলছে সগর্বে। আর এ করোনাকে অবহেলা করেই বিপদে পড়ছেন লোকরঞ্জনবাদী নেতারা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এমন নেতাদের জনপ্রিয়তায় ভাটার টান শুরু হয়েছে। ট্রাম্পকে তো সরেই যেতে হলো। আর অন্যরাও আছেন গ্যাঁড়াকলে।
অথচ এ করোনার আগে এই নেতাদেরই ছিল জয়জয়কার। জনগণ তাঁদের প্রতি অনুরক্ত ছিল প্রবলভাবে। এ নেতারা যা বলতেন, তা নিয়েই মেতে থাকত সবাই। ওই কথার ভুল ধরতে গেলে যে কাউকে অপদস্থ হতে হতো, টিপ্পনীও শুনতে হতো বেশ। আর গণমাধ্যম কিছু বলতে গেলেই হয়ে যেত ‘ফেক নিউজ’! আইন-আদালত, নিয়ম-কানুন—কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করতেন না এই নেতারা। একই রণকৌশলে তাঁরা করোনাভাইরাসকেও উড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু করোনা কি আর কাউকে ডরায়? এখন উল্টো নেতাদের জনপ্রিয়তার ‘মাটির কড়াই’ ভেঙে যাওয়ার উপক্রম!
উদাহরণ হিসেবে প্রথমেই সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রসঙ্গে আসা যাক। মহামারির শুরুতে তিনি বলে দিয়েছিলেন, করোনা নিছক সর্দি-জ্বর ছাড়া কিছু নয় এবং এটি আমেরিকায় তেমন কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। এ ছাড়া জীবাণুনাশক দিয়ে ফুসফুস পরিষ্কার করার এবং মাস্ক না পরার মতো অবৈজ্ঞানিক বিষয়ও বলেছিলেন তিনি। একই রকম মন্তব্য করেছিলেন ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট বোলসেনারো। করোনায় যে মানুষ গুরুতর অসুস্থ হচ্ছেন এবং ব্যাপক হারে মারা যাচ্ছেন, সেই বিষয়গুলো বোলসেনারো স্রেফ অগ্রাহ্য করে গেছেন। ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতের্তে যতটা রাজনৈতিক শত্রুদের নিয়ে তর্জন-গর্জন করেছেন, করোনা নিয়ে তার কিছুই করেননি। আর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তো চলতি বছরের শুরুতেই বিশ্বমঞ্চে ঘোষণা দিয়েছিলেন, করোনাকে তাঁরা ‘পরাজিত’ করেছেন। অথচ এখন সেই করোনাই হয়ে দাঁড়িয়েছে মূল মাথাব্যথার কারণ। এতটাই যে নিজ দলের মধ্যেই তাঁর নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। গত মার্চের মাঝামাঝি থেকে শনাক্ত করোনা রোগীর সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে। গত এপ্রিলের শুরুতেই ভারতে করোনায় সংক্রমিত শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দুই কোটির মাইলফলক ছাড়ায়। আর এখন করোনায় বিশ্বে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় ২ নম্বরে আছে ভারত। এখন বিশ্বে করোনার সংক্রমণের কেন্দ্র বলা হচ্ছে ভারতকে।
গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অবশ্য ট্রাম্প বিদায় নিয়েছেন। কিন্তু তাঁর কারণে হওয়া ক্ষতি পুরোপুরি সামাল দেওয়া এখনো নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের পক্ষে সম্ভব হয়নি। ওয়ার্ল্ডোমিটারসের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে করোনায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ যুক্তরাষ্ট্র। আর ভারতের পর তৃতীয় স্থানে রয়েছে ব্রাজিল।
অন্যদিকে ইন্দোনেশিয়ায় জোকো উইদোদোর প্রশাসন মহামারির শুরুতে ‘প্রচলিত বিশ্বাসে’ আস্থা রাখার আহ্বান জানিয়ে করোনাকে পাত্তা দিতে চায়নি। এখন বিশ্বের মধ্যে যেসব দেশে করোনায় সবচেয়ে বেশি মৃত্যুহার, সেগুলোর একটি ইন্দোনেশিয়া। এ দেশে করোনায় মৃত্যুহার প্রায় ৮ শতাংশ।
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ব্রেক্সিট নিয়ে আগ্রহী ছিলেন বেশি। ফলে করোনা মারাত্মক ছোবল দেয় দেশটিতে। এখন অবশ্য কৌশল বদলে করোনাকে বেশ গুরুত্ব দিচ্ছেন বরিস। জনপ্রিয়তায় ধস নামার ইঙ্গিত পেয়েই এবং নিজে কোভিড-১৯ থেকে সুস্থ হয়ে ওঠার পর সুর পাল্টে ফেলেন তিনি। ফলে দেশটিতে করোনা পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য উন্নতি পরিলক্ষিত হচ্ছে।
একটি বিষয় লক্ষণীয়, যেসব দেশের রাজনৈতিক ও সরকারি নেতৃত্ব করোনাভাইরাসকে গুরুত্ব দিয়েছে, সেসব দেশ করোনা মোকাবিলায় তুলনামূলক ভালো অবস্থানে আছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, জার্মানি, কানাডা ও নিউজিল্যান্ডের কথা। আঙ্গেলা ম্যার্কেলের জার্মানি প্রতি সপ্তাহে দেড় লাখের বেশি করোনা শনাক্তের পরীক্ষা চালিয়েছে নিয়মিত। ফলে সে দেশে করোনায় মৃত্যুহার ১ দশমিক ৬ শতাংশের আশপাশে। জাস্টিন ট্রুডোর কানাডায় এটি ১ দশমিক ৮ শতাংশ। আর জেসিন্ডা আরডার্নের নিউজিল্যান্ড তো করোনা মোকাবিলায় বিশ্বব্যাপী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। দেশটিতে এখনো করোনায় মৃত্যুহার ১ শতাংশের নিচে।
কিন্তু লোকরঞ্জনবাদী নেতারা কেন করোনাকে গুরুত্ব দিলেন না? এর মূল কারণ নিহিত আছে লোকরঞ্জনবাদী রাজনীতির মূলনীতিতে। লোকরঞ্জনবাদী রাজনীতিতে সংশ্লিষ্ট নেতারা সব সময়ই বোঝাতে চান, জনগণের সাধারণ ইচ্ছার বাস্তবায়ন শুধু তাঁরাই করতে পারবেন। আর সাধারণ জনগণও ইদানীং তাতে আস্থা রাখতে চায় বলেই লোকরঞ্জনবাদী রাজনীতির জয়জয়কার দেখা গেছে। এ ধরনের নেতারা দুটি পক্ষ তৈরি বা বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে বিভক্তি তৈরি করাতে বেশি তৎপর থাকেন। কারণ, ওই বিভক্তির মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে পারেন তাঁরা। আর এ কাজে জ্বালানি হিসেবে থাকে বিভিন্ন মিথ্যা ও অস্পষ্ট তথ্য এবং অবৈজ্ঞানিক তত্ত্ব। এসব দিয়েই প্রতিষ্ঠিত ধারণাকে উড়িয়ে দিয়ে জনমনকে আকৃষ্ট করা হয়ে থাকে। তবে করোনার ক্ষেত্রে এ কৌশল একেবারেই উল্টো ফল দিয়েছে। যদি করোনাভাইরাস প্রবল প্রাণঘাতী আকার না নিত, তবে হয়তো লাভবান হতেন লোকরঞ্জনবাদী নেতারা। কিন্তু করোনার কারণে তা হয়নি। বরং এমন নেতাদের ওপর থেকে ভুক্তভোগী জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস কমতে শুরু করেছে বিশ্বব্যাপী।
এর ফলও পাওয়া যাচ্ছে হাতেনাতে। যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে গুটাতে হয়েছে পাততাড়ি। ব্রাজিলে বোলসেনারোর জনপ্রিয়তা বেশ কমে গেছে। আর ভারতে নরেন্দ্র মোদি এতটাই কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন যে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ল্যানসেটের মতো প্রতিষ্ঠান তাঁকে কাঠগড়ায় তুলেছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, বিশ্বব্যাপী এ পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে। যার ফলাফল দৃশ্যমান হচ্ছে নিউইয়র্ক থেকে কলকাতা পর্যন্ত।
অবশ্য কিছুটা বেকায়দায় পড়লেও লোকরঞ্জনবাদী নেতাদের সুযোগ আবার আসতে পারে। করোনা–পরবর্তী সময়ের অর্থনৈতিক সংকট সেই সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে বলে আশঙ্কা আছে। তবে তত দিন এ নেতারা কথার মারপ্যাঁচে টিকে থাকতে পারেন কি না, সেটিই দেখার বিষয়।
তথ্যসূত্র: দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, সিএনএন, দ্য করভারসেশন ডটকম, গার্ডিয়ান, ফোর্বস, দ্য ওয়্যার, রয়টার্স, দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট ও ওয়ার্ল্ড পলিটিকস রিভিউ