নিউইয়র্ক শহরের মেয়র নির্বাচনের আর মাত্র অল্প কয়দিন বাকি। নির্বাচনে মেয়র পদে দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য লড়ছেন বর্তমান মেয়র বিল ডি ব্লাজিও। কিন্তু সময় যত ঘনিয়ে আসছে, ডি ব্লাজিওর জন্য ততই যেন কঠিন হয়ে উঠছে লড়াইয়ের ময়দান। এমনিতে এখন পর্যন্ত হওয়া সবক’টি জরিপেই এগিয়ে রয়েছেন তিনি। কিন্তু দাতাদের নিয়ে কেলেঙ্কারি যেন তাঁর পিছু ছাড়ছেই না। সম্প্রতি তাঁর আরেক দাতা অর্থের বিনিময়ে সিটি হল ‘কিনে নেওয়ার’ কথা বলে আক্ষরিক অর্থেই বোমা ফাটিয়েছেন, যা ডি ব্লাজিওর নির্বাচনী লড়াইকে অনেকটাই বিপাকে ফেলেছে।
এমনিতেই ডেমোক্র্যাট-রিপাবলিকান দ্বিদলীয় বৃত্ত ঘিরে মেয়র নির্বাচন জমে উঠেছে। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী নিকোল ম্যালিওটাকিসের অবস্থান শুরুতে খুব একটা ভালো না হলেও সময়ের সঙ্গে তা ক্রমশ সংহত হচ্ছে। আর এ ক্ষেত্রে ডি ব্লাজিওর তহবিল সংগ্রহসহ সাম্প্রতিক বিভিন্ন পদক্ষেপের নেতিবাচক ভূমিকা রয়েছে।
নিজের নির্বাচনী তহবিল সংগ্রহের পন্থা নিয়ে আগে থেকেই সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন ব্লাজিও। এ নিয়ে তদন্তের মুখোমুখিও হতে হয়েছে তাঁকে। এমনকি তহবিল সংগ্রহের পদ্ধতি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন তদন্তকারীরাও। এসবই পুরোনো বিষয়। নির্বাচন সামনে রেখে ব্লাজিও উত্থাপিত পরবর্তী কর্মপরিকল্পনার দিকেই মনোযোগী হয়ে উঠছিলেন নাগরিকেরা। কিন্তু তাদের মনোযোগ আবারও ওই তহবিলের দিকেই ফিরিয়ে দিয়েছেন ব্লাজিওর দাতা জোনা রেচনিটজ। অর্থের বিনিময়ে সিটি হল কিনে নিয়েছিলেন বলে তিনি আগুনে আক্ষরিক অর্থেই ঘি ঢেলেছেন। ফলে বেশ কয়েকটি সংবাদমাধ্যম নতুন করে ডি ব্লাজিওর সমালোচনায় মেতেছে।
নিউইয়র্ক পোস্ট তো সরাসরি নিকোল ম্যালিওটাকিসকেই পরবর্তী মেয়র হিসেবে বেশি যোগ্য বলে আখ্যা দিয়েছে। সংবাদমাধ্যমটি এ মন্তব্যের জন্য ব্লাজিওর দুর্নীতির পাশাপাশি তাঁর ‘অযোগ্যতা ও ঔদ্ধত্যকে’ও কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে। সংবাদমাধ্যমটির মতে, নিউইয়র্ক শহরকে বিত্তশালী ও সাধারণের জন্য পৃথকভাবে হাজির করাই ব্লাজিওর সবচেয়ে বড় দুর্নীতি। বর্তমানে বিত্তশালী অংশটির কাছে শহরটি এক রকম, আর সাধারণের কাছে অন্যরকম। তাঁর মেয়াদেই তাঁর নির্বাচনী তহবিলে অর্থদাতারা সিটি হল থেকে বিশেষ সুবিধা পেয়েছে।
অন্য সংবাদমাধ্যমগুলোও ব্লাজিওর নির্বাচনী বৈতরণি পার হওয়ার বিষয়টিকে আগের চেয়ে কঠিনই বলছে। এ মাসের শুরুতে নিউইয়র্ক টাইমসের করা জরিপে ব্লাজিওর জনপ্রিয়তা ৬০ শতাংশের বেশি উঠে এলেও এটি এখন কমছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। তাদের মতে, হালের কনফেডারেট ভাস্কর্য অপসারণ বিশেষ নেতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। বিশেষত ক্রিস্টোফার কলম্বাসের ভাস্কর্য অপসারণ ব্লাজিওর ভোটারদের একটি অংশকে চটিয়ে দিয়েছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে অবনমন, অপরাধ বৃদ্ধি, ব্যথানাশকের অতিব্যবহারের কারণে মৃত্যু, সাবওয়েসহ গণপরিবহনে বিশৃঙ্খলা এসবই ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে ভোটারদের সামনে। এর বিপরীতে নিকোল ম্যালিওটাকিস ট্রাম্পের মতোই নিয়ে এসেছেন পরিবর্তনের ভাষ্য, যা কিছুটা হলেও প্রভাব রাখছে।
এ বিষয়গুলো নির্বাচনে বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন ব্রুকলিন ডেমোক্রেটিক পার্টির চেয়ারম্যান ফ্র্যাংক সেডিও। নিউইয়র্ক টাইমসকে তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত হওয়া জরিপে ডি ব্লাজিও সুস্পষ্টভাবে এগিয়ে রয়েছেন। কিন্তু তারপরও এ ধরনের বিষয়গুলো নির্বাচনে প্রভাব রাখবে বলেই মনে করি। নাগরিকদের মধ্যে মেয়র বিরোধী যে অবস্থান তৈরি হয়েছে, তার পেছনে এসবের ভূমিকা অস্বীকারের উপায় নেই।
নির্বাচনে বে রিজ, ডাইকার হাইটস ও বেনসনহার্সটের ভোট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। এ অঞ্চলগুলো মূলত অভিবাসী অধ্যুষিত, যেখানকার অধিবাসীদের একটি বড় অংশই মধ্যপ্রাচ্য, গ্রিস, ইতালি ও চীন থেকে আগত। রক্ষণশীল দুর্গ হিসেবে মনে করা হলেও এ অঞ্চল থেকে সব সময়ই রিপাবলিকান কাউন্সিলম্যান নির্বাচিত হন না। এখন পর্যন্ত এখানকার ভোট ম্যালিওটাকিসের বাক্সে পড়বে বলে মনে করা হলেও তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে।
এ বিষয়ে এখানকার এক সময়ের রিপাবলিকান কাউন্সিলম্যান জেনটাইল নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, ‘রিপাবলিকানরা যথেষ্ট কাজ করছে না। এখানে ডেমোক্র্যাটরা অর্ধেক রাস্তা এরই মধ্যে এগিয়ে আছে। বিশেষত তরুণদের মধ্যে বামঘেঁষা মনোভাব বেশি।’
প্রসঙ্গত, বর্তমানে ৫১ সদস্যবিশিষ্ট কাউন্সিলে মাত্র তিনজন রিপাবলিকান প্রতিনিধি রয়েছে। আর এর মধ্যে কেউই ব্রুকলিনের নয়। তবে এতে নিশ্চিত হওয়ার কোনো সুযোগ ডি ব্লাজিওর সামনে নেই। কারণ যে তহবিলের শক্তিতে তিনি নির্বাচনী দৌড়ে এগিয়ে রয়েছেন অনেকটা, সেই তহবিল কেলেঙ্কারিই তাঁর পিছু ছাড়ছে না। এর সঙ্গে রয়েছে ট্রাম্পের সঙ্গে তাঁর আগের দ্বন্দ্বের বিষয়টিও। অবশ্য ব্লাজিওর প্রচার শিবির ট্রাম্পের অজনপ্রিয়তাকেও কাজে লাগাচ্ছে। অন্যদিকে ম্যালিওটাকিস জরিপে পিছিয়ে থাকায় প্রচার কার্যক্রমকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছেন, যেমনটা দিয়েছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। পরিবর্তনের স্লোগান দিয়ে মাঠ পর্যায়ের গণসংযোগ করছেন ম্যালিওটাকিস। আর গেল প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সব হিসাব উল্টে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে এ বিষয়টিই এগিয়ে দিয়েছিল অনেকটা। তাই ভোটাররা শেষ পর্যন্ত কার ওপর আস্থা রাখেন, তা জানতে ৭ নভেম্বর ভোটের দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।