১৭৯০ সাল থেকে শুরু করে প্রতি ১০ বছর অন্তর আমেরিকায় আদমশুমারি পরিচালিত হয়ে আসছে। এর মূল লক্ষ্য দুটি—সরকারি অর্থ বরাদ্দকরণ এবং হাউস অফ রিপ্রেজেনটেটিভে প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের আসনসংখ্যা নির্ধারণ। উভয় উদ্দেশ্য বিবেচনাতেই ২০২০ সালের আদমশুমারি অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
সরকারি অর্থ বরাদ্দকরণ
আদমশুমারি থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে আগামী ১০ বছর প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মসূচিতে সরকার কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় করবে, তা নির্ধারণ করা হয়। শুধু এক বছরের জন্যই ফেডারেল তহবিলের এই বরাদ্দের পরিমাণ ৬৭৫ বিলিয়ন ডলার! এই বিপুল পরিমাণ অর্থের কারবারে একজন সাধারণ নাগরিকের ভূমিকাটা কী, তা হয়তো অনেকেই বুঝে উঠতে পারেন না।
ব্রঙ্কসের মাঠকর্মী তসলিমা নাসরিন তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে গিয়ে বলেন, ‘আদমশুমারির সম্পর্কে জানাতে গেলে অনেকেই বলে, একটা পরিবার না করলে কোন ক্ষতি হবে না। কেউ কেউ জিজ্ঞেস করে, এটাতে আমার কি লাভ?’
এর উত্তর দিচ্ছেন ইউএস সেনসাস ব্যুরোর পার্টনারশিপ স্পেশালিস্ট স্নেহা দেশাই, ‘একটু ছোট্ট পরিসরে চিন্তা করলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে। ধরুন, আপনি যে এলাকায় থাকেন সেখানে ১০০ জন লোকের বসবাস। তার মধ্যে ৬০ জন যদি গণনায় অংশ নেন, তাহলে সরকার ৬০ জনের হিসেবে সরকারি সাহায্য দেবে। আগামী ১০ বছরের জন্য প্রাপ্য অর্থের মাত্র ৬০ শতাংশ আপনার এলাকাবাসী পাবে। তার মানে, যারা গণনায় অংশ নেয়নি শুধু তারা নয়, পুরো এলাকাবাসীই ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হলো।’
মোট বরাদ্দকৃত অর্থের বণ্টনও নির্ভর করে আদমশুমারি থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ওপর। গণনার মাধ্যমে একটি এলাকার মোট জনসংখ্যা, বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর অনুপাত, নারী-পুরুষের অনুপাত, পরিবারগুলোর গড় সদস্যসংখ্যা, গড় বয়সের ধারণা পাওয়া যায়। এসব তথ্যের ভিত্তিতে গণপরিবহন, জনস্বাস্থ্য, স্বাস্থ্যবিমা, শিক্ষা, গৃহায়ণ, রাস্তাঘাট ইত্যাদির উন্নয়ন কর্মসূচিতে প্রয়োজনমাফিক অর্থ বরাদ্দ করা হয়। যেমন—প্রতিবন্ধী, বয়োবৃদ্ধ ও শিশুদের সংখ্যার অনুপাতে স্পেশাল স্কুল, সিনিয়র কেয়ার এবং স্কুলগুলোয় বিনা মূল্যে খাদ্য বিনিময় কার্যক্রমে সরকারি অনুদান দেওয়া হয়। মেডিকেইড, মেডিকেয়ার, ফুড স্ট্যাম্প (বর্তমানে SNAP) এসবই সরকারি অনুদানের আওতাভুক্ত। এমনকি একটি নতুন লাইব্রেরি বা হাসপাতাল কোথায় প্রতিষ্ঠা করা হবে, সেই সিদ্ধান্তও জরিপ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের আলোকে নেওয়া হয়!
রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব নির্বাচন
রাজনৈতিক বিবেচনায় আদমশুমারির গুরুত্ব ভোটের চেয়ে কম কিছু নয়। লোকগণনার ফলাফলের নিরিখে একটি রাজ্য কংগ্রেসে আসনসংখ্যা লাভ করতে বা হারাতে পারে। কংগ্রেসে প্রতিনিধি সংখ্যার সমানুপাতে একটি রাজ্যের ইলেক্টোরাল কলেজের সংখ্যা নির্ধারিত হয়, যার প্রভাব পরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে।
২০১০ এর আদমশুমারির ফলাফলে দেখা গিয়েছিল, দক্ষিণ ও পশ্চিমের রাজ্যগুলো কংগ্রেসে নতুন আসন (যেমন টেক্সাস ৪টি, অ্যারিজোনা ২টি) লাভ করে। অন্যদিকে, উত্তর-পূর্ব এবং মধ্য-পশ্চিমের রাজ্যগুলো এক বা একাধিক আসন হারিয়ে ফেলে। নিউইয়র্কে হারায় দুটি আসন, প্রতিবেশী নিউজার্সি একটি। ২০১০ আদমশুমারির পরিপ্রেক্ষিতে রিপাবলিকান ঘেঁষা রাজ্যগুলোর কংগ্রেসে বাড়তি প্রাপ্তি, তুলনায় ডেমোক্র্যাট সমর্থিত রাজ্যগুলোর আসনসংখ্যার ঘাটতি ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কি পরিণতি বয়ে এনেছিল তা সবারই জানা।
২০২০ কেন আলাদা?
চলতি বছরই প্রথম অনলাইনে আদমশুমারির জরিপ সম্পন্ন করার সুযোগ চালু হয়েছে। নতুন প্রজন্মের জন্য এটি নিঃসন্দেহে সুবিধাজনক, কিন্তু যারা বয়স্ক এবং প্রযুক্তির ব্যবহারে অভ্যস্ত নয়, তারা চিরাচরিত পন্থায় ডাকযোগে জরিপের ফরম জমা দিতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য। কিন্তু চলমান করোনা পরিস্থিতিতে যেখানে জীবন নিয়েই টানাটানি, চলাচলে জারি নিষেধাজ্ঞা, সেখানে কয়জন লোক জরিপের ফরম জমা দেওয়ার মতো মনের অবস্থায় আছেন?
অথচ করোনা সংকট মোকাবিলায় আদমশুমারিই হতে পারে জনসাধারণের হাতিয়ার। গবেষকেরা জানিয়ে দিয়েছেন, খুব শিগগিরই করোনার হাত থেকে আমাদের মুক্তি নেই। অবস্থার উন্নতি হতে হয়তো আরও দুই বছর অপেক্ষা করতে হতে পারে। এখন হাসপাতালগুলোয় পর্যাপ্ত পিপিই, ভেন্টিলেটর এবং অন্যান্য সরঞ্জামের সরবরাহ নেই; ডাক্তার-নার্সের সংখ্যা অপ্রতুল। এলাকাভিত্তিক জনসংখ্যার সঠিক হিসাব হাসপাতালেগুলোতে আগামী ১০ বছরের জন্য প্রয়োজনমাফিক সরকারি অর্থায়ন নিশ্চিত করবে।
করোনাসংকট নিরসনে তো বটেই, আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও এবারের আদমশুমারির গুরুত্ব অপরিসীম। ২০১০ সালের আদমশুমারি আমেরিকার রাজনৈতিক মানচিত্র পাল্টে দিয়েছিল। ২০২০ সালের আদমশুমারিতে সকলের অংশগ্রহণ হয়তো আবার বদলে দিতে পারে আমেরিকার রাজনৈতিক এবং আর্থসামাজিক চিত্র।
কীভাবে আদমশুমারিতে অংশ নেবেন?
মার্চ মাস নাগাদ যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি বাড়ির ঠিকানায় ডাকযোগে জরিপের চিঠি পৌঁছে যাওয়ার কথা। চিঠি না পেলেও অনলাইনে (my2020census.gov) অথবা ফোনে (৮৪৪-৩৩০-২০২০, ইংরেজিভাষীদের জন্য) আদমশুমারির জরিপ সম্পন্ন করা যাবে। নিউইয়র্কে বাংলাদেশি কমিউনিটির কল্যাণে কাজ করে যাওয়া কিছু স্থানীয় এনজিও (যেমন, স্বপ্ন, ড্রামস) জরিপে অংশ নিতে সহযোগিতা করে। জরিপ সম্পর্কিত যেকোনো প্রয়োজনে ফোন করুন ৬৪৬-৯৪৫-৮২১০ নম্বরে।
মনে রাখবেন, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, বৈধ-অবৈধ নাগরিকত্ব নির্বিশেষে আদমশুমারিতে অংশগ্রহণ সব আমেরিকাবাসীর নাগরিক দায়িত্ব। এতে অংশ নিয়ে আপনার এবং আপনার সমাজের উন্নয়ন নিশ্চিত করুন।