ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচন নিয়ে ভুলটা একা আমার ছিল না। আমেরিকার প্রতিটি প্রধান পত্রপত্রিকা বা টিভি পণ্ডিত নিশ্চিতভাবে জানিয়ে দিয়েছিল, হিলারি জিতছেন। নিউইয়র্ক টাইমস ও ওয়াশিংটন পোস্ট অঙ্ক কষে আমাদের জানিয়েছিল, হিলারির জয়ের সম্ভাবনা প্রায় ৯০ শতাংশ। জাতীয় জনমতের জরিপ থেকে তারা সেরকমই আভাস পেয়েছে।
স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে বিদেশি সাংবাদিকদের জন্য বিশেষ ব্রিফিংয়ের ব্যবস্থা হয়েছিল। সেখানে এমন একজনকেও পেলাম না যিনি মনে করেন ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার যোগ্য। নির্বাচনের আগের দিন ফিলাডেলফিয়ায় হিলারি, ওবামা ও বিল ক্লিনটন হাতে হাত ধরে নেচে নিলেন, তাঁদের ‘ভিক্টরি ল্যাপ’ দেখার পর কোনো সন্দেহ থাকল না। দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। আরও নিশ্চিত হলাম যখন হিলারির শিবির থেকে জানানো হলো, নির্বাচনের আগাম ফল ঘোষিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিউইয়র্কের হাডসন নদীতে বিশাল আতশবাজি উৎসবের ব্যবস্থা হয়েছে। মনে মনে প্রস্তুতি নিলাম, এমন ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী থাকতেই হবে।
নির্বাচনের দিন সকালবেলায়ও এই মতের পরিবর্তনের কোনো প্রয়োজন দেখিনি। ঢাকা থেকে গোটা দুই টিভিকর্তা এসেছিলেন, তাঁদের কাছেও আমিও নির্দ্বিধায় বললাম, ট্রাম্পের জেতার প্রশ্ন ওঠে না। আমেরিকানরা রাজনীতির ব্যাপারে কিছুটা নির্বোধ, ফুটবল খেলা ছাড়া অন্য কোনো কিছু এদের মাথায় ঢোকে না। কিন্তু তাই বলে এতটা নির্বোধ নয় যে একজন ‘ক্লাউন’কে দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করবে। নিউইয়র্কে গোটা দুই নির্বাচনী কেন্দ্র ঘুরে এলাম, লম্বা লাইন, অধিকাংশই হিলারির পক্ষে। শহুরে এলাকার বাইরে যে বাতাস ভিন্ন দিকে বইছে, আমাদের জানা ছিল না। বিকেলের দিকে ফোন করল প্রথম আলোর নিউইয়র্ক প্রতিনিধি ইব্রাহীম চৌধুরী খোকন। গলার স্বর শুকনো, আওয়াজ বের হয় না। কী হয়েছে, জানতে চাইলাম। খোকন বলল, ‘হাসান ভাই, আমার তো মনে হয় ডিম ভাজা হয়ে গেছে।’
‘মানে?’ আমি জানতে চাই।
খোকন থাকে নিউ জার্সি, সেটি ডেমোক্রেটিক-প্রধান অঙ্গরাজ্য। কিন্তু সে খবর পেয়েছে, পাশের রাজ্য পেনসিলভানিয়া থেকে। সেখানে শ্বেতপ্রধান এলাকায় লোক হুমড়ি খেয়ে পড়েছে ট্রাম্পের বাক্সে ভোট দিতে।
কথা শুনে রীতিমতো ভয় পেলাম। ইমিগ্রেশন ও মুসলিম তাড়ানো নিয়ে ট্রাম্পের উত্তপ্ত কথাবার্তা যে একদল লোকের মধ্যে প্রভাব ফেলেছে, তার আলামত কিছুটা হলেও পেয়েছিলাম, কিন্তু গুরুত্ব দিইনি। নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘ভাই, কোনো সুস্থ আমেরিকান ট্রাম্পকে কেন ভোট দেবে?’ ভদ্রলোক এককথায় উত্তর দিয়েছিলেন, ‘বর্ণবাদ।’
তাঁর সে কথার অর্থ বিচিত্রভাবে আমার কাছে পৌঁছেছিল। আমি মাঝেমধ্যে একটি ইংরেজি দৈনিকে নির্বাচনী হালচাল নিয়ে কলাম লিখতাম। স্বাভাবিকভাবেই আমার সুর ট্রাম্পবিরোধী ছিল। টেক্সাস থেকে এক আমেরিকান মহিলা সে লেখা পড়ে আমাকে এক লম্বা ই-মেইল করে অভিযোগ করেছিলেন, বাস্তব অবস্থার আমি কিছুই জানি না। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে কথা বলে আমি শুধু বাংলাদেশের জঙ্গিদের খেপিয়ে তুলছি। এরপর যদি সেখানে মার্কিনদের ওপর হামলা হয়, তাহলে সে জন্য আমি দায়ী থাকব। ভদ্রমহিলাকে আমি নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই বিশেষজ্ঞের উত্তর মনে করিয়ে দিয়ে টিপ্পনী কাটলাম, তোমার কথা শুনে মনে হয় তুমিও সেই সব বর্ণবাদীদের একজন, যারা ট্রাম্পের পক্ষে। মহিলা মুহূর্তের মধ্যে জবাব পাঠালেন, ‘তুমি কি জানো আমার স্বামী চমৎকার বাদামি গাত্রবর্ণের একজন বাংলাদেশি?’
তাঁর সে প্রশ্নের জবাব দেওয়ার আমি কোনো প্রয়োজন দেখিনি, নিজের কথাতেই তাঁর পরিচয় পরিষ্কার হয়েছিল।
নির্বাচনের দিন সন্ধ্যায় এক মগ চা নিয়ে বসলাম। তখনো আমার অগাধ বিশ্বাস, ট্রাম্প কিছুতেই জিতবেন না। ভদ্রলোক নিজেই বিশ্বাস করেন না তাঁর পক্ষে জেতা সম্ভব, সে জন্য আগেভাগেই ভোট চুরির কথা বলে নিজের সমর্থকদের তাতিয়ে তুলেছেন। নির্বাচনী ফলাফল দেখতে চায়ের মগ নিয়ে আমার সঙ্গে বসেছিলেন ছোটগল্প লেখক ওয়াসি আহমদ। আয়ওয়ার রাইটার্স ওয়ার্কশপে যোগ দিতে এসে মাস তিনেক মধ্য আমেরিকার সাদা মানুষদের সঙ্গে মেশা ও কথা বলার অভিজ্ঞতা তাঁর হয়েছিল। ট্রাম্পের ব্যাপারে শ্বেতকায়দের মনোভাব তাঁর একদম অজ্ঞাত ছিল না। ফলে নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে তাঁর মনে কিছুটা দোমনা ভাব ছিল। কিন্তু আমার ভাষণের তোড়ে তাঁকে স্বীকার করতে হলো হয়তো আমার হিসাবই ঠিক।
রাত নয়টার দিকে ফলাফল আসা শুরু করল। প্রথম প্রথম আমরা উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো তেমন কারণ দেখিনি, কিন্তু রাত যত গড়ায়, আমাদের মুখে আঁধার এসে ভিড় করে। রাত ১১টার দিকে জানা গেল, হাডসনে আতশবাতির কর্মসূচি বাতিল হয়েছে। তখন আমাদের মাথায় ব্যাপারটা ঢুকল যে খোদ হিলারি নিজেই আর বিশ্বাস করেন না তিনি জিতবেন। মাঝরাতের আগেই ওয়াসি চেয়ার ছেড়ে ঘুমুতে গেলেন। আমি রাত তিনটা পর্যন্ত জেগে রইলাম এই আশায়, যদি ম্যাজিকের মতো কিছু ঘটে, মিশিগান বা উইসকনসিনে যদি হিলারি জিতে যান! হলো না, যে লোকটাকে আমরা নির্বোধ, স্থূল ও অশিক্ষিত বলে হেনস্তা করেছি, শেষ পর্যন্ত তিনিই প্রেসিডেন্ট হয়ে গেলেন।
এমন বড় একটা ভুল হলো কী করে? আমার কথা বলছি না, আমেরিকার বাঘা বাঘা সাংবাদিক ও বিশ্লেষকের কথা বলছি। টাইমস–এর নেট সিলভার গত তিনটি জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল নির্ভুলভাবে আগাম জানাতে পেরেছিলেন। এবার তিনিও ব্যর্থ হলেন। তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারিনি, তবে সময় লাগেনি এ কথা উপলব্ধি করতে যে আসলে নিরপেক্ষ সাংবাদিক থাকার বদলে আমরা অধিকাংশই যার যার দল বেছে নিয়েছিলাম। চোখের সামনে অশনিসংকেত কম ছিল না, সেসব দেখেও না দেখার ভান করেছি। এ দেশে সাংবাদিকদের অধিকাংশই উদারনৈতিক ঘরানার। যাঁরা ভিন্ন ঘরানার, তাঁদের কথা আমরা শুনি না, তাঁদের বিশ্লেষণ আমরা পড়ি না। এ দেশে সবচেয়ে রক্ষণশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল টিভি নেটওয়ার্কের নাম ফক্স নিউজ। কোনো উদারনৈতিক লেখক-সাংবাদিক এই নেটওয়ার্ক দেখার কথা ভাবতেও পারেন না। ফলে, দেশের একাংশ মানুষ, হোন তাঁরা প্রতিক্রিয়াশীল অথবা বর্ণবাদী, তাঁদের কথা আমাদের জানা হয়নি। টেক্সাসের সেই মহিলাই ঠিক বলেছিলেন, দেশের মানুষের ‘পালস’ই আমরা বুঝতে পারিনি।
সাংবাদিকের আনুগত্য কোনো মতাদর্শের কাছে নয়, তাঁর কোনো দলও নেই। মানতেই হচ্ছে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্যই সাংবাদিকতার এই প্রাথমিক পাঠ চোখের জলে নতুন করে শিখতে হলো।