এটা একটা মুহূর্ত, একটা দৈবাৎ ঘটে যাওয়া ঘটনা মাত্র। ডেভ বেইলি নামের এক ভদ্রলোক একটা ম্যাগাজিনের কথা জিজ্ঞেস করাতে কথা গড়িয়ে কোথা থেকে কোথায় গেল! লাগুয়ার্ডিয়া টার্মিনাল ‘বি’তে গেট ডি ফোরে আমরা যথারীতি আগমনী প্লেনের প্রতীক্ষায়। একটা র্যাকে আমেরিকার অনেক নামীদামি ম্যাগাজিন ও পত্রিকা রাখা আছে যাত্রীদের জন্য। বলাই বাহুল্য, এটা আমার প্রিয় কর্নার। আমার কাছে এই সুযোগ অনেকটা বোনাসের মতো। আমার হাতে ‘The Real Deal ‘ ম্যাগাজিনে, অ্যামাজন নিয়ে লেখা প্রচ্ছদ ‘Life After Amazon’। এটার দিকে তাকিয়ে ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, এটা কী বিনে পয়সায় না পে করতে হয়?
- না না সব বিনা মূল্যে। আপনি নিতে পারেন যেগুলো ভালো লাগে।
- সত্যিই তাই! (দ্বিধান্বিত দেখে আমি দু/একটার কথা বললাম)
- আপনি অনেক পড়েন? পড়ি যখন সময় পাই।
- (মার্কেটিং ও বিজনেস স্ট্র্যাটেজি নিয়ে একটা লেখা দেখিয়ে বললাম) এটা পড়েন। অনেক তথ্য আছে।
- এটা পড়ার কারণ কী আপনার? আপনি কী ব্যবসাও করেন? (ভদ্রলোক হেসে জিজ্ঞেস করলেন)
—আমি পাল্টা হাসি দিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম, না। এমবিএ করেছিলাম এ বিষয়ে, তাই একটু আগ্রহ আছে। তা ছাড়া আমি লেখালেখি করি এ জন্যও একটু জানতে হয়।
- কোন দেশের আপনি?
- বাংলাদেশ, বাংলাদেশ! কী লিখি এ সব জেনে, কিছু না বলে তাঁর সঙ্গে রাখা একটা ব্যাগ খুলে আমার সামনে বইয়ের মতো একটা কিছু মেলে ধরলেন, ‘The concert For Bangladesh’ অ্যালবাম। মুখে প্রচ্ছন্ন সুন্দর হাসি। এটা জর্জ হ্যারিসনের রেকর্ড। যেটা ১৯৭১ সালে গৃহহীন বাঙালি শরণার্থীদের সাহায্যের জন্য করা হয়েছে। তখন পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে মানুষজন গৃহহীন হয়ে পড়েছিল ।
কোনো বিদেশির মুখে নিজের দেশের কথা শুনতে যে এত ভালো লাগে তা বোঝানোর মতো না! তাও আবার দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের মতো বিষয়। বন্দী নেতা শেখ মুজিব, ক্ষুধার্ত বাঙালি শরণার্থী। কী অদ্ভুত ও কাকতালীয় বিষয়, আজ ২৬ শে মার্চ! আমার যেন চোখেমুখে ঝিলিক দিয়ে উঠল, কথাগুলো শুনে গায়ে কাঁটাও দিল। আমি বাংলা পত্রিকাগুলোতে বিভিন্ন সময় পড়েছি কিন্তু কারও মুখ থেকে শোনার মর্মার্থ যেন আরেকটু গভীর হলো। ভদ্রলোকের মুখে শুনতে অদ্ভুত লাগছিল। উনি জর্জ হ্যারিসনের সেই সময় রবি শংকরের সঙ্গে মিলে এই অ্যালবাম বের করার কথা এবং এটা যে সে সময় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় লাইভ কনসার্ট ছিল সেটাও বললেন।
আমি শ্রদ্ধায় যেন বিগলিত হলাম, যেন চোখে জল আসে। তাঁকে বললাম যে, এটা সেই দিন যে দিন আমাদের দেশে যুদ্ধ শুরু। এমন না যে যুদ্ধের মাস তাই চিন্তা ভাবনা করে লেখাটা লিখছি। আমার মাথায় এমনিতেই অনেকগুলো বিষয় ছিল এ সপ্তাহের লেখার জন্য। একজন লেখক যখন তাঁর চিন্তাভাবনাগুলো যতক্ষণ কলমের বা আঙুলের ডগায় নিয়ে আসতে না পারেন, চিন্তা মাথা থেকে অক্ষরের আদলে জন্ম দিতে না পারেন, ততক্ষণ এক ধরনের চাপা যন্ত্রণায় থাকেন। এটা লেখক মাত্রই জানেন। আমি অনেক দিন ধরে এ যন্ত্রণার মধ্যে দিয়েই যাচ্ছি। সে সব বন্ধ করে এই নতুন বিষয়টা মাথায় কাজ করছে। ভাবলাম দেশের মানুষকে জানানো উচিত। ভদ্রলোক বাংলাদেশ ও রবি শংকর সম্পর্কে অনেক কিছু জানেন।
আমি রাতে অনলাইনে ঢুকে অনেক ঘাঁটাঘাঁটি করে পড়লাম, একটুও মিথ্যে বললেননি। কী অদ্ভূত ব্যাপার! দেশের সবাই কী আর সব জানে? কতটা জানে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম? রাতে এ ব্যাপারে আগে নিজের মেয়েকে অনেক কিছু বললাম। জর্জের গান শোনালাম। সে মুগ্ধ হয়ে বলল, ‘সত্যিই তাই। অবিশ্বাস্য।’
‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ ১৯৭১ সালের আগস্টের প্রথম দিন, রোববার বেলা ২.৩০ ও ৮.০০ টায় নিউইয়র্ক সিটির ম্যাডিসন গার্ডেনে প্রায় ৪০,০০০ দর্শকের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হয়। সাবেক বিটলস সংগীত দলের লিড গিটারবাদক জর্জ হ্যারিসন ও ভারতীয় সেতারবাদক রবি শংকর মিলে দুটি কনসার্ট করেন। এর মূল কারণ ছিল পূর্ব বাংলার শরণার্থীদের জন্য আন্তর্জাতিক সচেতনতা ও তহবিল সংগ্রহ। মূলত যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের অসহায় মানুষদের সাহায্যের উদ্দেশ্যে এ আয়োজন করা হয়। অর্থ সংগ্রহের দিক দিয়ে এটি ছিল সেরা একটি লাইভ কনসার্ট। লন্ডন থেকে ১৯৭২ সালের বসন্তে এটি চলচ্চিত্রাকারে প্রকাশ করা হয়।