দীর্ঘ পঁচিশ বছর একটানা চাকরি করে আর মাত্র চার দিন পরই অবসরে চলে যাবেন রেজাউর রশীদ। মালিনীছড়া চা বাগানে রেজা সাহেব ছাড়া চাকরিতে এত লম্বা সময় আর কেউ পার করতে পারেনি। টিলা বাবুর চাকরি নিয়ে প্রথমে শুরু করেছিলেন। তারপর পদোন্নতি পেয়ে পেয়ে একেবারে বড় বাবুর পদবিতে এসে এখন অবসর নিতে যাচ্ছেন।
বাগানের ম্যানেজার একদিন ডেকে পাঠালেন রেজাকে। তারপর অনেক অতীতের স্মৃতি রোমন্থন করলেন। একবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা রেজাউর রশীদ অবসর নেওয়ার পর আপনি দিন কাটাবেন কী করে? যদি বাগান থেকে কোনো ধরনের সাহায্যের প্রয়োজন মনে করেন, তবে অবশ্যই আমাকে স্মরণ করবেন।’ রেজা সাহেব স্বভাবসুলভ হেসে বলেন, ‘ধন্যবাদ আপনাকে। তবে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমেরিকায় আমার ছেলের কাছে চলে যাব।’ মা মরা একমাত্র ছেলে রাহাতকে পাঠিয়েছিলেন আমেরিকায় বসবাসরত শ্যালিকার কাছে। ছেলে এখন বউ-বাচ্চা নিয়ে ভালোই আছে। বাবার অবসরের সময় এসেছে জেনে আমেরিকায় যাওয়ার সব ব্যবস্থা করে রেখেছে রাহাত।
রেজাউর রশীদকে বাগানের পরিচর্যার কাজে কখনো গাফিলতি করতে কিংবা কোনো দিন কাজে দেরি করে আসতে দেখা যায়নি। খাকি উর্দির সঙ্গে ফুলপ্যান্ট পরে প্যান্টের বাঁ পায়ের সঙ্গে একটা ক্লিপ আঁটিয়ে বাইসাইকেল চালাতেন রেজা সাহেব, যাতে সাইকেলের চেইনের সঙ্গে প্যান্টটা আটকে না যায়। বাগানের সব ধরনের কাজে ছিল তাঁর দারুণ দক্ষতা। চা বাগানের শ্রমিকদের তত্ত্বাবধান থেকে শুরু করে হিসাবরক্ষণ পর্যন্ত সবকিছুর দেখভাল করতেন।
চব্বিশ বছর আগে যখন তিনি চা বাগানে চাকরি নিয়ে এসেছিলেন, তখন মালিনীছড়া চা বাগানের এতটা প্রসার ছিল না। মাত্র দুজন বাবু ছিলেন তখন। অর্ধেক বাগানে নতুন চারাগাছ ছিল। বাকি অর্ধেকে পূর্ণাঙ্গ চা গাছে চা উৎপাদন হতো। রেজা সাহেবের সঙ্গে সব সময় রঘুরাম সর্দার (শ্রমিকের সর্দার) থাকত। প্রথমে রঘু সর্দারই তাঁকে বাগানের কুটিনাটি কালাকানুন শিখিয়েছে। রঘুরাম তাঁর সঙ্গে আছে বলে এখনো এই বাগানে কোনো ধরনের শ্রমিক সমস্যা দেখা দেয়নি। রেজা সাহেবের অবসরের খবর শুনে রঘুরাম ইদানীং বড় বিমর্ষ হয়ে গেছেন। সময়ে-অসময়ে হাঁড়িয়া টানতে শুরু করেছে সে। কখনো ডুকরে কেঁদে বলে, ‘বাবু তুই কিনো চলি যাবি রে?’ রেজা সাহেব রঘুকে কিছুতেই বোঝাতে পারেন না যে, সব চাকরিতেই একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর অবসরে যেতে হয়। রঘুরাম বলে, ‘হামলোগ ত বুড্ডা হয়ে গেলুম বাবু। হামারার কব্ অবসর হবি?’
রঘুর সঙ্গে আলাপ করে করে একসময় চা ফ্যাক্টরির সামনে আসতেই নতুন চায়ের একটা গন্ধ পেলেন রেজা সাহেব। এই সময়ে ফ্যাক্টরির সামনে দিয়ে আসতে খুবই ভালোবাসেন তিনি। কচি চা পাতার রস নিংড়ে যখন বাক্সবন্দী করার জন্য ফ্যাক্টরিতে স্তূপ করা হয়, তখন হেঁটে যেতে যেতে নাক ভারী হয়ে ওঠে চায়ের মৌ মৌ গন্ধে। রেজা সাহেব যেন এই নেশাতেই কাটিয়ে দিলেন দীর্ঘ পঁচিশটি বছর। অনেক স্মৃতিবিজড়িত এই চা বাগান ছেড়ে যেতে হবে তাঁকে। আর মাত্র কয়েক দিন পরই তাঁকে চলে যেতে হবে—তিনি যেন ভাবতেই পারছেন না। চা বাগানের চাকরিতে যোগ দেওয়ার কয়েক বছর যেতেই তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রীকে হারিয়েছেন। একমাত্র ছেলে রাহাতের বয়স তখন পাঁচ বছর। ছেলেকে নিয়ে একাই কাটিয়েছেন এতটা বছর। দ্বিতীয় বিয়ের চিন্তা করেননি কখনো। এসব ভাবনায় ভারাক্রান্ত মনে তিনি হেঁটে চলেছেন নুড়ি বিছানো মালিনীছড়া চা বাগানের রাস্তা দিয়ে। সাদা ধুতি পরা খালি গায়ে একটা লাঠির সঙ্গে ব্যাগ ঝুলিয়ে পিছু পিছু হাঁটছে রঘু সর্দার। খণ্ডিত চাঁদের আবছায়া আলোর লুকোচুরি, মাঝেমধ্যে ঝিঁঝির ডাক করাত চালানোর মতো শব্দ করে যাচ্ছে। কেমন যেন সুনসান নীরবতায় ছেয়ে গেছে পুরো বাগান। মাঝেমধ্যে টর্চ জ্বেলে রাস্তা দেখিয়ে দিচ্ছে রঘু সর্দার।
প্রায় দেড় মাইল লম্বা এই রাস্তার দু-ধারে ঘন চা গাছ, আর ছায়া বৃক্ষ। সন্ধ্যার পর এ রাস্তা দিয়ে সচরাচর কেউ যায় না। এ সময় ছায়া বৃক্ষের আড়াল থেকে হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ে কে যেন রেজা সাহেবের পা দুটি জড়িয়ে ধরল। তিনি সাপ মনে করে চিৎকার করে হ্যাঁ, হ্যাঁ শব্দ করে উঠলেন। রঘুকে উঁচু স্বরে ডেকে অসহায় দৃষ্টিতে রঘুর দিকে তাকিয়ে রইলেন। তৎক্ষণাৎ রঘু তাঁর হাতের টর্চলাইট জ্বেলে হলুদ দুপাটি দাঁত বের করে হাসি দিয়ে বলল, ‘বাবু এ লাড়কি তো চামেলি আছে। বহুত কমিনা লাড়কি হে বাবু। এই ওঠ ওঠ বলছি।’
পা ছেড়ে চামেলি উঠে দাঁড়ায়। তারপর বলে, ‘তু কাঁহা যাতা হায় রে বাবু?’ শক্ত ধারালো চোয়াল। তামাটে গায়ের রং। কাজল কালো চুল। খালি গায়ে কোনো রকমে জড়ানো শাড়িপরা কুচকুচে কালো আঙুলে এতক্ষণ রেজা সাহেবের পা জড়িয়ে ধরেছিল। রঘু সর্দার এসে মেয়েটাকে ছাড়িয়ে নিল। চামেলি উঠে দাঁড়ায়। বৃত্তের মতো চোখ দুটোতে রক্তিম আভা ক্রোধের পূর্বাভাস না কি তা পানের আসক্তিজনিত বোঝা গেল না। তিনি ক্ষণিক তাকিয়ে দেখলেন। তারপর ভাবতে লাগলেন মেয়েটাকে বাগানের কোথায় দেখেছেন। এক সময় হুবহু মনে পড়ে গেল, একদিন রঘুরামের বউ ওই মেয়েটার বিরুদ্ধে নালিশ করেছিল রেজা সাহেবের কাছে যে, ওই বেগানা আওরত তার স্বামীকে নষ্ট করে দিচ্ছে। কথাটা চামেলির কানে যেতেই তার নাকে পেতলের ফুলটা নেচে উঠে একটু চমকদার হলো। তারপর কোমরে দুহাত রেখে মুখভর্তি থুতু ছড়িয়েছিল রঘুর বউয়ের সামনে। তারপর চিৎকার করে বলেছিল, ‘রঘুর প্রতি তার কোনো খায়েশ নেই। আর থাকবেই বা কেন? ও তো একটা ভাদাইম্যা। না আছে টাকা-পয়সা, না আছে তাকত। তা ছাড়া কত তাকতওয়ালা আদমি ওর পেছনে ঘুরঘুর করে।’ রঘুর মতো তেলাপোকার দিকে তাকাবার সময় কোথায়? চামেলির অঙ্গভঙ্গি আর আঁটসাঁট করে শাড়ি পরার কায়দা দেখে মুহূর্তেই সেই ছবিটা মনে পড়ে গেল তাঁর।
মেয়েদের এক-একটা ভঙ্গি আছে, সময় যাকে কেড়ে নিতে পারে না। বিশেষ কোনো মুহূর্তে নিজের অজান্তেই সেগুলো ফিরে আসে তাদের শরীরে। একটা বিশেষ অভিমান দীর্ঘ সময় ধরে তাদের মধ্যে সুপ্ত থাকে, যা কোনো পুরুষ মানুষ লালন করতে পারে না। কবে কোন যৌবনে রঘুর প্রতি ওর যে অহংকার বা ঘৃণা মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল, এখন এত দিন পর নেশার চূড়ান্ত মুহূর্তে যেন সেগুলো ফিরে পেল চামেলি।
ভাবনার খেই হারিয়ে নিজই হেসে উঠলেন রেজা সাহেব। আবার হাঁটতে লাগলেন। রঘু সর্দার মাথা নিচু করে পেছনে পেছনে হাঁটছে। দূরে মিটমিটে আলোতে ফ্যাক্টরির হলদে রঙের আভা ছড়িয়ে পড়ে শুকনো নালার ধারে থরে থরে লাগানো চা গাছের ওপরে। মনে হচ্ছে, কোনো আনাড়ি হাতে তোলা ছবি। দু পাশের চা গাছের মধ্য দিয়ে অন্ধকার রাস্তা ধরে হাঁটছেন ওরা। রঘু টর্চ জ্বালিয়ে রাস্তা দেখাচ্ছে। হঠাৎ দারুণ এক সুগন্ধ পেলেন সামনে যেতে যেতে। রঘুর হাতের টর্চলাইটের আলোতে দেখলেন দুর্লভ ম্যাগনলিকে। অসাধারণ নামে ও চেহারায় সুমিষ্ট ঘ্রাণের আবেশ। রেজা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তিনি আশ্চর্য হলেন, এত দিন এই বাগানে আছেন তিনি। একদিনও এর দেখা মেলেনি। সাতপাঁচ ভাবছেন, আর তাতেই চলে গেলেন অতীত রোমন্থনে।
স্ত্রী মারা গেলেন যখন, তখন তাঁর মধ্য যৌবন। এই চা বাগানেই ভীষণ একাকী পার করে দিলেন এতটা বছর। কী আশ্চর্য, এই মালনীছড়া চা বাগানে তাঁর শিকড়গুলো কত গভীরে চলে গেছে! নিজের কথাই মনে করার সুযোগ মেলেনি তাঁর। ছায়া বৃক্ষগুলো ঠায় দাঁড়িয়ে চা গাছের কচি পাতায় ছায়া দিয়ে পাতাগুলোকে সজীব করে তোলে। এখন মনে হচ্ছে তাঁর চারপাশে কোনো দেয়াল নেই। হাত বাড়ালেই খোলা আকাশ। একমাত্র ছেলে, সেও দেশের বাইরে। এখন আর দুটো সরল কথা বলার সম্পর্ক নেই কারও সঙ্গে। বড় মেয়ে বিধবা হয়েছে দীর্ঘদিন। সেও তার মতো থাকে। ভাবতে আজ বড় কষ্ট হচ্ছে তাঁর।
ভারী দেহটা টেনে টেনে চা বাগানের রাস্তা ছেড়ে কোয়ার্টারের সামনে এলেন রেজা সাহেব। টর্চের আলো ফেলতে ফেলতে হঠাৎ আঁতকে ওঠেন তিনি। দেখলেন, বিরাট একটা অশরীরী আত্মা সারা গায়ে টর্চের আলো মেখে প্রচণ্ড বেগে ছুটে আসছে তাঁর দিকে। সব আলো নিভে গেল মুহূর্তেই। ঘন অন্ধকারে দাঁড়িয়ে তাঁর সারা শরীর কাঁটা দিয়ে উঠল। হিম হিম বাতাসে ভীষণ শীত অনুভূত হলো যেন। দুহাত বাড়িয়ে নিজের দেহের সঙ্গে বিশাল আত্মার নরম শরীরটাকে অজান্তেই লুফে নিয়ে গাঢ় মমতায় তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কে?’ উত্তর এল, ‘আমি করোনাভাইরাস। তোমার স্ত্রীর কাছে তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি।’
রেজা সাহেবের গোঙানির শব্দ শুনে টর্চের আলো ফেলতে ফেলতে ছুটে এল রঘু। সঙ্গে তাঁর স্ত্রী। তারা দেখে, বাবু জ্ঞান হারিয়ে নিথর দেহে কোয়ার্টারের সামনেই পড়ে আছেন। রঘু তার স্ত্রীকে নিয়ে তাঁকে পাঁজাকোলা করে ঘরে নিয়ে গেল। কখন যে ভোর হয়ে গেল রেজা টেরই পেলেন না। বাতাবি লেবুর গাছে বসে একটা দাঁড়কাক করুণ গলায় ডাক শুরু করে দিল। দূর থেকে অনেক লোকের শোরগোল কানে আসছিল। মনে হচ্ছিল, ফুটবল খেলার মাঠেও এত ভিড় হয় না। কিন্তু কী আশ্চর্য, একটা লোকও তাঁর কাছে আসছে না। একটু একটু করে পুবের আকাশ ফরসা হয়ে আসছে।
তখনই রেজা ভাবলেন, তাঁর সারা শরীরে কে যেন পেরেক ঠুকে দিয়েছে। সমস্ত শরীরে ভীষণ যন্ত্রণা। প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। ক্রমশ অস্বচ্ছ হয়ে আসছে ভোরের আলো। প্রাণপণে চোখ খোলার চেষ্টা করছেন তিনি। তাঁর সমস্ত শরীর কথা বলতে চাইছে, কিন্তু পারছে না। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে শ্বাস নিতে চেষ্টা করলেন রেজা সাহেব। শেষ পর্যন্ত হেরে গেলেন।