আমেরিকার শিশু হাসপাতাল

কপালে থাকলে যা হয় আরকি! আমার মেয়েটা এমনিতে অনেক সাবধানী স্বভাবের। বেশি দৌড়-ঝাঁপ করে না; কোনো কিছু সহজে ভাঙেও না। কিন্তু কয়েক দিন আগে টেবিলের ওপরে ফলের ঝুড়ি থেকে আপেল আনার জন্য হাই চেয়ারে উঠেছিল। তারপর পা পিছলে পড়ে যায় নিচে। কার্পেটের ওপর পড়ায় তেমন ব্যথা পায়নি। তবে বেকায়দাভাবে পড়েছিল বলে বাম হাতের কনুইয়ের জায়গাটা ফোলা ফোলা লাগছিল। তখনই কুইন্স হসপিটালের জরুরি বিভাগে নিয়ে গেলাম। চিকিৎসক প্রথমে ঘটনা শুনলেন। তারপর এক্স-রে করে বললেন, ‘থ্যাংকস গড; তেমন বড় রকমের কিছু হয়নি। তবে হাতটা মচকে গেছে।’
হালকা ব্যান্ডেজ দিয়ে বললেন, নড়াচড়া না করতে; কয়েক দিন পরই ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ওর হাতের থেকে ওর বাবার চেহারা দেখে লেডি ডাক্তার বোধ হয় বেশি ভয় পেয়েছিলেন। তিনি তখন আমাদের নিকটবর্তী হাসপাতাল লং আইল্যান্ডের নর্থঅয়েলে পেডিয়াট্রিক বিভাগে রেফার করলেন।
আমার বর গাড়ি ড্রাইভ করে গেল; আর আমি জোহার (আমার মেয়ে) সঙ্গে অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে গেলাম। অ্যাম্বুলেন্সের তিনজন কর্মী আমার সঙ্গে ছিলেন। তাঁরা যেমন হ্যান্ডসাম, তেমনি দায়িত্বশীল। প্রথমে আমাকে বসিয়ে সিটবেল্ট বেঁধে দিলেন। তারপর জোহার প্রেশার, হার্টবিট যাবতীয় সবকিছু লিখছেন, আর খেয়াল করছেন ওর দিকে। যখন হাসপাতালে ঢুকলাম, বাচ্চাকে রিসিভ করার জন্য সবাই দৌড়ে এল। এ যেন আরেক মিনি শিশু পার্ক। যে রুমটাতে ওকে নিয়ে গেল, সেখানে বড় স্ক্রিনে কার্টুন চলছিল। প্রথমে একজন চিকিৎসক এসে জোহার সামনে নাচতে নাচতে রুমে ঢুকলেন। তারপর আরেকজন এসে বেবিদের মতো কথা বলতে লাগলেন। আরেকজন মিকিমাউস সেজে এসেছেন; সে কী কাণ্ড! জোহা হয়তো ভাবছে, সে ভুলে ডিজনিল্যান্ডে চলে এসেছে।
একে একে প্রায় সাত-আটজন এলেন এবং সবাই নানা ভঙ্গিমায় জোহাকে হাসাতে লাগলেন। আরেকজন এলেন আল্ট্রা সোনোগ্রাম মেশিন নিয়ে এবং সেই মেশিনকে তিনি পুরো কার্টুন ছবি বানিয়ে ফেললেন। জোহা একদম কার্টুনের রাজ্যে চলে গেল এবং হাসতে হাসতে হাতের ব্যথাই ভুলে গিয়েছিল।
আপেল গাছের নিচে না বসলে যেমন নিউটন মাধ্যাকর্ষণ শক্তি আবিষ্কার করতে পারতেন না। ঠিক আমিও তেমনি জোহা আপেল খেতে গিয়ে হাত না মচকালে বুঝতেই পারতাম না বাচ্চাদের হাসপাতালে এত আনন্দ থাকে! তারপর এক্স-রে করতে নিয়ে যাওয়ার সময়ও অনেক মজা হলো। উদ্দেশ্য, জোহা যেন এক্স-রে মেশিনকে ভয় না পায়। সবশেষে যিনি এলেন ব্যান্ডেজ করাতে, তিনি জোহাকে প্রথমে ব্যান্ডেজের রং পছন্দ করতে বললেন। জোহা খুশিতে হাসতে হাসতে বলছে, ‘আমি পিংক কালার নেব।’ আমি শুধু অবাক হয়ে দেখছি, আর ভাবছি, এরা কি মানুষ নাকি অন্য গ্রহ থেকে আসা এলিয়েন, নাকি অন্য কিছু?
আসলে মানুষকে হাসাতে মানুষই পারে, যেমন পারে কাঁদাতে। ভাবছিলাম দেশের কথা। আমাদের দেশে ভুল চিকিৎসার কারণে কখনো কখনো বাচ্চা মারা যায়। আবার জন্মের সময়ও প্রসূতি বা বাচ্চা মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটে। অনেক সময় এর পেছনে থাকে চিকিৎসকের গাফিলতি। মনে হয়, এরাও তো মানুষ। তাহলে মানুষে মানুষে এত পার্থক্য হয় কী করে?
ভোরে বাসায় ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম আসলে স্বর্গ-নরক দেখার জন্য বেশি দূরে যেতে হয় না, এখানের বাচ্চাদের হাসপাতালগুলোতে গেলেই হয়। ভাবতে ভাবতে ভোর হয়ে যায়। চারদিকে সাদা শুভ্র তুষার। খুব পবিত্র লাগছিল। মনটাই ভালো হয়ে গেল। রাত জাগার ক্লান্তি যেন সব ভুলে গেলাম। সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞতা জানালাম মেয়েটির জন্য, আর এত সুন্দর প্রকৃতি উপহার দেওয়ার জন্য। বরকে বললাম, ‘গাড়ি থামাও; একটা সেলফি না তুললেই যে নয়!’