ঢাকা থেকে সিলেট যাব বলে পারাবত ট্রেনে চেপে বসলাম। সময়টা আমাদের বিয়ের ঠিক পরপর। আমরা যাত্রী চারজন। আমি, আমার কর্তা, খালাতো বোন ও তার স্বামী। ননদের স্বামীর পোস্টিং ছিল ৬০ মেগাওয়াট শিকলবাহা পাওয়ার স্টেশনে। আমরা নীলফামারী থেকে ঢাকা হয়ে সুনামগঞ্জ যাচ্ছি। পরে আবার চট্টগ্রাম, শিকলবাহা, কক্সবাজার যাওয়ার পরিকল্পনা আছে।
ঝকঝকে সুন্দর আন্তনগর রেল। টিকিট অনুযায়ী আসন খুঁজে নিতে সময় লাগল না। আমরা একটু আগেভাগেই চলে এসেছিলাম। কিছুক্ষণ পর অন্য সহযাত্রীরা আসতে শুরু করল। আর আমাদের পাশে যারা এসে বসলেন, তাদের দেখে আমাদের চোখ কপালে ঠেকার অবস্থা। হুমায়ূন আহমেদ, গুলতেকিন আহমেদ, বিপাশা, শিলা আর নোভা আমাদের বগিতে এসে বসেছেন! আছেন ওবায়দুল ইসলাম আর তার মেয়ে দীপা ইসলাম। তখনো নুহাশের জন্ম হয়নি। আমাদের পাশেই তাদের আসন।
যথা সময়ে ট্রেন সিলেটের উদ্দেশ্যে রওনা হলো। বাইরে ঝকঝকে রোদ। কিছুক্ষণ পর দুটি স্যুটকেসের ওপর একটা বোর্ড পেতে কার্ড খেলার আয়োজন হলো। তখনই হাসিমুখে কথা বললেন ওবায়দুল ইসলাম। তিনি তখন বাংলা একাডেমির পরিচালক ছিলেন। ‘অয়োময়’ ধারাবাহিক নাটকে কমলা চরিত্রে তখন দীপা অভিনয় করছিল। শিলা, নোভা, বিপাশারা যার যার ছোট ব্যাকপ্যাক গুছিয়ে বসেছে। গুলতেকিন খুব অল্পবয়সী, মেয়েদের বন্ধুর মতোই লাগছে। হুমায়ূন আহমেদ কিন্তু কার্ড খেললেন না। তিনি কোনায় জানালার পাশের আসনে বেশ গাম্ভীর্য নিয়ে বসে রইলেন।
হুমায়ূন–দর্শন এটা আমার প্রথম নয়। প্রথম তাঁকে দেখেছি রোকেয়া হলের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় ‘ধারাবাহিক গল্প বলা’ অনুষ্ঠানে। গল্পের মুখটা বলে দিয়ে আসলেন। গল্পের নায়ক আনিস। বক্তারা গল্প চালিয়ে কিছু দূর টানতে না টানতেই এক প্রতিযোগী কাঁচপুর ব্রিজে গাড়িচাপা দিয়ে আনিসকে মেরে ফেলল। অনুষ্ঠানের শেষে বিচারকমণ্ডলীর রায় ঘোষণার আগে তিনি বলেছিলেন, তিনি খুব মর্মাহত হয়েছেন। ধারাবাহিক গল্পের মূল লক্ষ্য হলো ধারাবাহিকতা। গল্পকে টেনে নিয়ে যাওয়া। শুরুতেই নায়কের মৃত্যু কোনোভাবেই কাম্য নয়। আনিস নামের তরুণকে পেয়ে তরুণীরা তাকে কতটা স্বপ্ন দেখাতে পারে, সেটাই তিনি দেখতে চেয়েছিলেন। তবে প্রচণ্ড বুদ্ধিমত্তা দিয়ে আগের বক্তার নায়কের মৃত্যু ঘটানোকে ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন বললেন যে পরবর্তী বক্তা, তাকেই গল্পের টার্নিং পয়েন্ট বললেন হুমায়ূন আহমেদ। আমাদের সিলেটের রোকেয়া খাতুন রুবি ছিলেন সেই টার্নিং পয়েন্টের বক্তা। আর তিনিই প্রথম হয়েছিলেন।
একজন হুমায়ূন আহমেদ যে কিনা কোনো গায়ক নন, নায়ক নন, বাচনভঙ্গি তত আকর্ষণীয় নয়, দেখতেও আহামরি সুদর্শনও নন। কিন্তু মিলনায়তন ভর্তি মেয়েরা পিনপতন নীরবতায় একজন হুমায়ূন আহমদকেই শুনছিল।
পারাবত ট্রেন যখন আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে চা বাগানের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। দুপাশে গাঢ় সবুজ দীর্ঘ ছায়াবৃক্ষ ঢাকা ছোট ছোট চায়ের গাছ। হুমায়ূন আহমেদ যেন ভারী কাচের ভেতর দিয়ে চা গাছের সেই সৌন্দর্যকে নিজের ভেতর নিয়ে নিচ্ছিলেন। হুমায়ূন আহমেদ যেন জানালার পাশে বসে বাইরের দৃশ্য মনের মানসপটে এঁকে নিচ্ছেন।
চমৎকার ছিল সেই রেলভ্রমণ। গল্পচ্ছলে জানলাম, তাঁদের গন্তব্যও সুনামগঞ্জ। সুনামগঞ্জে ভরা বর্ষার যে সৌন্দর্য, তা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। সুরমায় পাহাড়ি ঢল নামলে শহরে বন্যার পানি ঢুকে যায়। নদী আর হাওরের জল মিলেমিশে এক বিশাল জলরাশি। শ্রাবণের পূর্ণিমা রাতে গোলাকার চাঁদ ওঠে আকাশে। আর সেই চাঁদের ছায়া পড়ে জলের বুকেও। আকাশে এক চাঁদ, জলে আরেক এক চাঁদ!
আসমান ভাঙা এমন জোছনা কে, কবে দেখেছে কোথায়। তাই তো চাঁদনি রাত দেখতে সপরিবারে সুনামগঞ্জ যাচ্ছেন হুমায়ূন।
জীবনে কত রেলযাত্রা করতে হয়েছে। দেশে, বিদেশে। পারাবত ট্রেনে করে কতবার পারাপার হয়েছি সিলেট-ঢাকা। কিন্তু আমাদের সেই রেলযাত্রা আলাদাভাবে স্মরণীয় হয়ে রইল হুমায়ূন পরিবারকে সহযাত্রী হিসেবে পাওয়ায়। ১৩ নভেম্বর ছিল তাঁর ৭০তম জন্মদিন। এদিনে তাঁকে স্মরণ করি বিনম্র শ্রদ্ধায়।