যুক্তরাষ্ট্রে স্কুলে গুলি

আবার প্রাণহানি, আবার বিতর্ক

বন্দুকধারীর গুলিতে ১৪ শিক্ষার্থী ও এক শিক্ষক নিহত হয়েছে। টেক্সাস, যুক্তরাষ্ট্র
ছবি: রয়টার্স

১০ দিনের মাথায় আবারও বন্দুক হামলায় রক্ত ঝরল যুক্তরাষ্ট্রে। স্থানীয় সময় গতকাল মঙ্গলবার টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের একটি এলিমেন্টারি বিদ্যালয়ে গুলিতে ১৯ শিশুশিক্ষার্থী এবং ২ শিক্ষক নিহত হয়েছেন। যেসব অঙ্গরাজ্য ব্যক্তিগত পর্যায়ে আগ্নেয়াস্ত্র রাখাকে সমর্থন করে, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম টেক্সাস। ফলে এই হামলার পর অস্ত্রের সর্বব্যাপী বিস্তার রোধে বা আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণে মার্কিন রাজনীতিকদের ওপর চাপ বাড়ছে।

যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুকধারীদের সহিংসতা রোধে কাজ করা সংগঠন এভরিটাউনের দেওয়া তথ্য অনুসারে, চলতি বছরে নির্বিচার বেশ কয়েকটি গুলির ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে আটটি বড় ঘটনা। সর্বশেষ দিন দশেক আগে নিউইয়র্কে একটি সুপারমার্কেট শ্বেতাঙ্গ তরুণের এলোপাতাড়ি বন্দুক হামলায় ১০ জন নিহত হন, যাঁরা সবাই আফ্রিকান বংশোদ্ভূত।

টেক্সাসের এই ঘটনা অতীতের বড় দুটি ঘটনাকে সামনে এনেছে। এর আগে ২০১২ সালে কানেটিকাটে একটি স্কুলে হামলা চালানো হয়। ওই হামলায় ২০ শিশুসহ ২৬ জন নিহত হয়। নিহত ওই শিশুদের বয়স ছিল ৫ থেকে ১০ বছরের মধ্যে। এ ছাড়া ২০১৮ সালে ফ্লোরিডার একটি স্কুলে হামলার ঘটনা ঘটে। ওই হামলায় ১৭ শিক্ষার্থী ও শিক্ষক নিহত হয়। ওই হামলার পর সবচেয়ে বেশি শিশু নিহত হলো গতকালের হামলায়।

টেক্সাস পুলিশ জানিয়েছে, ইউভালদের রব এলিমেন্টারি স্কুলে ঢুকে এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে ১৯ শিশুসহ ২১ জনকে হত্যা করেন সালভাদর রামোস (১৮)। পালিয়ে যাওয়ার আগে পুলিশের গুলিতে তিনি নিহত হন। ওই হামলা চালানোর আগে রামোস দাদিকে গুলি করেন। তবে তিনি বেঁচে গেছেন। যুক্তরাষ্ট্রে যেসব শিশু এলিমেন্টারি পর্যায়ে পড়ে, তাদের বয়স ৭ থেকে ১০ বছর।

টেক্সাসে স্কুলে গুলির ঘটনার প্রেক্ষাপটে আজ বুধবার হোয়াইট হাউস থেকে আবেগঘন বক্তব্য দিয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তিনি বলেন, অনেক মা-বাবাই আর তাঁদের সন্তানকে দেখতে পাবেন না। নিহত শিশু কখনোই আর তাদের মা-বাবাকে জড়িয়ে ধরবে না। সন্তান হারানো এই মা-বাবারা আর আগের মতো থাকবেন না। তিনি আরও বলেন, ‘প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আরেকটি বেপরোয়া হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটল।

দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ শ্রেণিতে পড়া ফুটফুটে, সুন্দর সব শিশু মারা গেল। এসব ঘটনায় আমি ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত। আমাদের এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে।’

যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় মঙ্গলবার টেক্সাসের একটি স্কুলে গুলিতে ২১ জন নিহত হয়েছে

যদিও যুক্তরাষ্ট্রে স্বয়ংক্রিয় ও আধা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের দাম তুলনামূলক কম। ৫০০ ডলারে কেনা যায় স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র। আর আধা স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র কিনতে গুনতে হয় ২০০ ডলার। অন্যান্য অস্ত্রের তুলনায় দেশজুড়ে এই অস্ত্র অপেক্ষাকৃত সহজলভ্য। কিন্তু মঙ্গলবারের এই ঘটনার মধ্য দিয়ে বন্দুক, জননিরাপত্তা ও মানবাধিকারের মতো ইস্যুগুলো আবারও সামনে এসেছে। এসব নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা আরও জোরালো হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের অস্ত্র বহনের অধিকারের পক্ষের প্রধান লবিং গ্রুপ ন্যাশনাল রাইফেল অ্যাসোসিয়েশনের (এনআরএ) বার্ষিক সম্মেলনকে কেন্দ্র করে। চলতি সপ্তাহে ছুটির দিনে এই টেক্সাসেই ওই সম্মেলন হবে।

এই সম্মেলনে বক্তব্য দেওয়ার কথা রয়েছে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, টেক্সাসের গভর্নর গ্রেগ অ্যাবোট, টেক্সাসের সিনেটর টেড ক্রুজসহ গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিকদের।

এদিকে টেক্সাসে গুলির ঘটনাকে কেন্দ্র করে কানেটিকাটের সিনেটর ক্রিস মারফিও আবেগঘন বক্তব্য দিয়েছেন। ডেমোক্র্যাটদের এই সিনেটর বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া এমন ঘটনা কোথাও ঘটে না।’

তবে এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন রিপাবলিকান সিনেটর টেড ক্রুজ। তিনি বলেন, যখনই কোনো অপরাধ সংঘটিত হয়, তখনই তার রাজনীতিকরণ করা হয়। আগ্নেয়াস্ত্র সংক্রান্ত আইন সংশোধন করে এ ধরনের অপরাধ কমানো সম্ভব নয় বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি।

যদিও পরিসংখ্যান ভিন্ন কথা বলছে। গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের রোগনিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ সংস্থা (সিডিসি) জানিয়েছে, ২০২০ সালে বন্দুকধারীর হামলা ব্যাপক হারে বেড়েছে। বন্দুকধারীর হামলায় হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ১৯ হাজারের বেশি, যা ২০১৯ সালের তুলনায় ৩৫ শতাংশ বেশি। এ ছাড়া নির্বিচার হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও বেড়েছে।

একবিংশ শতকে এসে যুক্তরাষ্ট্রে মানুষের মধ্যে বন্দুক রাখার হারও বেড়েছে। ২০০০ সাল থেকে পরবর্তী ২০ বছরে ১৩ কোটি ডলারের আগ্নেয়াস্ত্র তৈরি করেছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো। এ সময় ৭ কোটি ডলার আগ্নেয়াস্ত্র আমদানি করেছে তারা। এর মধ্যে আধুনিক স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে ৯ মিলিমিটার পিস্তল, রয়েছে আধা স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রও। অর্থাৎ অস্ত্রের সহজলভ্যতা যত বেড়েছে, তত বেড়েছে বন্দুকধারীর হামলার ঘটনা।

যদিও মার্কিনরা আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইনের পক্ষে। গত বছর পিউ রিসার্চ সেন্টারের জনমত জরিপে বলা হয়েছে, ৫৩ শতাংশ মার্কিন চান আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইন হোক। আর ৪৯ শতাংশ মানুষ মনে করে, কঠোর আইন হলে নির্বিচার গুলির ঘটনা কমে আসবে।

হামলায় হতাহত শিক্ষার্থীদের স্বজনদের আহাজারি

কিন্তু রাজনীতিকেরা হেঁটেছেন উল্টো পথে। যে অঙ্গরাজ্যে মঙ্গলবার গুলির ঘটনা ঘটল, সেই টেক্সাসে গত বছর নতুন আইন পাস হয়েছে। অঙ্গরাজ্যের নতুন আইন অনুসারে, কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ বা লাইসেন্স ছাড়া ১৮ বছর বয়সী তরুণ বা তরুণী আগ্নেয়াস্ত্র রাখতে পারবে।

আর বিষয়টি সামনে এনেছে মমস ডিমান্ড নামের একটি সংগঠন। জননিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা শ্যানন ওয়াটস বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় অস্ত্রের বাজার হলো টেক্সাস। আবার এই রাজ্যেই আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে হামলার ঘটনাও বেশি।