বাংলাদেশে একের পর এক নতুন নতুন জেলায় ছড়িয়ে পড়ছে করোনাভাইরাস। দেশ এখন করোনাভাইরাস সংক্রমণের চতুর্থ স্তরে। সামাজিক ট্রান্সমিশন ঘটেছে। এই ভাইরাস ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে ছড়িয়ে পড়ছে। অল্প কয়েক দিনে নিশ্চিত সংক্রমণের সংখ্যা খুব দ্রুত হাজারের সংখ্যা পেরিয়ে গেল। এ পর্যন্ত যে কয়েকজন সুস্থ হয়েছেন তার চেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষ মারা গেছেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, টেস্টের পরিধি বাড়ালে সংক্রমিত মানুষের সংখ্যা বা হিসাব ভিন্ন ধরনের হতো। দিনে দিনে পরীক্ষা যত বাড়ছে, তত বেশি আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হচ্ছে। শুধু বাংলাদেশ নয় গোটা পৃথিবী স্থবির। অঘোষিত লকডাউনে মানুষের কষ্ট হচ্ছে অস্বীকার করার উপায় নেই। ক্ষতি হচ্ছে সব ক্ষেত্রের। এই পরিস্থিতি কবে নাগাদ শেষ হবে তা বলা আসলেই মানুষের ধারণার বাইরে। আমরা এও জানি, সংক্রমণ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়লে আমাদের যে প্রস্তুতি তা দিয়ে চিকিৎসা সেবা চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব। এ পর্যায়েই চিকিৎসক, নার্স, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রায় শতাধিক মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন।
প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানে উন্নত বিশ্ব বিশেষত, আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, স্পেন, ইতালি, চীন, রাশিয়া যেখানে পরিস্থিতির সামাল দিতে নাকানি-চুবানি খাচ্ছে, সেখানে আমাদের মতো স্বল্পোন্নত দেশগুলোর অবস্থা কী হতে পারে সেটা ভাবলেই গা শিউরে ওঠে। দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ইকুয়েডরের চিত্র—সেখানে রাস্তা-ঘাটে মরে পড়ে আছে মানুষ। ছোঁয়া তো দূরে থাক, কেউ ফিরেও দেখছে না। সেনাবাহিনীকে সেই লাশগুলো সরাতে হচ্ছে। অথচ ওয়ার্ল্ডোমিটারের সর্বশেষ তথ্যমতে, ইকুয়েডরে মোট আক্রান্ত ৭৫২৯ জন এবং ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ৩৫৫ জনের। ৩৫৫ জন যদি মৃত হয় তো এত অল্পসংখ্যক মানুষের লাশ রাস্তায় মরে পচে থাকার কথা নয়। আসলে সংক্রমণ ও মৃত্যুর প্রকৃত সংখ্যা জানা সম্ভব হচ্ছে না। বাস্তবতা এমনই। পরিস্থিতির ভয়াবহতার কারণে স্বাস্থ্য খাতে দুর্বল দেশগুলো না পারবে রোগী শনাক্ত করতে, না পারবে আক্রান্ত ও মৃত মানুষের হিসাব দিতে। উন্নত বিশ্ব কী পারছে? না, তারাও পারেনি। ইতালির রাস্তায় পড়ে থাকা লাশের ছবিও গণমাধ্যমে এসেছে। আমাদের দেশেও কিন্তু এমন চিত্র দেখা যাচ্ছে। সংখ্যায় একেবারে হাতেগোনা হলেও লাশ দেখছে না কেউ, ধরছে না, কেউ আসছে না। নারায়ণগঞ্জে সংগীতজগতের আলোচিত মুখ গিটারিস্ট হিরো লিসানের মৃত্যুর পর কয়েক ঘণ্টা লাশ পড়ে থাকল বাড়ির সামনে। প্রতিবেশী, পথচারী দূরে থাক পরিবারের মানুষই এগিয়ে আসেনি।
সরকার দফায় দফায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে মানুষকে ঘরে থাকার আহ্বান জানালেও ঘরে থাকছে না মানুষ। এক শ্রেণির মানুষ হয়তো পেটের দায়ে ঘর ছাড়ছেন, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে এমন মানুষের সংখ্যা রাস্তায় কম। অনেকেই চায়ের স্টলে আড্ডা দিচ্ছেন, ঘুরে বেড়াচ্ছেন নিতান্ত শখের বশে। বাজারে জট পাকানো মানুষ। রাস্তায় মানুষ। করোনাভাইরাস তো ওনারা দেখেননি সুতরাং ভয় পাওয়ার কী আছে মনে করে সবাই আছেন আগের মতোই। অনেক জায়গায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে চলছে লুকোচুরি খেলা। একটু গা ঢাকা দিয়ে আবার যেই সেই। কিছুটা আক্ষেপ থেকেই হয়তো র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) বিদায়ী মহাপরিচালক (ডিজি) ও পুলিশের নবনিযুক্ত মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ বলেছেন, ‘ঘরে থাকবেন, না-কি কবরে থাকবেন, এই সিদ্ধান্তটা আপনার।’
ঘরে থাকার কথা কিন্তু সেই প্রথম থেকেই সংবাদমাধ্যম ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রচারিত হচ্ছে। মসজিদে নামাজের জামাত সংক্ষিপ্ত পরিসরে করার ঘোষণা ঢাকার বায়তুল মোকাররমসহ দেশের বড় বড় মসজিদ, পাড়া-মহল্লার ছোট ছোট মসজিদগুলো মেনে চলছে। যেখানে হাজার হাজার মানুষ ইবাদতের জন্য সমবেত হতো, সেখানে জুম্মায় মাত্র দশজন মানুষ নিয়ে জামাত অনুষ্ঠিত হলেও বাজার, অলিগলি, চায়ের স্টলে কিন্তু মানুষের কমতি নেই। দেশের সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঝুলছে তালা। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, আজও শিক্ষার্থীদের খুব কম অংশকেই ঘরে আটকানো গেছে। এ ক্ষেত্রে তারা যতটা না দায়ী, তার চেয়ে অনেক বেশি দায়ী তাদের অভিভাবক। বাস্তবতা এই যে, বিপদ ঘাড়ে আছড়ে না পড়ার আগ পর্যন্ত বুঝতে চাই না বিপদের ভয়াবহতা। করোনাভাইরাস বাংলাদেশের মানুষকে ঠিক কতটা ভয়াবহ বিপদের ভেতর ফেলবে সেটা সময়ের সঙ্গে স্পষ্ট হবে। প্রতিদিন সংক্রমণের তীব্রতা বাড়ছে। উপসর্গ নিয়ে মরে যাচ্ছে অনেকে। এর আগে লিখেছিলাম—‘সচেতন হন, সামনে বিপদ’। লেখাটি ছিল সচেতনতা সৃষ্টির একটা প্রয়াস। সাধ্যমতো চেষ্টা করাই ছিল আমাদের কাজ। সেটা কোন খাতে কতটা সঠিকভাবে আমরা করতে পেরেছি, তা প্রশ্নাধীন। গত বছরের ডিসেম্বর থেকে করোনাভাইরাস ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। বিভিন্ন দেশের দেওয়া সরকারি হিসাবমতে, এ পর্যন্ত করোনাভাইরাসে মৃত্যুর সংখ্যা এক লাখ ছাড়িয়ে গেছে। এ সংখ্যা কিন্তু খুব দ্রুত বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে সর্বস্তর থেকে বলা হচ্ছে—কিছুদিন ঘরে থাকুন। কিন্তু কেউ নিয়ম মানছে না। এভাবে নিয়ম অগ্রাহ্য করলে করোনাভাইরাস প্রতিরোধ কঠিন হবে।
ঠান্ডা-গরম সব ধরনের পরিবেশেই কিন্তু করোনাভাইরাস ছাড়াচ্ছে। বারবার মিউটেশন ঘটিয়ে ভিন্ন ভিন্ন চেহারার করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ সংক্রমণ ঘটিয়ে চলছে। এ জন্য গবেষক, বিশেষজ্ঞ, বিজ্ঞানীরা দিশেহারা। আজ এই লক্ষ্মণ তো কাল আরেকটা। প্রথমে আমরা জেনেছি, জ্বর, কাশির সঙ্গে গলা ব্যথা, পাতলা পায়খানা, শ্বাসকষ্ট। এখন এগুলোর সঙ্গে যোগ হয়েছে, ঘ্রাণশক্তি চলে যাওয়া, খাবারের স্বাদ বুঝতে না পারা, চোখ গোলাপি হয়ে যাওয়া। আবার একেবারে কোনো প্রকার লক্ষণ ছাড়াই কোভিড-১৯ আক্রান্ত মানুষের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। এর সবচেয়ে ভয়াবহ দিক সম্ভবত লক্ষণ প্রকাশের দীর্ঘসূত্রতা অথবা একেবারে লক্ষণ প্রকাশিত না হওয়া। রোগী যখন নিজেই জানেন না তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত, তখন তাঁর ভাবলেশহীন চলাফেরা হাজারো মানুষকে খুব সহজেই আক্রান্ত করে ফেলছে। হয়তো দেশ, ব্যক্তি, পরিবেশ ভেদে জিন মিউটেশন ঘটিয়ে ভিন্ন ভিন্ন চেহারায় আবির্ভূত হচ্ছে কোভিড-১৯। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো সংক্রমণ কিন্তু তীব্র গতিতে ছড়িয়ে পড়ছে। আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ এ থেকে বাদ পড়েনি।
মনোবল বাড়াতে আর কেউ এ জাতীয় কথা না বলি, ‘আমরা অমুক দেশের চেয়ে এগিয়ে’, ‘সব ক্ষেত্রে আমাদের বিরাট প্রস্তুতি’। সকল বিষয়ে এ ধরনের হালকা কথাবার্তা মানুষের আত্মবিশ্বাস জোগায় ঠিক আছে; কিন্তু সবকিছু হালকাভাবে নেওয়া বা মানুষের মনে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস জন্মানো অনেক ক্ষেত্রে তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়ার শামিল।
আমাদের প্রত্যাশা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অপ্রয়োজনীয় কাজে বাইরে ঘুরে বেড়ানো মানুষকে কড়া পদক্ষেপের মাধ্যমে ঘরে ফেরাবে। এ ক্ষেত্রে দেশ ও মানুষের কল্যাণের স্বার্থে যতটা কঠোর হতে হয়, ঠিক ততটাই কঠোর হতে হবে। বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে—এমন সব এলাকা থেকে দিগ্বিদিক ছুটে পালানো মানুষের পথ বন্ধ করতে হবে। আজ যারা রাস্তায় মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছেন আক্রান্ত রোগীর খবরে তাঁরাই সবার আগে পালানোর পথ খুঁজে বেড়াবেন। এখনই সময় ঘরে থাকার। আত্মশুদ্ধির কালে ঘরে থেকে সবাই চেষ্টা করি নিজেকে শুদ্ধ করার। মিথ্যা, ধোঁকাবাজি, অন্যায় অবিচার, চুরি-বাটপারি, অমানবিকতা ভুলে আসুন সবাই মানুষ হই। আল্লাহ আমাদের দেশ ও মানুষকে বড় বিপদ থেকে বাঁচিয়ে দিন।