তিনি ভালো মনে করে যে কাজই উৎসাহের সঙ্গে করতেন, দশজনে তার ভেতরে পাগলামির নমুনা খুঁজে পেতেন। ছোটবেলা থেকেই তাঁর কিছু ভালো অভ্যাস গড়ে উঠেছিল। সদা সত্য বলা, সব সময় সৎ থাকা, বিপদ সঙ্গে করেও অন্যের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়া এতসব কিছুসহ নিজের সঙ্গে যুক্ত করে নিয়েছিলেন দুর্লভ গুণ, কারও মনে আঘাত না দেওয়া। মানবতার কবি, মানুষের কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা যেমনটি বলেছে, ‘কারও মনে তুমি দিয়ো না আঘাত, সে আঘাত লাগে কাবার ঘরে’, তিনি অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতেন। সদ্ব্যবহার, ভালো আচরণ যেন তাঁর শরীরে আব্রু রক্ষার জামা–কাপড়ের মতোই তাঁর শরীর আঁকড়ে থাকে। আসলে ছোটবেলাতেই পারিবারিক শিক্ষা ও সেই সঙ্গে স্কুলে স্নেহশীল, পিতৃতুল্য শিক্ষকগণের কর্তব্যপরায়ণতা এবং বই পুস্তকে লিখিত নৈতিক শিক্ষা তাঁকে সারা জীবন বেঁধে রেখেছিল। আজীবন তিনি তাতে নিষ্ঠার সঙ্গে অবগাহন করেছেন। ফলত তিনি ছিলেন পরিচ্ছন্ন মনের মানুষ।
এতসব গুণ এক জনমে অর্জন করা এবং সারা জীবন লালন করে যাওয়া সুকঠিন। তিনি করেছিলেন। স্কুলের উঁচু ক্লাসে কিংবা কলেজে যাওয়া–আসার পথে হয়তো দেখলেন প্রায় বস্ত্রহীন মানুষ নারী অথবা পুরুষ অথবা বাচ্চা ছেলেমেয়ে, স্কুল কলেজ যাওয়া ভুলে বাসায় ফিরে এসে মায়ের কাছে আবেদন, ‘মা, শিগগিরই কিছু পুরোনো কাপড়চোপড় দাও। আমি ওদেরকে বসিয়ে রেখে এসেছি।’ মা তার এই নরম মনের ছেলেটাকে প্রশ্রয় দিতেন বরাবর। বাবা চটে যেতেন বা ধমকা–ধামকি করতেন, এমন নয়। তবে তাঁর কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ত। উদ্বিগ্ন হতেন তাঁর এই অসম্ভব ভালো কোমল প্রাণ ছেলেটির জন্য। এই কঠিন পৃথিবীর পাথুরে বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে সে পথ চলবে কী করে?
খুব কাছের বন্ধুদের সঙ্গে বাবা তাঁর দুশ্চিন্তা, কষ্ট ভাগাভাগি করতেন। তাঁরা তাঁকে সান্ত্বনা দিতেন, আশ্বস্ত করতেন। বলতেন বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এবং দায়িত্ব ঘাড়ে পড়লে আপনাতেই ঠিক হয়ে যাবে। তিনি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলতেন, ‘কী জানি, ও একটু অন্য ধাঁচের। বাসায় লোকজন এলে ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে থাকে। ডাকাডাকি করলেও খেলে না, সামনে আসে না। আত্মীয়স্বজনের বাড়ি যায় না, তারা এলে দেখা করে না। আমার তো চিন্তা হয়। মানুষের সঙ্গে কথা বলে না, আবার দেখি গাছের দিকে তাকিয়ে থাকে, গাছের সঙ্গে কথা বলে।’
বন্ধুরা সমব্যথী হন। তাঁরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে মতামত দেন, ‘এতে চিন্তার কোনোই কারণ ঘটেনি। সে অন্যদের মতো এতটা বিষয় ভাবাপন্ন নয়, মানে বৈষয়িক নয়। বাস্তববুদ্ধি কম, এসবই সময়ে ঠিক হয়ে যাবে। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর অনেক বন্ধু–বান্ধব হবে। মেয়েদের সঙ্গে মেলামেশা হবে। হয়তো কারও সঙ্গে বিশেষ ঘনিষ্ঠতা হবে। তখন এসব বিষয় মাথা থেকে এমনিতেই চলে যাবে।’
বন্ধুরা আপনজনের মতোই বিষয়টি নিয়ে ভাবেন এবং তাঁকে আশ্বস্ত করেন। কিন্তু সব মানুষ তো আর একরকম হয় না। এমন অনেকেই আছেন যাঁরা কারণ ছাড়াই, কোনো রকম কিছু প্রাপ্তি ছাড়া অন্যের ক্ষতি করেন। এঁদের মধ্যে এমন মানুষও আছেন, যাঁরা আপন-পর ভেদ করেন না। যেমন এঁদের মধ্য থেকে একজন বলে বসলেন, ‘ছেলেটা বোধ হয় বেশি রকমের অন্তর্মুখী, সমস্যাটা থেকে যেতে পারে’। বাবার খারাপ লাগল। তিনি কষ্ট পেলেন। ভাঙা গলায় বললেন, ‘না, না, সে ও রকম নয়। ওর যথেষ্ট বন্ধুবান্ধব আছে। তাদের সঙ্গে স্বাভাবিক মেলামেশা আছে। হই হুল্লোড়, বেড়ানো সব আছে। খেলাধুলায় তেমন আগ্রহ নেই বটে, তবে কবিতা লেখে। পত্রিকায় পাঠায়, ছাপাও হয় সেগুলো।’
নিন্দুক ব্যক্তিটি সঙ্গে সঙ্গে বলে বসে, ‘তাহলে তো আরও চিন্তার কথা। আপনার তো এখুনি একজন মনস্তত্ত্ববিদের সঙ্গে পরামর্শ করা দরকার। পারলে ছেলেকে নিয়ে গিয়ে দেখান।’ কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে অন্য সবাই নিন্দুক লোকটিকে ভর্ৎসনা করে থামিয়ে দিয়ে মানসিকভাবে খানিকটা বিপর্যস্ত বন্ধুকে আশ্বস্ত করেন ছেলের কিছুই হয়নি, সে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক।
বাবা খানিকটা স্বস্তি নিয়ে বাসায় ফেরেন। কিন্তু অস্বস্তি নামক কাঁটার খচখচানি রয়েই যায়। ছেলেকে দেখলেই তাঁর অস্বস্তি বাড়ে। ভাবেন, ছেলেকে নিয়ে মনরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যাবেন। কিন্তু ছেলে যদি অন্যভাবে নেয়, তাকে তার মা-বাবা পাগল মনে করছেন ভেবে নিয়ে ক্ষেপে যায় বা ভীষণ ক্ষেপে গিয়ে কিছু করে বসে? এসব চিন্তা তাঁকে কাবু করে। অবশেষে তিনি সিদ্ধান্তে নিয়ে একাই চুপিচুপি গিয়ে ডাক্তারের সঙ্গে সবিস্তারে আলাপ করেন। সব শুনে ডাক্তার তাঁর সিদ্ধান্ত জানান, ছেলে সম্পূর্ণ সুস্থ এবং স্বাভাবিক। উনি নিশ্চিন্ত মনে বাসায় ফেরেন। এ বিষয়ে কারও কাছেই তিনি মুখ খোলেননি। মাত্র গুটিকয় মানুষের সঙ্গে পরামর্শ করেছিলেন, যাঁরা তাঁর বন্ধু বলে পরিচিত। অথচ কথাটা অনেকের কানেই চাউর হয়ে যায়। বেশ কিছুদিন ছেলেটাকে যন্ত্রণা পোহাতে হয়।
এরপর আবার শুরু হয় ছেলেটি যখন সমাজটাকে বদলে দেওয়ার স্বপ্নে বিভোর হতে শুরু করে। বন্ধুদের নিয়ে সে পাড়ায় পাড়ায় পাঠাগার, ক্লাব গড়ে তোলার লক্ষ্যে দিনরাত ছোটাছুটি করতে থাকে। সে সুইপার কলোনিতে যাতায়াত শুরু করে এবং সবাইকে বুঝিয়ে শুনিয়ে রাজি করিয়ে সেখানেও পাঠাগার ও ক্রিকেট ক্লাব গড়ে তোলে। বয়োজ্যেষ্ঠ মুরুব্বিদের পরামর্শ ও আর্থিক অনুদান গ্রহণ ও সহযোগিতা নিত। তার নির্মল চরিত্র ও অবিচল দেশপ্রেমের কারণে প্রায় সবাই তাকে খুব ভালোবাসত। আবার এসবের মধ্যেই কেউ কেউ প্রচার করতে তৎপর থাকত, সে একটা পাগল।
তখন সে আর সে নয়। তখন তিনি, তিনি। লেখাপড়া শেষ। ভালো চাকরিতে ঢুকেছেন। বিয়েটাও সেরে ফেলেছেন। সংসার করছেন। মা-বাবা-ভাই-বোন সবাই একসঙ্গে। এক পরিবারে। বেশ সুখে-শান্তিতে দিন কাটছে।
হঠাৎ এক রাতে এশার নামাজ শেষে রাতের খাবারের পাট সেরে শুতে যাওয়ার পর আর ওঠেননি বাবা। ঘুমের ভেতরেই স্ট্রোক করে চলে গেছেন। কিছুদিনের মধ্যই বসতবাড়ি ছাড়া বাবার অন্যান্য বিষয় সম্পত্তি ভাই-বোনদের মধ্যে রেজিস্ট্রিকৃত আপস বণ্টননামা দলিলি প্রক্রিয়ায় ভাগাভাগি হবে বলে স্থির হয়। এবার তিনি স্থির করেন, তাঁর ভাগের সম্পত্তি তিনি নেবেন না, তাঁর অংশ তাঁর ভাই-বোনদের ভেতর প্রাপ্য অংশানুসারে বণ্টিত হবে। এবং সে মতে কাজ হয়ে যাওয়ার পর তাঁর স্ত্রী ভীষণ ক্ষেপে যান তাঁর ওপর। তিনি স্ত্রীকে বোঝাতে চেষ্টা করেন, ‘দ্যাখো, আমি বড়। আমার ছোট ভাই-বোনদের প্রতি দায়িত্ব আছে। আমার তো স্থায়ী সরকারি চাকরি আছে। ওরা তো এখনো কেউ কিছু করে না। কেউ কেউ এখনো পড়াশোনা করছে। ওদের জন্য আমার এটা করা কর্তব্য কাজ। প্লিজ বোঝার চেষ্টা কর।’
‘না, তাঁর স্ত্রী বোঝেননি। বুঝতে চাননি। তিনি শুধু নিজেদের সম্ভাব্য অর্থকর ক্ষতির দিক বিবেচনা করেছেন। প্রথমত রাগ করে কথা বলা বন্ধ করেছেন, নিজের মা-বাবা-ভাই-বোনকে বুঝিয়েছেন তাঁর স্বামী মানসিকভাবে সুস্থ নয়, তাই তাঁর সঙ্গে সংসার করা সম্ভব নয়। ৭ দিনের মাথায় বাবার বাড়ি চলে গেছেন ছেলেসহ। এক মাস পর ফিরে এসেছেন রাগ কমলে।
এর চেয়ে ভয়াবহ বিপর্যয়ে পড়েছেন বছর দশক আগে। ডিপার্টমেন্ট থেকে সুযোগ পেয়েছিলেন পাঁচ মাসের একটা ডিপ্লোমা সার্টিফিকেট কোর্স করতে আমেরিকায় যাওয়ার। গিয়েছিলেন এবং ঠিক পাঁচ মাস এগারো দিনের মাথায় ডিপ্লোমা শেষ করে দেশে ফিরেছিলেন। এরপরে শুরু হয়েছিল আসল যন্ত্রণা। আত্মীয়-অনাত্মীয়-দূরাত্মীয়, এমনকি অফিসের সহকর্মী সবার কাছে তিনি হাঁদারাম, বোকারাম, অপদার্থ, অতি আবেগী ইত্যাদি বিশেষণে বিশেষায়িত হতে লাগলেন। কারণ, তিনি আমেরিকায় গিয়ে না থেকে দেশে ফিরে এসেছেন। তিনি বোঝাতে চেষ্টা করেছেন যে, সেখানে স্থায়ীভাবে থাকতে হলে গ্রিনকার্ড লাগবে। তাঁর থাকার আর অনুমোদন ছিল না। কে শোনে কার কথা? সবাই ধরেই নিল, তিনি আসলেই পাগল। বাড়ির লোকজনও ভালোভাবে নেয়নি বিষয়টিকে। বেশ কিছুদিন এমনকি ভালো করে কথাই বলেনি। এলাকার মানুষও দেখলেই ব্যঙ্গাত্মক কথা বলতে শুরু করেছিল। অফিসে সহকর্মীদের সঙ্গে এবং আরেকদিন বন্ধুদের সঙ্গে তিনি তুমুল ঝগড়া করলেন। তিনি দাবি করলেন, তিনি পাগল, কারণ তিনি চারপাশের মানুষদের মতো নন। তিনি সৎ, তিনি ভালো এবং স্নেহশীল-দরদি, সত্যবাদী মানুষ। তিনি তাই হতে ব্রতী থেকেছেন যা একজন মানুষের হওয়া উচিত। তিনি সেগুলোই অনুসরণ করেছেন, যা তাঁকে বই-পুস্তক শিখিয়েছে! সবাই তাঁকে বলেন, তিনি সাধারণ মানুষ নন।
তিনি সাধারণ মানুষের বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকলে, তাঁকে বলতে হবে, তিনি অসাধারণ! তা না বলে তাঁকে পাগল বলা হচ্ছে কেন? সবাই চুপ হয়ে গেছেন। অধোবদনে থেকেছেন। কিন্তু তা বলে গুঞ্জন থেমে থাকেনি।
তাঁকে নিয়ে তাঁর পরিবারের সর্বশেষ বিপর্যয়ের ঘটনাটি ঘটেছে মাস তিনেক আগে। তাঁর মেয়ের বিয়ের কথা চলছে। মোটা দাগের খরচের ব্যাপার আসছে। পরিবারের সবাই উদ্বিগ্ন। অবশ্য মেয়ের চাচারাও সবাই এখন দাঁড়িয়ে গেছে। তবুও—। মেয়ের মা মেয়ের বাবার প্রভিডেন্টের টাকার বিষয়ে জানতে চেয়ে জিজ্ঞাসাবাদের ফাঁকে জানতে পেলেন, প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে ইতিমধ্যে বড় একটা পরিমাণ ঋণ করে একজন সহকর্মীর মেয়ের বিয়ের জন্য দিয়েছেন। ব্যস, বাসায় বোম ফাটল যেন! প্রশ্নের পর প্রশ্ন।
এদিকে জবাব নেই। মুখ নামিয়ে, চোখ মেঝে খুঁড়ে গুপ্তধন তুলছে যেন! অতঃপর শুরু হলো ভদ্রমহিলার কান্না। এবার ভদ্রলোক আমতা-আমতা করে বললেন, ‘কী করব, ভদ্রলোকের মেয়েটার গায়ের রং ময়লা, অনেক সম্বন্ধ এসে ভেঙে গেছে। ভদ্রলোকের মুখে চাওয়া যেতো না। শুধু ক’টা টাকার জন্য এই সম্পর্কটাও ভেঙে যাবে, এ আমি সহ্য করে পারিনি। তা ছাড়া উনি ধার নিয়েছেন, আমার প্রয়োজন পড়া মাত্র দিয়ে দেবেন’। কাজ হয়নি। ভদ্রমহিলা সেদিন থেকে মেয়ের ঘরে শোয়। কথা বলা একবারেই বন্ধ। মেয়েও কথা বলে না। ছেলে পালিয়ে বাঁচে।
এরপর এই সেদিন, অফিসে ছিলেন। অফিসের পেছন দিকটায় একটা ছোটখাটো বস্তি মতন। সেই বস্তিটাতে নানা রকম দোকানপাট, ছোট ছোট চায়ের স্টল। ইতালি রেস্টুরেন্ট, পাইস হোটেল। নানা জায়গায় আগুনের কারবার। কোত্থেকে, কীভাবে যেন আগুন লেগে গেছে। সেই আগুনের আঁচ, ধোঁয়া, পোড়া গন্ধ সব ভেসে আসছিল এ অফিসের জানালা দিয়ে। ভদ্রলোক চিৎকার চেঁচামেচি করে পিওন, দারোয়ানসহ সহকর্মীদের ডাক দিয়ে টয়লেট থেকে বালতি-বদনা নিয়ে দৌড়। ঘটনাস্থলে পৌঁছে হাঁকডাক করে লোক জড়ো করে ফায়ার ব্রিগেডকে ফোন করতে বলে টিউবওয়েল থেকে বালতি ভরে ভরে পানি ঢালতে লাগলেন আগুনের ওপর। তার সঙ্গে অনেকে এই কাজ শুরু করলে তিনি দৌড়ে যান জ্বলন্ত ঘরগুলো থেকে মানুষগুলোকে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে আনতে।
এক ঘর থেকে শিশুর কান্না শোনা যাচ্ছিল। এদিকে মা বেচারি পড়ে পড়ে বিলাপ করে কাঁদছিল। মাত্র সেকেন্ড কয়েক, সকলে দেখল তিনি সেই ঘরের দিকে ছুটছেন। আগুন জ্বলছে দাউ দাউ করে, তিনি তার ভেতর দিয়ে ছুটছেন আটকে পড়া বাচ্চাটাকে উদ্ধার করে আনতে। সবার রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা, উদ্বেগ। পরমেশ্বরকে ডাকছেন সবাই। বাচ্চার মা বাচ্চার জন্য কান্না ভুলে এবার ভদ্রলোকের জন্য কাঁদছেন। সব মিলিয়ে মিনিট তিনেক, সবাই দেখল উনি ফিরে আসছেন, দুহাত ছড়িয়ে ওপরে তোলা। হাতে ধরে রাখা শিশুটি, সে নিরাপদ। কিন্তু ভদ্রলোকের সারা শরীর জ্বলছে। শরীরের কিছু অংশ ঝলসে গেছে ততক্ষণে। ফায়ার ব্রিগেডের কর্মী ছুটে গিয়ে তাঁর হাত থেকে বাচ্চাটা নিতেই তিনি ঢলে পড়লেন। হাসপাতাল তাঁকে মৃত ঘোষণা করেছিল।
পরিবারের লোকজন হাসপাতালে পৌঁছার আগেই লাশ রিলিজ করে নিয়ে লোকজন রাস্তায় নেমেছিল শোক মিছিল করতে। বড় দুই রাজনৈতিক দল ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল মৃত লাশটিকে তাদের কর্মী প্রমাণ করতে। স্থানীয় সমাজকর্মীরা তাদের ছিনতাই কর্মের আগেই লাশ নিজেদের আয়ত্তে নিয়ে গোসল কাফন শেষে মহল্লার মসজিদ সংলগ্ন মাঠে জানাজার জন্য নিতেই সেখানে মানুষের ঢল নামল। নাগরিক শোকসভা হলো। লাশের খাটিয়া ফুলে ফুলে ভরে গেলে। মানুষের কান্না আর বিলাপ। বিশিষ্টজনেরা বক্তৃতা করলেন, মন্ত্রী এলেন। ঘোষণা হলো সদাশয় সরকারের তরফ থেকে যথাশিগগির এই মহান ব্যক্তিকে মরণোত্তর পুরস্কার ও পদক প্রদান করা হবে। মানবহিতৈষী সংগঠনগুলো নানা পুরস্কার দেওয়ার অঙ্গীকার করলেন। স্থানীয় সংগঠন এবং মহল্লার ক্লাব দাবি তুললেন, তাঁর নামে একটি রাস্তা ও হাসপাতালের নামকরণ করতে হবে। বক্তারা মৃত মানুষটির জীবনের নানা ঘটনা তুলে ধরে তাঁর মহত্ত্ব, তাঁর অসাধারণত্ব সম্পর্কে বললেন। মন্ত্রী মহোদয় তাঁকে চিনতেন না, তাঁর সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। অথচ কি সাবলীল বলে গেলেন! কত কত ভালো কথা! কত প্রশংসা! একটি প্রশংসা বাক্য সবাই একই শব্দমালায়, একই কাঠামোতে, একই রকম কান্নাভেজা কণ্ঠে বলেছিলেন, তিনি একজন অসাধারণ মানুষ ছিলেন। না, কেউ বলেননি তিনি পাগল ছিলেন। মানুষের ভিড়ে পেছনে দাঁড়িয়ে কথাগুলো শুনে আমি ভাবছিলাম লাশের মুখের বাঁধন খুললে এই মুহূর্তে কী দেখতাম, ঠোঁট দুটি একদিকে একটু বাঁকানো। ঠোঁটের কোনায় এক চিলতে হাসি, বিদ্রূপের।
পাদটীকা: একজন অসাধারণ মানুষের এই গল্পে অসাধারণ মানুষটির এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য চরিত্রের কোনো নাম নেই। এই মানুষগুলো আমাদের আশপাশে সব সময়ই আছেন।