কু ঝিকঝিক কু ঝিকঝিক…। ঢাকা টু চিটাগং, রাতের ট্রেনটা ছুটে চলেছে প্রবল গতিতে। গতির তোয়াক্কা নেই, মেয়ের পাশে হেলান দিয়ে আধো ঘুমে ঝিমুচ্ছেন রাহেলা খাতুন। বড় মেয়ের প্রথম কন্যা সন্তান দেখতে রাহেলা বেগম দুই মেয়েকে নিয়ে রওনা হয়েছেন চিটাগাং।
রাহেলা খাতুনের তিন মেয়ে। শালু, বিনু ও তনু। বিনু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজির ছাত্রী। তনু নবম শ্রেণির ছাত্রী। তার কোনো ছেলে সন্তান হয়নি। রাহেলা খাতুনের স্বামী গত হয়েছেন আজ প্রায় সাত বছর। তখন থেকেই রাহেলা খাতুন একা মেয়েগুলোকে নিয়ে আছেন। শালুকে বিয়ে দিয়েছেন প্রায় চার বছর আগে। স্বামীর রেখে যাওয়া তিনতলা বাড়িটির একতলা ও দ্বিতীয় তলা ভাড়া দিয়েছেন। স্বামীর তরফ থেকে পেনশনের কিছু টাকা আসে প্রতি মাসে। আর বাজারে দুটো দোকান ভাড়া। ব্যাস! এ দিয়েই চলে যায় রাহেলার সংসার ভালোমতোই।
ট্রেন চলছে, তো চলছেই। কু ঝিকঝিক কু ঝিকঝিক...। কখন যাত্রা শেষ হবে, সে ভাবনা ও বিরক্তি নিয়ে জানালার পাশে বসে আছে বিনু। সেই কমলাপুর থেকে ট্রেনে ওঠার পর থেকেই বিনুর দৃষ্টি জানালার বাইরে। মুখোমুখি এক মাঝবয়সী ভদ্রলোকের সঙ্গে সিট ভাগাভাগি করে বসেছে তনু। রাহেলা খাতুনের ঘুম মনে হচ্ছে এবার বেশ ভালোই জমেছে। মুখটি হা হয়ে আছে। মাকে হা করে থাকতে দেখে বিনুর চোখে-মুখে এবার বিরক্তির ছাপ আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল। বিরক্তিতে মায়ের গা ধাক্কা দিল বিনু। রাহেলা খাতুন একটু নড়েচড়ে উঠেই আবার মুখ হা করে নাক ডাকতে লাগলেন।
-আপু। তনু ডাকল।
-হুম। বিনুর বিরক্ত স্বরে উত্তর।
-ক্ষুধা লাগছে।
-মাকে ডাক। বলেই বিনু জানালার বাইরে মুখ ফিরিয়ে নিল।
তনুর পাশে বসা লোকটি খুব মজা করে শব্দ তুলে বাদাম খাচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন জাবর কাটছে। বাদামের খোসাগুলো ট্রেনের মেঝেতে ফেলছে। তনু আড়চোখে লোকটিকে দেখল। কিছু বলতে গিয়েও যেন থেমে গেল। হঠাৎ ট্রেনটা এক ঝটকায় কোথাও থেমে পড়ল। সবাই নড়ে উঠল। রাহেলা খাতুনের ততক্ষণে একচোট ঘুম হয়ে গেছে। চোখ খুলতেই তনু ডাকল—
-মা।
-কিরে! রাহেলা খাতুনের ঘুম জড়ানো কণ্ঠ।
-খাব। খিদা লাগসে।
-সে কী রে! ডাকিসনি কেন?
-আপুকে বলেছিলাম তো।
রাহেলা খাতুন এবার ভ্রু কুঁচকে তাকালেন বিনুর দিকে। নিজের মনে বিড়বিড় করে কী সব বলতে বলতে খাবারের পটটা হাতে তুলে নিলেন। আসার সময় রাহেলা খাতুন অনেক খাবার করে এনেছেন। পাটিসাপটা পিঠা, ডাল পুরি, চিকেন কাবাব, তেলের পিঠা, চানাচুর ও ফ্লাক্স ভর্তি চা। দুটো কাবাব ও পিঠার বাটিটা তনুর দিকে বাড়িয়ে দিলেন তিনি।
-চা খাবি তনু?
-খাব। একটু দাও।
রাহেলা বেগম তনুকে ফ্লাক্স থেকে কাপে করে চা ঢেলে দিলেন। মেয়েদের যত্ন করে খাওয়াতে রাহেলা বেগম খুব সুখ পান।
রাতের প্রকৃতির দিকে চোখ বুলাতে বুলাতে কখন যে বিনুরও চোখ বুজে এসেছিল টেরও পায়নি। যখন চোখ খুলল, সকাল হয়ে গেছে। ‘বাড়বকুণ্ড স্টেশন ৫৩’, লেখা বড় সাইনবোর্ডটা চোখে পড়ল বিনুর। হুড়মুড় করে লোকজন নামছে-উঠছে। অল্প দূর চোখ যেতেই সিগন্যাল গার্ডের ছোট কুঠুরিটা চোখে পড়ল বিনুর। এখন এটা বটি-স্টল। এক কাপ ফ্রেশ চা হলে মন্দ হয় না। মায়ের ফ্লাক্স ভর্তি করে আনা চা খেতে ইচ্ছে করছে না। বাসি চা খেতে কেমন ভাতের মাড়ের মতো লাগে।
বিনু হাত ব্যাগটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াল।
-তনু, চল চা খেয়ে আসি। তনুকে ইশারায় ডাকল বিনু। তনুর চোখে-মুখে উত্তেজনা দেখা দিল। আগে কখনো সে এমন টি-স্টলে চা খায়নি।
-চলো আপু। বলেই তনু লাফিয়ে উঠল। রাহেলা খাতুনও সাগ্রহে উঠে দাঁড়ালেন।
-বিনু! আমিও চা খাব চল। বললেন, রাহেলা খাতুন।
বিনু আবারও ভ্রু কুঁচকে তাকাল মায়ের দিকে। বলল—
-তুমি যাবে কেন মা?
-কেন যাব না? আমিও তোদের সাথে চা খাই চল।
-নাহ! তুমি থাক। ফ্লাক্স ভর্তি চা আছে; খাও আর পেপার পড়।
-কেন? গেলে কী হয়? রাহেলা খাতুন অসহায় মুখ করে বললেন।
-তুমি গেলে আমাদের আনন্দে পানি পড়বে। বরং তুমি খাবার, আর ব্যাগগুলো পাহারা দাও মা। রাহেলা খাতুনকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বিনু ট্রেন থেকে নেমে গেল তনুকে নিয়ে।
রাহেলা খাতুন বিস্ময়ে মেয়েদের চলে যাওয়া দেখলেন। দিন দিন মেয়েটা এত বেয়াদব হয়ে যাচ্ছে কেন! এ মেয়ে তো স্বেচ্ছাচারী! তিনি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন মেয়ের ভবিষ্যৎ কালো কুচকুচা, অনেকটা মোজাম্বিকের চোপিকদের মতো। এই মেয়ে মহা বিপদে পড়বে একদিন! বিশাল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অগত্যা রাহেলা খাতুন চায়ের ফ্লাক্সটা হাতে তুলে নিলেন।
টি-স্টলের কাছে এসে দুই বোন এদিক-ওদিক দেখছে। আহ! কত দিন ময়লা কাপে পানি টলটলা চা খায়নি বিনু। দুই কাপ চা বানাতে বলে ওরা বসল পুরোনো চার পায়া নড়বড়ে টুলটাতে।
-আফা, কয় চামচ চিনি দিমু? স্টল বয় লাল কোদালের মতো দাঁত বের করে জিজ্ঞেস করল।
-এক চামচ। বিনু বলল।
-জে আইচ্ছা আফা।
স্টল বয় চা বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। টুং টাং শব্দে চামচ নেড়ে দু কাপ চা এগিয়ে দিল ওদের দিকে। বিনু কাপের হাতলের দিকটা মুখের দিকে ঘুরিয়ে চায়ে চুমুক দিল। আহ! চা-টা বেশ! অন্তত ফ্লাক্সে রাখা ভাতের মাড়ের থেকে ভালো।
-কী রে, নাম কী তোর? বিনু জিজ্ঞেস করল।
-মিলন আফা।
-স্কুলে যাস না?
-নাহ, আফা!
-কেন? বিনুর কৌতূহলী দৃষ্টি মিলনের দিকে।
-বাপের অসুখ। বিছানায় পড়া। মা এক সাবের বাড়িতে কাজ করে। বাপের অশুদ কিনতে হয়। ট্যাকা কই পামু আফা! তাই স্কুলে যাই না। ইস্টিশনের এক সার আমারে এই চা বেচার কাম দিসে।
এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে গেল মিলন। বিনু এতক্ষণ দেখছিল মিলনের টুং টাং শব্দে চা বানানো। তনু চায়ে চুমুক দিচ্ছে, আর মজার মজার শব্দ করছে। বিনু চা শেষ করে উঠে দাঁড়াল।
-এই নে। বাবার ওষুধ কিনিস।
বলেই দুইটা ১ হাজার টাকার নোট বের করে মিলনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে হনহন করে ট্রেনের দিকে পা বাড়াল বিনু। মিলন হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। কী অদ্ভুত! এমনও মানুষ হয়! তনু পিছু পিছু দৌড়ে এল।
-আপু। এতগুলো টাকা দিয়ে দিলে? তনুর চোখে-মুখে বিস্ময়। বিনু কোনো জবাব দিল না। ট্রেনে উঠে এল।
কিছু কিছু প্রশ্নের কোনো উত্তর হয় না।
বাড়বকুণ্ড স্টেশন থেকে ট্রেনটি সামনের দিকে এগোচ্ছে। বিনুর পাশের সিটের ভদ্রলোক ততক্ষণে নেমে পড়েছেন। তাঁর জায়গায় এখন বসে আছে ব্ল্যাক প্যান্ট, আর ব্লু শার্ট পরা এক ভদ্রলোক। বয়স ২৬/২৭ হবে, আনুমানিক। এই বয়সের লোকদের না বলা যায় তরুণ, না বলা যায় যুবক। চোখে কালো মোটা ফ্রেমের চশমা। মুখের সামনে সেই কখন থেকে সমরেশ বাবুর ‘কাছের মানুষ’ বইটা ধরে আছে। একটু দূরেই একদল ছেলে চাদর বিছিয়ে ফ্লোরে গোল হয়ে বসে তাস খেলছে। মাঝে মাঝে ভয়ংকর সব বাক্য চর্চা করছে উল্লাসে। বিরক্তিকর পরিবেশ।
মায়ের জাবর কাটায় অ্যালার্জি আছে বলে মনে হয় বিনুর। এত শব্দ করে খায় মানুষ! তার সবকিছুতেই শব্দ। ঘুমালেও নাক ডাকেন শব্দ করে। বাবা যে তাকে কী করে এতটা বছর সহ্য করেছেন! চোখে-মুখে বিরক্তি নিয়ে বিনু বসে রইল।
বিনুর পাশে বসা লোকটি এবার বই থেকে চোখ নামালেন। এক দৃষ্টিতে বিনুর দিকে চেয়ে আছেন। বিনুর চোখ পড়তেই আবার বইটা মুখের সামনে মেলে ধরলেন। বিনু উঠে দাঁড়াল, টয়লেটে যাবে। বগির দরজার কাছে যেতেই পাশের লোকগুলোর কারও একজনের গা থেকে ঘামের গন্ধ লাগল নাকে। আঁশটে ধরনের গন্ধ। নাক চেপে যেই বিনু টয়লেটে ঢুকতে যাবে, অমনি লোকগুলো খিক খিক করে হেসে উঠল।
আচ্ছা, ছেলেদের ঘামের গন্ধ মেয়েদের থেকে আলাদা হয় কেন? কখনো সেভাবে ভেবে দেখা হয়নি। তবে মেয়েদের ঘামের গন্ধে মাতাল করা একটা পাগলা সুবাস থাকে, এটা সব পুরুষকে মানতেই হবে।
টয়লেট সেরে বিনু ফিরে এল নিজের সিটে। লোকগুলো তখনো অকারণে হাসল। এই হাসির কারণ কী হতে পারে? টয়লেটে একটি মেয়ে কী করতে পারে, তা ভেবে কি ওদের এমন অকারণ হাসির উদ্রেক?
পাশে বসা লোকটা আবারও আড়চোখে তাকাচ্ছে বিনুর দিকে। মুখে মিষ্টি বিনয়ের হাসি। অদ্ভুত ধরনের মানুষগুলোই পারে এমন মিষ্টি করে হাসতে। বিনু ঘাড় ঘুরিয়ে জানালার বাইরে চোখ ফেরাল।
মোবাইলে টেক্সট এসেছে। টেক্সটটা এক নজর দেখে আবার জানালার বাইরে মুখ ফেরাল বিনু। রাতুলের টেক্সট। জানতে চেয়েছে, ওরা কত দূর এল। পথে কোনো সমস্যা হলো কিনা। জবাব দিতে ইচ্ছে করছে না বিনুর।
রাতুলে সাথে বিনুর এনগেজমেন্ট হলো আজ প্রায় ছয় মাস। রাতুল রাহেলা খাতুনের পছন্দের পাত্র। বিনু না করেনি। এক কথায় রাজি হয়ে গিয়েছিল। লোকটা মন্দ না। ঘুম থেকে উঠেই বিনুকে ফোন করবে। নাশতা করল কিনা, ঘুমাল কিনা, কোথাও যেতে হবে কিনা, কিছু কিনতে হবে কিনা...। নানান খোঁজ খবর নিবে। বলা যায়, লোকটা খুব দায়িত্বশীল স্বামী হবে।
রাহেলা খাতুন ইতিমধ্যে বিনুর পাশের সিটের লোকটির সাথে খাতির জমিয়ে ফেলেছেন। পাটিসাপটা পিঠা খাওয়াচ্ছেন যত্ন করে। মায়ের এই অভ্যাসটা বহু দিনের। সবাইকে খুব নিজের করে ফেলেন সহজেই।
ট্রেন ছুটছে ধীর গতিতে। বাহিরটা কেমন সবুজে ছেয়ে আছে। আশপাশের পুকুরগুলোতে অদ্ভুত রকমের সবুজ পানি। কিছু ছেলে-মেয়ে সবুজ পানিতে হাঁসের পিছু ছুটছে। ছেলেবেলাটা সত্যিই বড় আনন্দের। আরও একটা জিনিস খুব অবাক করল বিনুকে। রেললাইনের ধারে সারি বেঁধে গড়ে উঠেছে ছোট ছোট বস্তি। নোংরা ঘরের বাহিরটা স্পষ্ট দেখা যায় ট্রেন থেকে। ছোট ছোট বাচ্চারা খালি গায়ে দৌড়াচ্ছে। কারও কারও হাতে গোল সাইকেলের রিং। ওদের সাথে একটা রাত কাটালে মন্দ হতো না। শহুরে মেয়ের কাদা-বালি-নর্দমায় জীবনযাপন; অনেকটা থ্রিলিং গল্পের মতো।
ট্রেনটা এসে ‘কৈবল্যধাম স্টেশন নং-৫৭’-এ পৌঁছাল। যাত্রীরা অনেকেই নেমে পড়তে লাগল। বিনুর পাশে বসা লোকটিও ততক্ষণে নেমে গেছে। তনু চোখ বাড়িয়ে এদিক-ওদিক দেখল। হঠাৎ চোখ পড়ল উঠে যাওয়া লোকটির সিটে।। সমরেশ বাবুকে একা ফেলেই লোকটি উঠে গেছেন। তনু মাথা নেড়ে নেড়ে ঝালমুড়ি খাচ্ছে। বিরক্তিকর। এই মেয়েটা হয়েছে মায়ের মতো। সবকিছুতেই বাড়তি মসলা।
-ঝালমুড়ি খাবে আপু? তনু জিজ্ঞেস করল।
-নাহ। বইটা দে তো তনু।
তনু বইটা বিনুর কোলে ছুড়ে দিয়ে আবার ঝালমুড়ি খাওয়ায় ব্যস্ত হয়ে গেল।
বিনু বইটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখল। হঠাৎ বইটার ভেতর থেকে এক টুকরা কাগজ মেঝেতে পড়ল। কাগজটা হাতে নিল বিনু। পড়তে গিয়েই থমকে গেল। সারা চোখে মুখে বিস্ময়ে ছেয়ে গেল। বইটির ভেতরে এক টুকরো কাগজ টেপ দিয়ে লাগানো। তাতে লোকটি গোটা গোটা অক্ষরে লিখেছে—
‘নাম না জানা রাজকুমারী,
কেন জানি মনে হলো আমি স্টেশনে নেমে যাওয়ার পরই তুমি আমায় খুঁজবে। নম্বরটা দিয়ে গেলাম।’
বিনুর বিস্ময় এখনো কাটছে না। লোকটা কী করে জানল, সে তাঁকে খুঁজবে! আশ্চর্য!