আমেরিকায় মানবপাচারের অভিযোগে এক বাংলাদেশিকে আটক করা হয়েছে। তাঁর নাম মোকতার হোসেন (৩০)। মেক্সিকো সীমান্ত দিয়ে আসা বাংলাদেশিসহ অবৈধ অভিবাসীদের ওপর কঠোর নজর রাখা হচ্ছে। বাংলাদেশের অভিবাসী নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্যও করছেন আমেরিকার রক্ষণশীলরা। তাঁরা বলছেন, বাংলাদেশি অবৈধ অভিবাসীদের সঙ্গে আমেরিকায় জঙ্গি গোষ্ঠীর প্রবেশ ঘটছে। তাঁরা বলছেন, বাংলাদেশ একটি জনবহুল মুসলিম প্রধান দেশ। সেখানকার দরিদ্র লোকজন এমনি এমনি আমেরিকায় আসার কথা নয়। যারা দরিদ্র, আমেরিকায় আসতে জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছে তাদের উদ্দেশ্য ভিন্ন। কোন মহল নেপথ্যে তাদের সহযোগিতা করছে। আমেরিকায় আসতে অবৈধ অভিবাসীরা যে ২০-৩০ লাখ টাকা দালালকে দিচ্ছেন, সেই অর্থের উৎস অন্য কোনোখানে।
আদম পাচারের অভিযোগে আটক বাংলাদেশি মোকতার মেক্সিকোর মন্টেরিতে বসবাস করেন। একটি হোটেল চালান তিনি। আমেরিকার আইন মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে বলা হয়, মোকতার ২০১৭ সালের মার্চ থেকে ২০১৮ সালের আগস্টের মধ্যে ষড়যন্ত্র করেছেন। এ সময়ে তিনি অর্থের বিনিময়ে টেক্সাস সীমান্ত দিয়ে অবৈধ বাংলাদেশিদের আমেরিকায় পাচার করেন। মন্টেরিতে বসে তিনি এই কাজ চালাচ্ছেন। যাদের আমেরিকায় পাচার করা হয়, প্রথমে তাদের তাঁর হোটেলে আশ্রয় দেন। তারপর গাড়িতে করে তাদের আমেরিকার সীমান্তে পাঠান। গাড়ির চালককে অর্থ পরিশোধ করেন মোকতার।
গত ৩০ নভেম্বর মোকতারকে টেক্সাস সাউদার্ন ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট দিনা হ্যানোভিস পালেরমোর আদালতে হাজির করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে টেক্সাসের লরেডো ডিভিশনে ফৌজদারি অভিযোগ আছে। মেক্সিকো থেকেই আটক করা হয় তাঁকে। আমেরিকায় আনার পর তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
মোকতারের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ আনেন আমেরিকার আইন মন্ত্রণালয়ের ফৌজদারি বিভাগের সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল ব্রায়ান এ বেনজোস্কি, টেক্সাস সাউদার্ন ডিস্ট্রিক্টের অ্যাটর্নি জেনারেল রায়ান কে প্যাট্রিক এবং অভিবাসন ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি ইনভেস্টিগেশনের স্পেশাল এজেন্ট ইনচার্জ শেন এম ফোল্ডেন প্রমুখ। আদালতে বিচারক বলেন, মোকতারকে পরে লরেডোতে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের বিচারের জন্য স্থানান্তর করা হবে।
গত এক বছরে আমেরিকার দক্ষিণের সীমান্ত দিয়ে ঢোকার সময় সাড়ে ছয় শর বেশি বাংলাদেশিকে আটক করা হয়েছে। এর মধ্যে মেক্সিকো সীমান্তের খরস্রোতা রিও গ্র্যান্ডে নদী পারাপারের সময় মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। এ মৃত্যুর দায় কেউ নিচ্ছে না। অনেক সময় মৃতদেহ নদীতে ভেসে যাচ্ছে। বাংলাদেশের নাগরিকদের এমন মরণ অভিযাত্রা নিয়ে অন্য দেশ ভাবিত হবে—এমন মনে করেন না কেউ। আটক কেন্দ্রে ঠিক কতজন আটকা আছে, তার কোন হিসাব কারও কাছে নেই।
দক্ষিণ সীমান্তে বাংলাদেশিদের অনুপ্রবেশ নিয়ে সংবাদ পরিবেশন করছে ব্রেইটবার্ট ডট কম (www.breitbart.com) নামে একটি নিউজ পোর্টাল। বাংলাদেশিদের অনুপ্রবেশের সংবাদে রক্ষণশীল আমেরিকানদের কান গরম করা সব মন্তব্য দেখলে ঘটনার ভয়াবহতা উপলব্ধি করা যায়। রক্ষণশীল আমেরিকানরা অভিবাসনবিরোধী বক্তব্য রাখতে গিয়ে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশিদের নিয়ে চরম অপমানজনক বক্তব্য রাখছে। কেউ বলছে, বাংলাদেশ এখন জঙ্গি উৎপাদনের কারখানা। জঙ্গিরা বাংলাদেশ থেকে আইএস নামক জেহাদি সংগঠনের অর্থে আমেরিকায় আসছে। কেউ আবার বলছে, বাংলাদেশের মানুষেরা নাকি কম বুদ্ধিমত্তার হয়ে থাকে। কোনোভাবে আমেরিকায় ঢুকে নিউইয়র্কের হোটেল রেস্তোরাঁয় কাজ করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। কেউ বলছে, এসব বাংলাদেশি আমেরিকায় ঢুকে এখানকার ওয়েলফেয়ার সিস্টেমের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার অপেক্ষায়।
ট্রাম্পের চরম অভিবাসনবিরোধী নীতির এই সময়ে বাংলাদেশ থেকে জীবন বাজি রেখে আমেরিকায় আসার হিসাব মিলাতে পারছে না অনেকেই। আমেরিকার লোকজন বলছে, হতদরিদ্র বেপরোয়া এসব বাংলাদেশি দালালকে কেমন করে ২৫/৩০ হাজার ডলার দিতে পারছে। নিশ্চয়ই এর পেছনে আইএসের মতো জঙ্গি গোষ্ঠীর অর্থ সাহায্য রয়েছে।
এর মধ্যে সংবাদ বেরিয়েছে, বাংলাদেশে জঙ্গি গোষ্ঠীর উৎপাদন হলেও সেখানে এখন জঙ্গি তৎপরতা বন্ধ রাখা হয়েছে কৌশলগত কারণে। এদেরসহ রোহিঙ্গা জঙ্গিদের পশ্চিমে পাচার করা হচ্ছে । নেপথ্যে কাজ করছে আইএসের মতো সংস্থা।
বাংলাদেশ থেকে এমন বিপজ্জনক অভিযাত্রা থামছে না কেন—এমন প্রশ্নের উত্তরে মানবাধিকার সংগঠক কাজী ফৌজিয়া প্রথম আলোকে বলেন, একের পর এক ঘটনা ঘটছে, কিন্তু বাংলাদেশ সরকার এ নিয়ে নিস্পৃহ ভূমিকা পালন করছে। তিনি বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন ও জনপ্রতিনিধিদের বিষয়টি নিয়ে সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানান। ফৌজিয়া বলেন, ‘অবৈধ এই মানবপাচারের প্রবাহ থামানোর দায়িত্ব বাংলাদেশ সরকারকেই নিতে হবে। স্থানীয়ভাবে যেসব এলাকায় আদম পাচারকারীরা সক্রিয়, সে সব এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি বাড়াতে হবে। আদম পাচারকারীদের কঠোরভাবে দমন করতে হবে। বিপুল অঙ্কের অর্থ ব্যয় করে আমেরিকায় প্রাণ নিয়ে পৌঁছাতে পারলেও এখন এখানে বৈধতা পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
নিউইয়র্কে নাগরিক অধিকার নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছেন কাজী ফৌজিয়া। তিনি বলেন, ২১ অক্টোবর নোয়াখালীর ছেলে কাজি আবদুল আজিজ ওরফে তারিক মেক্সিকো সীমান্তের নদীতে ভেসে গিয়েছিল। ৫৫ দিন পরে ছেলেটির পূর্ণ পরিচয় পাওয়া গেছে। আইস আর মেডিকেল পরীক্ষকের সহযোগিতায় শনাক্ত করা গেছে তাকে।
ফৌজিয়া আহ্বান জানালেন, ‘আমাদের সবাইকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এমন অভিযাত্রা বন্ধ করতে হবে। আর কত লাশ! এক সীমান্ত থেকেই আমি গত এক বছরে চারটি লাশ পাঠিয়েছি। দয়া করে বেশি টাকা উপার্জনের লোভে দালালের কথায় কেউ নিজের সন্তানকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেবেন না।’