২০০৬ সালের মাঝামাঝি ওয়াশিংটন ডিসির ডুলেস বিমানবন্দরে এসে নামলেন এক তরুণ দম্পতি। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের ছোট একটি মফস্বল শহরে বেডে-ওঠা সংগ্রামী যুবক। স্কুল ফাইনাল পাস করে মাস্টার্সের শেষ অবধি এক যুগ যিনি জীবনকে খুবই কাছাকাছি দেখেছেন। জেনে গেছেন, মানবজীবন নাটকের মঞ্চ নয়, কঠিন বাস্তবতার চিত্রনাট্য। এর মধ্যে ডিভি লটারিতে মিলে গেল স্বপ্নের দেশ আমেরিকায় আসার সুযোগ। সঙ্গে সন্তানসম্ভবা স্ত্রী। অদেখা সূত্র হতে পাওয়া নাম-ঠিকানা লেখা একটি চিরকুট আর মনে দৃঢ় বিশ্বাস। বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা সেরে বাইরে এসে নবাগত অভিবাসী দম্পতি দেখলেন, জীবনে প্রথম দেখা তিনজন অপরিচিত ব্যক্তি। তাঁরাই পরে সব সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার সফল অংশীদার হয়ে রইলেন। একজন হলেন নতুন বাড়িওয়ালা, সঙ্গে তাঁর বন্ধু। তৃতীয়জন পূর্বে বর্ণিত অদেখা সূত্রের সহধর্মিণী। ২২/২৩ ঘণ্টা কষ্টকর বিমানযাত্রা শেষে ভীষণ ক্লান্ত দম্পতি দেশে পাওয়া সূত্রের ব্যক্তির স্ত্রীর সঙ্গে বাসায় যেতে যেতে জানলেন, তাঁদের জন্য ভাড়া বাড়ির ব্যবস্থা হয়েছে। তরুণ দম্পতি দুপুরের খাবার নবপরিচিত ব্যক্তির বাসায় সেরে নতুন ভাড়া বাসায় এলেন বিকেলের দিকে। সঙ্গে বাসার মালিক ও তাঁর বন্ধু। নতুন সংসার গোছানোর এক ফাঁকে নবপরিচিত বন্ধুরা দেখলেন, একটি ব্যাগে চাল–ডাল–মসলাপাতি এমনকি পরিমাণমতো লবণও নিয়ে এসেছেন নতুন আসা দম্পতি। অবাক হয়ে জিজ্ঞাসার আগেই যুবকের ব্যাখ্যা তাঁর মুখেই শোনা যাক।
তরুণ বললেন, ভাই বিদেশ বিভুঁইয়ে অজানা–অচেনা জনবান্ধবহীন অবস্থায় এসেছি। তাই তৈরি হয়েই এলাম। আর কিছু না হোক, দুটো ডাল–ভাত যেন তৈরি করা যায়, তাই এই আগাম ব্যবস্থা। পরদিন থেকে শুরু হলো জীবনসংগ্রাম। তবে তা নিজ দেশে নয়, বিশ্বের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ আমেরিকার রাজধানীর উপকণ্ঠ শহরে। প্রথম চাকরি মিলে গেল বাসার পাশেই স্যান্ডউইচ শপে। কাজের শুরুর দিনই হলো দারুণ এক অভিজ্ঞতা। মালিক সব কাজ বোঝানোর একপর্যায়ে একটি বিশেষ রুম (টয়লেট) সাফ করতে হবে বলে জানিয়ে গেলেন। এসব কাজের অংশ বলে জানালেন। তখন যুবকের বুক ভেঙে কান্না আসার অবস্থা। আমেরিকায় এলাম কি এসব কাজ করার জন্য? কিন্তু না, থেমে যাননি। ওই দিন হয়তো বা পণ করেছিলেন, ওই কাজও করব। তবে একদিন নিজেকে আরও অনেক ওপরের স্তরে নিয়ে যাব।
অল্প কিছুদিনের মধ্যে সুযোগ এসে গেল হাসপাতালের ফুড ডিপার্টমেন্টে কাজ করার। পরিমিত দায়িত্ববোধ নিয়ে সর্বোচ্চ নিয়মানুবর্তিতা মেনে কাজ করায় অল্প সময়ে কাজের জায়গায় ভালো সুনাম অর্জন করলেন।
সকালে হাসপাতালে কাজ করছেন, বিকেলে অন্য জায়গায় খণ্ডকালীন কাজ। এরই মধ্যে রাজকন্যার রূপে ফুটফুটে মা-লক্ষ্মী ঘরে এল। অর্থাৎ তিনি বাবা হলেন। প্রবাসে স্বজনহীন অবস্থায় দুজন পেলেন প্রথম বাবা–মা হওয়ার সাধ। তা কিন্তু এত সহজ ছিল না। তার জন্য সইতে হলো অনেক ধকল। ক্রমে জীবনের রং আরও পাল্টাল। চাকরি জীবনে আরও ভিন্নতা এল। পরিবারের সদস্য সংখ্যা বেড়ে গেল আরও দুজন, স্বল্প সময়ের বিরতিতে ঘরে এল দুই–দুজন পুত্রসন্তান।
তাগিদ বেড়ে গেল বাড়তি রোজগারের। পরিকল্পনা মাফিক শুরু করলেন লেখাপড়া। ঝকঝকে নীল আকাশে একখণ্ড ক্ষ্যাপা কালো মেঘের মতো এক মধ্যাহ্নে দেশ থেকে এল একটি চরম দুঃসংবাদ। ট্রাক দুর্ঘটনায় বড় ভাই চলে গেছেন না ফেরার দেশে। হতভম্ব হয়ে তড়িঘড়ি করে দেশে গেলেন। সব ধরনের আচার–অনুষ্ঠান শেষে যখন আমেরিকা ফিরলেন তখন কাঁধে আরও একটি পরিবারের দেখভাল করার দায়িত্ব। চিন্তিত হলেন, তবে দমে গেলেন না। স্বামীকে যথাসম্ভব সহায়তা দিতে স্ত্রী তিন তিনটি সন্তান দেখভাল করার পাশাপাশি খণ্ডকালীন কাজ করে চেষ্টা করলেন। স্বামী-সংসারের চাপ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পরিশ্রমের মাত্রা যেমন বাড়ালেন তেমনি সুযোগ করে কিনে ফেললেন স্বপ্নের একটি বাড়ি। বিদেশের মাটিতে নিজস্ব একটি বাড়ি অনেক কিছু বটে। তা একমাত্র ভুক্তভোগীরাই বুঝতে পারেন।
পরিচিত কেউ কেউ বাড়ি কেনার সংবাদে পরিশ্রমী এই দম্পতিকে সাধুবাদ জানালেন। কেউবা আবার এই সাফল্যে ভ্রু কুঁচকাতে ভুল করলেন না। এত স্বল্প সময়ে এই সাফল্য অনেকের কাছে বিস্ময় ছিল। কারণ অসৎ পথে থেকে সঠিক স্থানে পৌঁছার রাস্তা অনেকের কাছে শর্টকাট হলেও সৎ লোকের জন্য অনেক পরিশ্রমলব্ধ ও সময় সাপেক্ষ। ইতিমধ্যে দুটি চাকরি করে প্রবাসে ব্যয়বহুল জীবনযাপন করে ও দেশে পরিবার–পরিজনকে যথাসাধ্য দেখভাল করা ছিল নিয়মিত চ্যালেঞ্জ। সুখের বিষয় সংগ্রামী যুবক তার পুরো দায়িত্বকে ইবাদত মনে করে সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় মোটেই পিছপা হলেন না। তথ্যপ্রযুক্তক বা আইটি পেশায় নিজেকে যুক্ত করার অভিপ্রায়ে শুরু করলেন কোর্স। দুইটি কাজ করে এ রকম একটি কোর্স চালিয়ে যাওয়া সহজ কাজ নয়। শুধু প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসের অধিকারী না হলে তা চালিয়ে যাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। প্রয়োজনীয় সময় নিয়ে সাফল্যের সঙ্গে আইটি কোর্স শেষ করলেন নির্দিষ্ট সময়ে। এবার শুরু ভালো একটি চাকরির সন্ধান। এখানে–সেখানে চাকরি হয় কিন্তু বাকি শর্তাবলি আশাব্যঞ্জক না হওয়ায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। এভাবে অনেক জায়গায় নক করতে করতে মিলে গেল কাঙ্ক্ষিত সোনার হরিণ। আমেরিকান সরকারের অভিবাসন সংস্থায় চুক্তিবদ্ধ ভালো অঙ্কের স্থায়ী কাজ। অঙ্কটি নিঃসন্দেহে মাত্র ১০ বছর কাল বসবাসকারী একজন বাংলাদেশি অধুনা আমেরিকান নাগরিকের জন্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণ। সেই সাফল্যের সূত্রে রাজধানীর উপকণ্ঠে তিনটি পরিবার স্বচ্ছন্দে সব সুবিধা নিয়ে বসবাস করতে পারে এমন উন্নত আবাসিক এলাকায় কিনলেন পূর্ণাঙ্গ একটি বিশাল বাড়ি। যিনি একসময় মনে করতেন, মাত্র ১ হাজার ২০০ ডলার মাসে কামাতে পারলে সব অসুবিধা কেটে যাবে। সৃষ্টিকর্তার কী অপার মহিমা! সেই ধৈর্যশীল সৎ পরিশ্রমী ভদ্রলোকের প্রতি সপ্তাহের আয় এখন সেই অঙ্কের কয়েক গুণ। আলহামদুলিল্লাহ, সবই আল্লাহ তায়ালার কুদরতি নিশানা।
পাঠকদের সমীপে ব্যক্তিগত কৈফিয়ত। এই সফল মানুষের জীবন কাহিনি স্বল্প পরিসরে তুলে ধরার মূল উদ্দেশ্য, আমরা যারা কোনো যুক্তিসংগত কারণ ছাড়াই জীবনসংগ্রামে পিছিয়ে আছি, তাদের কেউ যদি সামান্য পরিমাণ উৎসাহিত হন—তাহলে লেখাটি যেমন সার্থক হবে, তেমনি সেই অভিবাসীর জীবনে আসবে সাফ্যল্যের শতভাগ পুরস্কার।