১৯৭১ সালের মার্চ মাস! স্মৃতি যেভাবে মনে আলোড়ন তোলে, যেভাবে উন্মাদনার সৃষ্টি করে, যেভাবে উত্তেজনা তৈরি করে, সেই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করে বোঝাতে পারব না। ঋতুচক্রের আবর্তনে মার্চ মাস এলে প্রথমেই মনে পড়ে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া ৭ মার্চের সেই ঐতিহাসিক ভাষণের কথা। এই আগুন ঝরানো ভাষণ যখনই শুনি, দেহের মধ্যে এক শিহরণ জেগে উঠে, শরীরের লোমকূপে এক ধরনের অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো বিচ্ছুরণ ঘটে। আহ্ কী ভাষণ! কী বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর! কী বিশাল ব্যক্তিত্ব! কী বিচক্ষণতার বহিঃপ্রকাশ!
লাখ লাখ জনতা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে, কখন আসবেন তাঁদের প্রিয় নেতা, কী বলবেন এই হতভাগ্য জাতির জন্য; কী দিক নির্দেশনা অপেক্ষা করছে নির্যাতিত নিপীড়িত বাঙালি জাতির জন্য। বাঙালির পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। অপেক্ষার পালা শেষ। বাঁচার মতো বাঁচা না হলে এ জীবনের কি মূল্য? পরাধীনতার শৃঙ্খল পরে কোনো মর্যাদাসম্পন্ন জাতি বেঁচে থাকতে পারে না! এ শৃঙ্খল ভাঙতেই হবে!
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়ে সরকার গঠনের সুযোগ পায়, কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক জান্তা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে রাজি নয়। যদিও ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের তারিখ নির্ধারিত হয়, কিন্তু ভেতরে-ভেতরে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পশ্চিম পাকিস্তানের নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তাদের নিয়ে ষড়যন্ত্রের নীলনকশা করতে শুরু করেন।
১৯৭১ সালের ১ মার্চ কোনো কারণ ছাড়াই ইয়াহিয়া ৩ মার্চ তারিখের নির্ধারিত অধিবেশন বাতিল করেন। এই সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের ধৈর্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়। সারা দেশে বিক্ষোভের বিস্ফোরণ হয়। ঢাকা পরিণত হয় মিছিলের নগরে। বঙ্গবন্ধু সারা দেশে ৫ দিনের হরতাল ও অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। তাঁর ডাকে সারা পূর্ব পাকিস্তান কার্যত অচল হয়ে পড়ে। সামরিক সরকার কারফিউ জারি করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। কিন্তু এতে আন্দোলন প্রশমিত হয় না। হরতাল শেষে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু তাঁর এই আগুনঝরা ভাষণ দেন। ভাষণের একপর্যায়ে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের মতো হঠাৎ জ্বলন্ত লাভা যেন নির্গত হতে শুরু করল; ‘আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের ওপর (কাছে) আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ।’
কী তেজোদ্দীপ্ত বলিষ্ঠ অঙ্গুলি প্রদর্শন! কী জোরালো হুংকার! মানুষ যখন ঘাটে ঘাটে প্রতারিত হয়, যখন ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়, যখন তার কষ্টার্জিত প্রাপ্যটুকু অন্য কেউ ছিনিয়ে নিতে চায়, তখন যেমন অবস্থা হয়, তারই বহিঃপ্রকাশ এই ভাষণে প্রতীয়মান।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর মনের পুঞ্জীভূত আসল কথাটি মূলত বাঙালি জাতির মনের কথা ভাষণের শেষের দিকে ঘোষণা করলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বাস্তবিকই এই ঘোষণার অপেক্ষাই বাঙালি জাতি করছিল। তাঁর এই ভাষণ গোটা জাতিকে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় উন্মাতাল করে তোলে। ৭ মার্চের এই দিক নির্দেশনা পেয়ে সবাই প্রস্তুত হতে শুরু করে। শহর থেকে সাধারণ মানুষ পরিবার–পরিজন নিয়ে গ্রামমুখী হতে লাগল। আওয়ামী লীগের নেতারা মফস্বল ও গ্রামে গিয়ে সাধারণ মানুষকে সংগঠিত করতে শুরু করলেন। আর পশ্চিমা শাসকেরা গোলাবারুদ সৈন্যসামন্ত পূর্ব-পাকিস্তানে এনে বাঙালি নিধনের নীল নকশা তৈরি করতে লাগল। এই ভাষণের পরই মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বঙ্গবন্ধুর দেওয়া কর্মসূচির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন। আন্দোলন আরও বেগবান হতে থাকে।
সারা দেশ যখন ক্ষোভে উত্তাল, তখন ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসে শেখ মুজিবের সঙ্গে সরকার গঠন ও ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে আলোচনার নামে প্রহসন শুরু করেন। একই সঙ্গে সামরিক বাহিনী পূর্ব-পাকিস্তানে গণহত্যা চালানোর পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে। বেলুচিস্তানের কসাই হিসেবে পরিচিত জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর করে ঢাকায় পাঠানো হল। সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব-পাকিস্তানে সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র আনতে থাকে। ১০ মার্চ থেকে ১৩ মার্চের মধ্যে পাকিস্তান এয়ারলাইনস তাদের সব আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বাতিল করে পূর্ব-পাকিস্তানে জরুরি ভিত্তিতে সরকারি যাত্রী পরিবহনের নামে সাদা পোশাকে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সেনা আনা হয়। গোলাবারুদ ও অস্ত্রশস্ত্র বোঝাই পাকিস্তানি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে এসে ভিড়তে থাকে। বন্দরের নাবিক ও শ্রমিকেরা মালামাল খালাস করতে অস্বীকার করে। এমনিভাবে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের একটি দল বাঙালি প্রতিবাদকারীদের ওপর গুলি চালাতে অসম্মতি জানালে বিদ্রোহ দেখা দেয়। যার মাধ্যমে শুরু হয় বাঙালি সৈনিকদের বিদ্রোহ।
বাঙালি জাতির অনেক আশা সত্ত্বেও মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক সফল হয়নি।
২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান সামরিক বাহিনীকে বাঙালি নিধনযজ্ঞের কুৎসিত, জঘন্য, বর্বরোচিত সিদ্ধান্ত দিয়ে সন্ধ্যায় গোপনে পশ্চিম পাকিস্তানে পালিয়ে যান।
সামরিক বাহিনীর বড় বড় কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠকে ইয়াহিয়া খান ৩০ লাখ বাঙালি হত্যার ঘোষণা দিয়ে যান বলে জানা যায়। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ীই ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তথা কথিত ‘অপারেশন সার্চলাইট’ শুরু করে, যার উদ্দেশ্য ছিল বাঙালির প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে একেবারে স্তব্ধ করে দেওয়া। তখন ঘড়ির কাটা মধ্যরাত পেরিয়ে যাওয়ায় আমাদের স্বাধীনতা ২৬ মার্চ। তারপরই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়।
এরপর পূর্ব বাংলা রেজিমেন্টের মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পক্ষে ২৭ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট থেকে স্বাধীনতা ঘোষণাপত্র পাঠ করেন ও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। মেজর জিয়ার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ তখন স্বাধীনতাকামী মানুষের মাঝে উৎসাহ জোগায়। এমনিভাবে আগুনঝরা মার্চে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়।
কসাইরা যে এত বড় জঘন্য অত্যাচারে লিপ্ত হবে, এটা ছিল বাঙালির কল্পনার অতীত। সর্বত্রই যেমন উত্তেজনা বিরাজ করছিল, তাতে জনমনে স্পষ্ট হয়েছিল যে অঘটন কিছু একটা কসাইরা ঘটাতে পারে। তবে তা যে এত নারকীয় হবে, তা ছিল কল্পনার বাইরে। ওদের কসাই বললে প্রকৃত কসাইদের ছোট করা হবে। পৃথিবীর ইতিহাসে পাকিস্তানি শাসকদের ঘৃণিত কসাই ছাড়া আর কী বলা যায়! অবশেষে ৯ মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে বাঙালি জাতির হাজার বছরের স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয়। জাতি পেল একটি মানচিত্র, একটি পতাকা ও একটা ভূখণ্ড, প্রিয় বাংলাদেশ। পৃথিবী পেল একটি নতুন স্বাধীন দেশ।