পুতিনকে গ্রেপ্তারে পরোয়ানা সির মস্কো সফরে কী প্রভাব ফেলবে

চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন
ছবি: রয়টার্স

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রভাব বাড়াতে জোর তৎপরতা চালাচ্ছে চীন। এরই অংশ হিসেবে কয়েক দিনের মধ্যে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে দেখা করতে মস্কো যাওয়ার কথা রয়েছে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের। এদিকে শুক্রবার সিয়ের এই সফরের ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা পরেই পুতিনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি)। আইসিসির এই পদক্ষেপে চীনের হাঁকডাকে কিছুটা হলেও ভাটা পড়বে।

সম্প্রতি তৃতীয়বারের মতো চীনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন সি চিন পিং। এরপর প্রথম বিদেশ সফরে রাশিয়া যাচ্ছেন তিনি। দিন দিন দুই দেশের সম্পর্ক জোরদার হচ্ছে। কাছে আসার শুরুটা হয়েছিল ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর ঠিক আগ দিয়ে।

দিন কয়েক আগেই চীনের মধ্যস্থতায় কূটনৈতিক সম্পর্ক জোড়া লাগাতে রাজি হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের বৈরী দুই দেশ সৌদি আরব ও ইরান। এ ছাড়া ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে ‘শান্তি পরিকল্পনাও’ দিয়েছে বেইজিং। বিশ্বে নিজেদের অবস্থানকে আরও পোক্ত করতে চীনের এই আটঘাট বেঁধে নামা যখন যুক্তরাষ্ট্র মোটেও ভালো চোখে দেখছে না, তখনই যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে পুতিনকে গ্রেপ্তারে পরোয়ানা জারি করা হলো।

যুক্তরাষ্ট্র আইসিসির সদস্য নয়। তারপরও পুতিনের বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারির সিদ্ধান্তকে ‘যৌক্তিক’ বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তিনি বলেন, ‘পুতিন যে যুদ্ধাপরাধ করেছেন, তা পরিষ্কার।’ আইসিসির ঘোষণায় স্বস্তিতে রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য কর্মকর্তারাও। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র এতদিন বলে আসছিল, ইউক্রেনে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে রাশিয়া। এবার তাদের সঙ্গে সুর মিলিয়েছে আন্তর্জাতিক কোনো সংস্থা।

রাশিয়া বা চীন আইসিসির সদস্য নয়। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেনও আইসিসির রোম সংবিধিতে স্বাক্ষর করেনি। এর অর্থ হলো, চারটি দেশই এই আদালতের বিচারিক ক্ষমতার আওতায় পড়ে না। এমনকি আদালতের আদেশ মানতেও বাধ্য নয়।

পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক যুক্তরাষ্ট্রের দুই কর্মকর্তা বলেন, মার্কিন প্রশাসন মনে করে, রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে নিজেদের বিশ্ববাসীর সামনে আনতে চাচ্ছে চীন। তবে আইসিসি পুতিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনার পর এটা বেইজিংয়ের কাছে আরও কঠিন হয়ে পড়েছে। আর এটা পরোয়ানা জারি যুদ্ধ নিয়ে নিরপেক্ষ থাকা দেশগুলোও অবস্থানে পরিবর্তন আনতে ভূমিকা রাখবে।

পুতিন–সি বৈঠকের গুরুত্ব কতটা

সম্প্রতি তৃতীয়বারের মতো চীনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন সি চিন পিং। এরপর প্রথম বিদেশ সফরে রাশিয়া যাচ্ছেন তিনি। দিন দিন দুই দেশের সম্পর্ক জোরদার হচ্ছে। কাছে আসার শুরুটা হয়েছিল ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর ঠিক আগ দিয়ে। গত বছর শীতকালীন অলিম্পিকের সময় চীন সফরে গিয়ে সির সঙ্গে দেখা করেছিলেন পুতিন। এ সময় তাঁরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ‘সীমাহীন’ এক বন্ধুত্বের।

এরপর থেকেই মস্কোর পাশে রয়েছে বেইজিং। ইউক্রেনে যুদ্ধ নিয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটিও করেনি। এমনকি পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞারও ধার ধারেনি দেশটি। মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, চীন নাকি ইউক্রেন যুদ্ধে ব্যবহারের জন্য রাশিয়াকে সমরাস্ত্র দিতে চাচ্ছে। তবে যুদ্ধ নিয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে কথা না বললেও সরকারি পক্ষেও যায়নি তারা। বলা চলে, নিরপেক্ষ একটি অবস্থানে রয়েছে। এমনকি যুদ্ধ থামাতে শান্তি পরিকল্পনাও দিয়েছে বেইজিং।  

মস্কোতে দুই নেতার মধ্যে বৈঠকে রাশিয়া ও চীনের অংশীদারত্ব আরও জোরদার করার প্রতিশ্রুতি আসবে বলেই মনে করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যুক্তরাষ্ট্র ও দেশটির পশ্চিমা মিত্রদের সামাল দিতে এই অংশীদারত্বকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখছে দেশ দুটি।

মার্কিন কর্মকর্তারা যেমনটা ভয় পাচ্ছেন, তা মিথ্যা প্রমাণিত করে চীন যদি রাশিয়াকে অস্ত্র না–ও দেয়, তারপরও রাশিয়ার কাছে সি চিন পিংয়ের সফরের গুরুত্ব রয়েছে।

আইসিসির গ্রেপ্তারি পরোয়ানার গুরুত্ব কতটা

তাৎক্ষণিকভাবে দেখলে আইসিসির গ্রেপ্তারি পরোয়ানা সি চিং পিংয়ের মস্কো সফর এবং রাশিয়াকে নিয়ে চীনের অবস্থানে বড় কোনো রদবদল আনবে না। রাশিয়া বা চীন আইসিসির সদস্য নয়। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেনও আইসিসির রোম সংবিধিতে স্বাক্ষর করেনি। এর অর্থ হলো, চারটি দেশই এই আদালতের বিচারিক ক্ষমতার আওতায় পড়ে না। এমনকি আদালতের আদেশ মানতেও বাধ্য নয়।
 
আইসিসির সদস্য দেশগুলোতে পুতিন সফরে যাবেন এমন সম্ভাবনাও কম। আর সেসব দেশে গেলেও পুতিনকে তাঁরা গ্রেপ্তার করবে কি না, এমন প্রশ্ন থেকে যায়। গ্রেপ্তার যে করা হয় না অতীতে এমন উদাহরণও রয়েছে। যেমন গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ঘাড়ে নিয়ে সুদানের সাবেক প্রেসিডেন্ট ওমর বশির আইসিসি সদস্য দেশগুলোতে সফর করলেও তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়নি।

তবে এটা ঠিক যে পুতিনকে গ্রেপ্তারে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের ক্ষমতা সীমিত হলেও তা জনমানুষের মনে রাশিয়াবিরোধী প্রভাব ফেলবে। আর যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ বা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা সরিয়ে না নেওয়া পর্যন্ত আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পুতিনের অবস্থান বড় ধাক্কা খাবে।  

বিষয়টিকে যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে দেখছে?

সি চিন পিংয়ের মস্কো সফর নিয়ে মার্কিন কর্মকর্তারা কোনো মন্তব্য করেননি। এর আগে ইউক্রেনে যুদ্ধবিরতি দিতে চীনের আহ্বান নিয়ে হোয়াইট হাউসের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের মুখপাত্র জন কিরবি বলেছিলেন, এই যুদ্ধবিরতির আহ্বান করা হয়েছে রাশিয়ার পক্ষে। এর মাধ্যমে রাশিয়া যুদ্ধক্ষেত্রে নিজেদের অবস্থান নতুন করে সাজিয়ে নেবে।

এদিকে পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাতের পাশাপাশি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে দেখা করতে সি চিন পিংয়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বাইডেনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান। সিয়ের সঙ্গে অলোচনায় বসতে রাজি হয়েছেন জেলেনস্কিও।

রাশিয়া কীভাবে দেখছে?

মার্কিন কর্মকর্তারা যেমনটা ভয় পাচ্ছেন, তা মিথ্যা প্রমাণিত করে চীন যদি রাশিয়াকে অস্ত্র না–ও দেয়, তারপরও রাশিয়ার কাছে সি চিন পিংয়ের সফরের গুরুত্ব রয়েছে। কারণ, তিনি এমন একটা সময় রাশিয়ায় যাচ্ছেন, যখন দেশটিকে একঘরে করতে চাচ্ছে পশ্চিমারা। তাই মস্কোর কাছে সির সফরের অর্থ হলো, চীন তাদের পাশে আছে।
এ নিয়ে ক্রেমলিনের মুখপাত্র ইউরি উশাকভ বলেন, এই সফর পুতিন ও সির ‘বিশেষ বন্ধুত্ব ও বিশ্বাসযোগ্যতার’ একটি বন্ধন। বেইজিংয়ের শান্তি পরিকল্পনার প্রশংসা করে তিনি বলেন, ‘আমরা ইউক্রেন যুদ্ধ ইস্যুতে চীনা নেতৃত্বের সংযত ও ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানের প্রশংসা করি।’

যা বলছে চীন

রাশিয়ায় চীনের প্রেসিডেন্টের সফরের  ঘোষণা দেওয়ার সময় চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মস্কো–বেইজিংয়ের সম্পর্ককে বিশ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে উল্লেখ করেছে। মন্ত্রণালয় বলছে, এই সফর দুই দেশের মধ্যে বিশ্বাস ও বোঝাপড়া আরও জোরদার করবে।

সির সফরকে ‘বন্ধুত্বের যাত্রা’ হিসেবে উল্লেখ করে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, বিশ্ব অশান্তি ও পরিবর্তনের এক নতুন যুগে প্রবেশ করছে। এই সময়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হিসেবে চীন–রাশিয়া সম্পর্কের গুরুত্ব ও প্রভাব দুই দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়বে।