মোদি-বাইডেন বৈঠকে ড্রোন, ৬–জি নিয়েও আলোচনা

নয়াদিল্লির লোককল্যাণ মার্গের সরকারি বাসভবনে শুক্রবার রাতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে বৈঠক করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি
ছবি: ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর টুইট থেকে

ভারত রওনা হওয়ার আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছিলেন, ‘জি-২০-এর অবসরে যতবার আমরা বসি, প্রতিবারই আমাদের আরও ভালো হয়।’ গত শুক্রবার রাতে নয়াদিল্লির লোককল্যাণ মার্গের সরকারি বাসভবনে বাইডেনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক শেষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কণ্ঠেও শোনা গেল সেই সুর। তিনি বলেন, ‘বিশ্বের কল্যাণের জন্য আমাদের দুই দেশের বন্ধুত্ব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।’

মোদি জানিয়েছেন, অনেক কিছু নিয়ে কথা হয়েছে, যার দরুন দুই দেশের অর্থনীতি ও মানুষের মধ্যে সংযোগ বাড়বে। গোটা পৃথিবী তাতে উপকৃত হবে।

প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর জো বাইডেনের এটাই প্রথম ভারত সফর। গত জুন মাসে মোদি যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়েছিলেন। সেই সফরে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে সামরিক ক্ষেত্রে দুই দেশের প্রতিরক্ষা বোঝাপড়া ছিল অন্যতম। সেই দিক থেকে দেখতে গেলে এবার বাইডেনের সফর সেই সব আলোচনারই সম্প্রসারণ ঘটাল। ভারতে তৈরি হালকা যুদ্ধবিমানের ইঞ্জিন তৈরির বিষয়ে জেনারেল ইলেকট্রিক ও ভারতের হিন্দুস্তান অ্যারোনটিকস লিমিটেডের (হ্যাল) মধ্যে অনুচুক্তি এই সফরের পর চূড়ান্তভাবে বাস্তবায়িত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। সে জন্য প্রয়োজনীয় ছাড়পত্র পাওয়া গেছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ড্রোন পাওয়ার বিষয়টিও দুই নেতার মধ্যে আলোচিত হয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে বলা হয়, ৬-জির মতো উচ্চস্তরীয় প্রযুক্তি ক্ষেত্রে সহযোগিতা নিয়েও দুই নেতা আলোচনা করেছেন।

দ্বিপক্ষীয় বিষয় নিয়ে ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতার ক্ষেত্র প্রসারিত হলেও গণতন্ত্র, মানবাধিকার রক্ষা, স্বাধীনতা, বহুত্ববাদ ইত্যাদি বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে অনেক প্রশ্ন ও কিছু আড়ষ্টতা অবশ্যই রয়েছে। মোদির যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময়ই তার বেশ কিছু প্রতিফলন দেখা গিয়েছিল। হোয়াইট হাউসে বৈঠকের পর প্রথামাফিক সংবাদ সম্মেলনে সে বিষয়ে মোদিকে জবাবদিহিও করতে হয়েছিল। সে দেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও ভারতের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার চরিত্র নিয়ে প্রকাশ্যে প্রশ্ন তুলেছিলেন। গত শুক্রবারের বৈঠকেও এই বিষয়গুলোর ওপর যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্ব আরোপ করেছে। দুই দেশের যৌথ বিবৃতিতে রয়েছে সেই আভাস। তাতে বলা হয়েছে, ‘গণতন্ত্র, মানবাধিকার, বহুত্ববাদ, স্বাধীনতাসংক্রান্ত বিষয়ে দুই নেতা সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলার ওপর জোর দিয়েছেন। সব নাগরিকের সমান অধিকার পাওয়ার বিষয়ে সচেষ্ট থাকার কথা বলেছেন। দুই নেতা মনে করেন, দেশের অগ্রগতির ক্ষেত্রে এগুলো প্রয়োজনীয়। দুই দেশের সম্পর্ক আরও জোরালো করার জন্যও তা জরুরি।’

যৌথ বিবৃতিতে এই বিষয়ের অবতারণার মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বুঝিয়ে দিল, এ নিয়ে ভারতকে তারা চাপের মধ্যেই রাখবে। তবে সে জন্য যে তারা প্রকাশ্যে জোরাজুরি করবে না, তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা উপদেষ্টা পরিষদের ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলবিষয়ক সমন্বয়ক কার্ট ক্যাম্পবেল। দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেন, সম্পর্কের ক্ষেত্রে গণতন্ত্র যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক বিষয়, মোদিকে তা বাইডেন আবার মনে করিয়ে দিয়েছেন। তবে তিনি এ কথাও বলেছেন, এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বক্তব্য দেওয়ার পক্ষপাতী নয়। ক্যাম্পবেল বলেন, গণতন্ত্র রক্ষায় বাইডেন যথেষ্ট সজাগ। সম্পর্কের ব্যাপ্তিতে গণতন্ত্র যে অনুঘটক, সে কথা মোদিকে বহুভাবে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে।

যৌথ বিবৃতিতে অবশ্য আধুনিকতম প্রযুক্তি, মহাকাশ গবেষণা ও প্রতিরক্ষার পাশাপাশি অসামরিক পরমাণু ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়ানোর বিষয়টিও রয়েছে। দুই নেতার কথা হয়েছে ‘স্মল মডিউলার’ পরমাণু চুল্লি তৈরির সমন্বয় নিয়েও। নিউক্লিয়ার সাপ্লায়ার গ্রুপ বা এনএসজিতে যুক্তরাষ্ট্র যে ভারতের অন্তর্ভুক্তি চায়, সে কথাও বাইডেন ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছেন।

মোদি গত শুক্রবার তাঁর বাসভবনে তিন অতিথির সঙ্গে বৈঠক করেন। মরিশাসের প্রধানমন্ত্রী প্রবিন্দ জগন্নাথ, শেখ হাসিনা ও জো বাইডেন। শেখ হাসিনার সঙ্গে ঘণ্টা দেড়েক আলোচনার পর বাইডেনের প্রবেশ। ভোট অভিমুখী বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্র নানাভাবে চাপে রেখেছে। বাংলাদেশের সরকার ও শাসক দল আওয়ামী লীগ তার মতো করে সেই চাপ প্রতিহত করছে। ভারত মনে করে, হাসিনা সরকারকে ‘অনাবশ্যক’ চাপ দিলে তা ভারতবিরোধী শক্তি, মৌলবাদী ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাত শক্ত করবে। তাতে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা নষ্ট হবে। ভারত এই মনোভাব যুক্তরাষ্ট্রকে আগেই জানিয়েছে। শুক্রবারের দ্বিপক্ষীয় বৈঠকেও দুই প্রধানমন্ত্রী ‘রাজনীতি ও নিরাপত্তা সহযোগিতা’ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সে বিষয়ে কিছু বলা না হলেও ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে তা স্পষ্ট লেখা হয়েছে। বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে এই অঞ্চলে চীন প্রাধান্য বিস্তার করুক, সেটাও ভারতের কাঙ্ক্ষিত নয়। সেই কারণেই জোরালো জল্পনা, শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকের পর বাইডেনের সঙ্গে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে মোদির কোনো কথা হয়েছে কি না। কোনো মহল থেকেই সে বিষয়ে কোনো ইঙ্গিত অবশ্য এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।