ব্রাজিলের নির্বাচন

ডানপন্থী বলসোনারো নাকি বামপন্থী লুলা—কে ভালো বিকল্প

সাময়িকীর প্রচ্ছদে মুখোমুখি লুলা ও বলসোনারো
 ছবি: এএফপি

ব্রাজিলের প্রথম ধাপের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন থেকে অন্তত দুটি শিক্ষা নেওয়া যেতে পারে। প্রথম, জনমত জরিপ অনেক সময় সঠিক পূর্বাভাস না-ও দিতে পারে। দ্বিতীয়, রাতারাতি বলসোনারো–যুগের অবসান না–ও ঘটতে পারে। খবর দ্য গার্ডিয়ানের।

গত রোববারের প্রথম দফা ভোটের আগে অনেক জরিপে বলা হয়েছিল, ডানপন্থী নেতা ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট জইর বলসোনারোর চেয়ে বামপন্থী প্রার্থী ও দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা অন্তত ১৫ শতাংশ বেশি ভোট পেতে পারেন। এমনকি অনেক জনমত জরিপে লুলার জয়ের সম্ভাবনার কথাও বলা হয়।

বাস্তবে তা হয়নি। প্রথম দফায় লুলা জয়ী হলেও প্রয়োজনীয় ৫০ শতাংশ ভোট পাননি। পেয়েছেন ৪৮ দশমিক ৩ শতাংশ ভোট। বলসোনারো পেয়েছেন ৪৩ দশমিক ৩ শতাংশ। এখন নিয়ম অনুযায়ী, ৩০ অক্টোবর নির্বাচনে দ্বিতীয় দফায় আবার মুখোমুখি হবেন লুলা–বলসোনারো।

বলসোনারোর আমলে ব্রাজিলে প্রায় সাত লাখ মানুষ করোনায় প্রাণ হারিয়েছেন। এ সংখ্যা একক দেশ হিসেবে বিশ্বে দ্বিতীয়। দীর্ঘদিন করোনার ভয়াবহতাকে উপেক্ষা করেছেন তিনি। করোনা রুখতে টিকা প্রয়োজন, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে, মাস্ক পরতে হবে—এসব কথা বিশ্বাস করেন না তিনি।

এদিকে, এই ভোটের (প্রথম দফা) মধ্য দিয়ে অনেকেই ভেবেছিলেন, বলসোনারো–যুগের সমাপ্তি ঘটবে। কিন্তু প্রথম দফার ভোটের ফলাফল প্রমাণ করেছে, ডানপন্থী বলসোনারো তাঁর জনতুষ্টিবাদী মতবাদকে সুসংহত রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে গড়ে তুলেছেন। এই শক্তিকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করা কঠিন।

জনপ্রিয়তার নিরিখে লুলার চেয়ে মাত্র ৫ শতাংশ পয়েন্টে পিছিয়ে রয়েছেন বলসোনারো। প্রথম দফার ভোটের ফলাফল সেটাই প্রমাণ করেছে। তাই বলা যায়, নানা বিতর্কের পরও বলসোনারো এখনো ভোটারদের কাছে, দেশের মানুষের কাছে জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ।

জইর বলসোনারো

এখন ৩০ অক্টোবরের নির্বাচনে দুই প্রার্থীর মধ্যে ব্যবধান কম থাকলে ব্রাজিলে নির্বাচন–পরবর্তী সংঘাত, হতাহতের ঘটনা, অনিশ্চয়তা বেড়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

কয়েক মাস ধরেই ব্রাজিলে নির্বাচনী প্রচারণা চলছে। নিজের জয়ের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী বলসোনারো। তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, চূড়ান্ত জয় তাঁরই হবে। আর কোনোভাবে যদি জয় পেতে ব্যর্থ হন, তবে এর পেছনে দায়ী থাকবে ব্রাজিলের নির্বাচনী ব্যবস্থা এবং নির্বাচনী ও বিচারিক কর্তৃপক্ষ। যদিও কোনো ধরনের প্রমাণ কিংবা যাচাই ছাড়াই বলসোনারো এ কথা বলেছেন। তবে তাঁর সমর্থকদের ৩০ শতাংশই নিজ দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর আস্থাহীন।

লুলার ইমেজও যে একেবারে পরিচ্ছন্ন তা নয়। ক্ষমতায় থাকাকালে তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। ছিল বিতর্ক-সমালোচনা। এমনকি দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগে বিচার হয়েছে তাঁর। সাজা ভোগ করেছেন।

অন্যদিকে লুলার পরাজয় ঘটলে ব্রাজিলের জনগণের বড় একটি অংশ দেশের গণতন্ত্র ও নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর থেকে আস্থা হারাবেন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকদের অনেকে। তাঁদের মতে, ২০০৩ সালে লুলা যখন প্রথমবারের মতো ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট হন, তখন দেশের অর্থনীতি প্রবৃদ্ধির পথে ছিল। এমনকি অর্থনীতিকে ভালো অবস্থানে রেখেই বিদায় নিয়েছিলেন তিনি। তাঁর উদারনীতি সমাজব্যবস্থাকেও প্রভাবিত করেছিল।

বিশ্বের সবচেয়ে বড় আমদানি বাজার চীন। আর সেই বাজারের অন্যতম শীর্ষ সরবরাহকারী ব্রাজিল। আকরিক লোহা থেকে শুরু করে মুরগি—সবকিছুই ব্রাজিল থেকে চীনে রপ্তানি হয়। এ রপ্তানি লভ্যাংশের বড় অংশ সামাজিক উন্নয়ন কার্যক্রমে ব্যয় করেছিল লুলা প্রশাসন। তাঁর আট বছরের শাসনামলে ব্রাজিলের অর্থনীতিতে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছিল। প্রায় চার কোটি মানুষ দারিদ্র্যের কশাঘাত থেকে বেরিয়ে এসেছিল।

লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা

এর ঠিক এক যুগ পর বলসোনারোর ব্রাজিল এখন পুরোপুরি ভিন্ন এক দেশ। গত আট বছরে লাতিন আমেরিকার সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশটির জিডিপি প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক হয়েছে। মানুষের মধ্যে দারিদ্র্যের হার বেড়েছে। বলসোনারো যদিও তাঁর শাসনামলের একেবারে শেষ সময়ে এসে গরিব পরিবারগুলোর জন্য অর্থ সহায়তার হাত বাড়িয়েছেন। তবে প্রয়োজনের তুলনায় তা অপ্রতুল। ভঙ্গুর অর্থনীতি, রপ্তানি খাতে দুর্বলতা—করোনাপরবর্তী সময়ে ব্রাজিলের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে।
 

ব্রাজিল সরকারের হিসাবেই, ২০২৩ সালে দেশটির বাজেট ঘাটতি ১ হাজার ২২৫ কোটি ডলারে ঠেকতে পারে। সরকারের পক্ষে সামাজিক কর্মসূচিগুলো এগিয়ে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে। ফলে দেশটিতে গরিব মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। তাই বলসোনারোর আমলকে অনেকেই ‘সামাজিক পশ্চাৎপদতার আমল’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

বলসোনারোর আমলে ব্রাজিলে প্রায় সাত লাখ মানুষ করোনায় প্রাণ হারিয়েছেন। এ সংখ্যা একক দেশ হিসেবে বিশ্বে দ্বিতীয়। এর পেছনে বলসোনারোর উদাসীনতাকে দায়ী করেন অনেকে। কেননা দীর্ঘদিন করোনার ভয়াবহতাকে উপেক্ষা করেছেন তিনি।

করোনা রুখতে টিকা প্রয়োজন, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে, মাস্ক পরতে হবে—এসব কথা বিশ্বাস করেন না তিনি।

তবে লুলার ইমেজও যে একেবারে পরিচ্ছন্ন তা নয়। ক্ষমতায় থাকাকালে তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতি–অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। ছিল বিতর্ক–সমালোচনা। এমনকি দুর্নীতি–অনিয়মের অভিযোগে বিচার হয়েছে তাঁর। সাজা ভোগ করেছেন। তবে তাঁর আমলে দেশজুড়ে পরিচালিত সামাজিক কর্মসূচি আজও ব্রাজিলবাসীর মনে লুলার প্রতি সম্মান ধরে রেখেছে। অনেকে মনে করছেন, ব্রাজিলের দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বলসোনারোর চেয়ে লুলা ভালো বিকল্প।