এএফপির বিশ্লেষণ

ব্রাজিলের নির্বাচনে শক্তিশালী হয়ে উঠছে ভুয়া তথ্য

ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জইর বলসোনারো ও সাবেক প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা ডি সিলভা
ফাইল ছবি

আগামী ২ অক্টোবর ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই নির্বাচনে প্রধান দুই প্রার্থী বর্তমান প্রেসিডেন্ট জইর বলসোনারো এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা ডি সিলভা। দুই প্রার্থী ইতিমধ্যে জোর প্রচারণা শুরু করেছেন। ভোটের আমেজ লেগেছে সব জায়গায়। তবে এই দুই প্রার্থীর বিষয়ে ভুয়া তথ্য নির্বাচনকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করছে।

ভুয়া তথ্য যাচাই করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ছে প্রচুর ভুয়া খবর, নতুন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্ল্যাটফর্ম তৈরি, এমনকি জটিল আধেয়র কারণে। ব্রাজিলের ভোটে ব্যবহার করা তথ্য পরীক্ষা করে দেখেছে বার্তা সংস্থা এএফপি। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুনের মধ্যে তথ্য যাচাইয়ের পরিমাণ আগের তুলনায় চার গুণের বেশি বাড়িয়েছে তারা।

এখন যারা নির্বাচনের ভুয়া খবর তৈরি করছে, আগে তারা ভিন্ন একটি বিষয়ের ওপর একই ধরনের কার্যক্রম চালাত। সেটা হচ্ছে করোনাভাইরাস।

এএফপিসহ ৪২টি সংবাদমাধ্যমের সমন্বয়ে গঠিত কমপ্রোভা নামের তথ্য যাচাইকরণ প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়কারী সার্জিও লুদতকের দেওয়া তথ্যমতে, সংবাদমাধ্যমগুলোতে আগে করোনা মহামারির তথ্যে আধিপত্য থাকলেও এখন সে জায়গা নির্বাচনের আধেয় দখল করে নিয়েছে। সম্ভবত ভুয়া খবর তৈরির পরীক্ষাকাল ছিল মহামারি। পরে এটি রাজনীতিতে ব্যবহার করা হয়।

নির্বাচনের তারিখ যতই ঘনিয়ে আসছে, এ-সংক্রান্ত তথ্য যাচাই করা ‘অনেক বেশি জটিল’ হয়ে উঠছে চার বছর আগের তুলনায়।

ব্রাজিলের সাও পাওলো ইউনিভার্সিটির ডিজিটাল কমিউনিকেশনের বিশেষজ্ঞ জয়েস সৌজা বলেছেন, করোনার ভুয়া তথ্য নতুন রূপ ধারণ করেছে; যা রাজনীতি, অর্থনীতি, এমনকি বিজ্ঞানের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে।

আগে করোনাভাইরাসের নিরাপদ টিকা নিয়ে মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হয় ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে। এখন ভাইরাল হওয়া ভুয়া তথ্য দেশটির নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর অবিশ্বাস সৃষ্টি করছে। সেটা জনমত জরিপ বা ইলেকট্রনিক ভোটিং—যেটাই হোক না কেন।

ব্রাজিলে একসময় নির্বাচনে ব্যাপক জালিয়াতি হতো। ভোট জালিয়াতি ঠেকাতে ২০০০ সালের নির্বাচনে দেশটিতে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন চালু করা হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান প্রেসিডেন্ট বলসোনারো এটি পছন্দ করেননি। তিনি ব্যালট পেপারে ভোট নেওয়ার আহ্বান জানান।

সর্বশেষ ২০১৮ সালের নির্বাচনে হোয়াটসঅ্যাপে প্রচুর পরিমাণে মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার করা হয়েছিল। যদিও তখন ওই সব ভুয়া তথ্য খুব সহজেই শনাক্ত করা সম্ভব ছিল।

লুদতকে বলেন, ‘আমরা এখন যা দেখি, তা হলো প্রচারিত তথ্যগুলোকে সরাসরি মিথ্যা বলা যাচ্ছে না। কিন্তু এগুলোর ব্যাখ্যা মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি করছে।’

উদাহরণ হচ্ছে, গত মে মাসে একটি টুইট পোস্ট করা হয়। যেখানে জনমত জরিপের জন্য মাত্র এক হাজার জনের মতামত নেওয়া হয়েছিল। জনমত জরিপে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা ঠিক থাকলেও সেখানে যা বলা হয়েছিল, তা অপর্যাপ্ত ও সঠিক ছিল না।

ব্রাজিলের পিইউসি ক্যাথলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য সমন্বয়কারী ও যোগাযোগ–বিশেষজ্ঞ পলিয়ানা ফেরারি বলেন, ভুয়া তথ্য জটিল করা হলো একটি কৌশল। যাতে একসঙ্গে অনেক বেশি বিষয় যুক্ত করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের সন্দেহে ফেলা হয়, যাঁরা বিষয়টি সম্পর্কে অবগত নন।

২০১৮ সালের নির্বাচনের পর থেকে টেলিগ্রাম, টিকটক ও কোয়াইয়ের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। এগুলো চাইলেই ব্যবহারকারীদের মধ্যে দ্রুত এবং ভুয়া ভিজ্যুয়াল কনটেন্ট ছড়িয়ে দিতে পারে। একটি জনমত জরিপে নির্বাচনে বলসোনারোর চেয়ে লুলা ডি সিলভার এগিয়ে থাকার তথ্য উঠে আসে। কিন্তু জরিপের কিছু আধেয় প্রার্থীদের প্রতি জনগণের বিশ্বাস কমানোর লক্ষ্যে বানানো হয়েছে।

সম্প্রতি ব্রাজিলের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘এটি কি নেতার জনমত জরিপ?’ শিরোনামে একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিওতে দেখা যায়, স্টেডিয়ামভর্তি ব্রাজিল ফুটবল দলের সমর্থকেরা ‘লুলা চোর’ বলে চিৎকার করছেন। দেখা গেছে, একটি প্ল্যাটফর্মে এই ভিডিও এক লাখের বেশি বার দেখা হয়েছে। পরে দেখা যায়, ওই ভিডিওর অডিও পাল্টে টিকটকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

ফেরারি বলেন, টিকটক বিভ্রান্তিকর তথ্য দ্রুত ছড়িয়ে দেওয়ার প্রতীক হয়ে উঠেছে, যা সত্যি হাস্যকর। এটি ভাইরাসের মতো, যা শ্রবণশক্তিকে কলুষিত করে, দৃষ্টিকে বিকৃত করে এবং একটা সময় মনের মধ্যে গেঁথে যায়।

ব্রাজিলের প্রধান ইলেকটোরাল ট্রাইব্যুনালের সাম্প্রতিক নথিতে দেখা গেছে, ‘মিথ্যা বা অপ্রাসঙ্গিক তথ্য যেকোনো কিছুর মানের মূল্যায়নকে প্রভাবিত করে। মানুষকে ভুল এবং পূর্বধারণার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে।’

সাও পাওলো ইউনিভার্সিটির ডিজিটাল কমিউনিকেশনের বিশেষজ্ঞ জয়েস সৌজা বিশ্বাস করেন, এসব আধেয় সমাজের যৌক্তিক আলোচনাকে ধ্বংস করে এবং জনসাধারণের আলোচনায় ঘৃণাকে প্রাধান্য দেয়।

সার্জিও লুদতকে বলেন, সমস্যা হলো, পরিশীলিত ভুয়া তথ্য দীর্ঘস্থায়ী হয়। সম্ভবত সমাজের কিছু ক্ষেত্রে এগুলো থেকেও যায়।