সোনার বিনিময়ে এই খনিতে বিক্রি হয় যৌনতা

ব্রাজিলের অবৈধ সোনার খনিগুলোতে কতজন শ্রমিক কাজ করেন, তা কেউ জানেন না। ব্রাজিল সরকার বলেছে, এ সংখ্যা ৮০ হাজার থেকে ৮ লাখ হবে।
ফাইল ছবি: রয়টার্স

ডায়ান লেইত কখনো যৌনকর্মী হতে চাননি। কিন্তু হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে যখন তাঁর স্বামী মারা যান, তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৭ বছর। স্বামীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ব্যয় বহন করার মতো সামর্থ্য তাঁর ছিল না।

ডায়ান ব্রাজিলের উত্তরের ‘পারা’ রাজ্যের ইতাইতুবা শহরের বাসিন্দা। এ শহর দেশটির অবৈধ সোনার খনি বাণিজ্যের কেন্দ্রে অবস্থিত। ডায়ানকে তাঁর একজন বন্ধু অর্থ আয় করতে আমাজনের গভীরে  সোনার খনি এলাকায় গিয়ে একজন যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করার পরামর্শ দেন। সেখান অনেক খনিশ্রমিক থাকেন।

ডায়ান বলেন, ‘খনিতে যাওয়া খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। সেখানে নারীদের মারাত্মকভাবে অসম্মানিত করা হয়। তাঁদের চড়থাপ্পড় মারা ও গালিগালাজ করা হয়। সেখানে একদিন আমি আমার শোয়ার ঘরে ঘুমিয়েছিলাম। এক ব্যক্তি জানালা দিয়ে লাফিয়ে আমার ঘরে ঢুকে মাথায় বন্দুক তাক করেন। যদিও তাঁরা অর্থ দেন, তবে নারীদের সঙ্গে এমন আচরণ করেন, যেন কিনে নিয়েছেন।’

খনির পরিবেশগত ক্ষতির কথা সবাই জানেন। এর যে মানবিক ক্ষতি, তার কথা খুব একটা বলা হয় না। জাতিসংঘ বলেছে, খনি ঘিরে সহিংসতা, যৌন নিপীড়ন, মানব পাচারসহ নানা নৃশংস ঘটনা ঘটে।

বন্ধুর পরামর্শে ডায়ান আমাজনের গহীনে গিয়ে মৃত স্বামীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার খরচ জোগাড় করতে পেরেছিলেন। ১৮ বছর বয়সে তিনি প্রথম সন্তানের জন্ম দেন। ১৬ বছর ধরে ইতাইতুবার অন্য অনেক নারীর মতো তিনিও মাঝেমধ্যে খনিতে গেছেন। সেখানে কখনো রান্নার কাজ, কখনো ধোপার কাজ, কখনো মদের দোকানের কর্মী, কখনো–বা যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করেছেন। এখন তাঁর পরিবারের সাত সদস্য নিজের আয়ের ওপর নির্ভরশীল।

প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি খনিতে ২৪ বছর বয়স থেকে যৌনকর্মীর কাজ করতেন নাতালিয়া কাভালকানতে। তিনি বলেন, ‘আমি বলছি না যে এই শহরের সব নারী এ কাজ করেন। তবে তাঁদের একটি বড় অংশ যৌনকর্মী। তাই এ কাজ এখানে অনেকটাই স্বাভাবিক। আমরা এটাকে তেমন গুরুত্ব দিই না।’

খনিতে যৌনকর্মী হিসেবে কাজ শুরুর চার বছর পর নাতালিয়া একটি মদের দোকানের মালিককে বিয়ে করেন। তারপর একটি যৌনপল্লি চালাতে শুরু করেন। তবে সম্প্রতি এ কাজ ছেড়ে দিয়েছেন তিনি।

আমাজনের গভীরে খনি শ্রমিকদের গ্রামগুলোতে কঠিন জীবনসংগ্রাম করতে হয়। অধিকাংশ গ্রামে মাটির রাস্তা, ছোট মদের দোকান ও একটি গির্জা ছাড়া তেমন কিছু নেই। শ্রমিকদের অবস্থাও খারাপ। তাঁরা কাঠ ও ক্যানভাস দিয়ে তৈরি খুপরি ঘরে থাকেন। চারপাশে লুকিয়ে থাকে বিষধর সাপ। থাকে চিতাও। জেনারেটর বন্ধ হয়ে গেলে পুরো এলাকা অন্ধকারে ঢাকা পড়ে। যেসব নারী রান্নার কাজ করেন, তাঁদের শিবিরের (ক্যাম্প) ভেতর পুরুষদের পাশাপাশিই থাকতে হয়।

খনিতে যাওয়া খুব ঝুঁকিপূর্ণ। সেখানে নারীদের মারাত্মকভাবে অসম্মানিত করা হয়।
ডায়ান লেইত, যৌনকর্মী

নাতালিয়া বলেন, খনির শ্রমিকেরা যখন সোনা খুঁজে পান বা তাঁদের হাতে খরচ করার মতো অর্থ আসে, তখন গ্রামে আসেন।

ব্রাজিলের আইনে যৌনপল্লি চালানো অবৈধ। নাতালিয়া দাবি করেন, এ কাজের জন্য তিনি কোনো কমিশন নিতেন না। শুধু দোকানকর্মী নিয়োগ ও কক্ষভাড়া দিতেন। তরুণীরা তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে কাজ চাইতেন এবং মাঝেমধ্যে তিনি আমাজনে যাওয়ার জন্য তাঁদের অর্থ ধার দিতেন। ইতাইতুবা থেকে আমাজনে পৌঁছাতে সড়কপথে সাত ঘণ্টা ভ্রমণ করতে হয়।

আমাজনে যৌনকর্মীর কাজে অন্য নারীদের সম্পৃক্ত করা নিয়ে তাঁর মধ্যে কোনো খেদ আছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে নাতালিয়া বলেন, ‘কখনো মনে হয় আমার খেদ আছে এবং আমি জানি, এটা ভালো কিছু নয়। কিন্তু তারপর আমার মনে হয়, তরুণীদের পরিবার আছে, কারও কাঁধে সন্তান বড় করার দায়িত্বও থাকে।’

বিয়ের আগেই নাতালিয়া প্রচুর অর্থ আয় করেন। এখন ইতাইতুবায় তাঁর বাড়ি আছে, একটি মোটরবাইক আছে এবং যথেষ্ট পরিমাণে সোনা তাঁর হাতে মজুত আছে। অনেক সময় খনির শ্রমিকেরা শারীরিক সম্পর্ক করার পর অর্থের বদলে সোনা দিতেন। নাতালিয়া এখন লেখাপড়া করে একজন উকিল বা প্রকৌশলী হতে চান।

আমি বলছি না যে এ শহরের সব নারী এ কাজ করেন। তবে তাঁদের একটি বড় অংশ যৌনকর্মী। তাই এ কাজ এখানে অনেকটাই স্বাভাবিক। আমরা এটাকে তেমন গুরুত্ব দিই না।
নাতালিয়া কাভালকানতে, সাবেক যৌনকর্মী

ইতাইতুবার অনেক নারী যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করে উপার্জিত অর্থ দিয়ে পরে নিজের ব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু খুব সহজে তাঁরা এমন জীবন পাননি। বড় ঝুঁকি মাথায় নিয়ে এসব নারীকে খনির শ্রমিকদের ভয়ংকর ও আইনকানুনবিহীন গ্রামগুলোতে যেতে হয়েছে।

আবার খনির পরিবেশগত ক্ষতির কথা সবাই জানেন। এর যে মানবিক ক্ষতি, তার কথা খুব একটা বলা হয় না। জাতিসংঘ বলেছে, খনি ঘিরে সহিংসতা, যৌন নিপীড়ন, মানব পাচারসহ নানা নৃশংস ঘটনা ঘটে।

মূল্যবান ধাতুর কেনাবেচা করেন এমন একজন বলেন, আমাজনের এসব অবৈধ খনি থেকে পাওয়া সোনা সাধারণত বৈধ কোনো খনির নামে বিদেশে রপ্তানি করা হয়।

ব্রাজিলের সোনার প্রধান তিন ক্রেতা দেশ কানাডা, সুইজারল্যান্ড ও যুক্তরাজ্য।
গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ‘ইনস্টিটুটো এসকোলহাস’ বলেছে, ইউরোপে রপ্তানি হওয়া ৯০ শতাংশের বেশি সোনা অবৈধ খনি থেকে আসে।

অর্থ উপার্জন করতে খনির শ্রমিকদের গ্রামগুলোতে যাওয়া সব নারী অর্থ নিয়ে ফিরতে পারেন না; বরং কাউকে কাউকে সেখানে গিয়ে প্রাণ হারাতে হয়। ২৬ বছরের তরুণী রাইএলে সান্তোসের লাশ গত বছর তাঁর ঘরের ভেতর থেকে উদ্ধার হয়। ইতাইতুবা থেকে সড়কপথে ১১ ঘণ্টার দূরত্বে তুই-তুই সোনার খনির কাছে বসবাস করতেন রাইএলে।

রাইএলের বড় বোন রাইলানে বলেন, এক ব্যক্তি অর্থের বিনিময়ে তাঁর বোনের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করতে চেয়েছিলেন কিন্তু রাইএলে রাজি হননি। পরে ওই ব্যক্তি রাইএলেকে খুঁজে পিটিয়ে মেরে ফেলেন। তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিদিন অনেক নারী মারা যান, অনেক নারী। আমার জন্ম খনিতে, খনিতে বড় হয়েছি এবং এখন খনিতে বসবাস করতে ভয় পাই।’

ব্রাজিল সরকার অবৈধ খনি বন্ধ করতে ও এসব খনি থেকে উত্তোলিত সোনার ক্রয়-বিক্রয় আটকাতে চাইছে। কিন্তু মূল্যবান এ ধাতুর মূল্য দিন দিন যেভাবে বাড়ছে, তাতে মানুষ নিজের ভাগ্য যাচাই করতে সোনার সন্ধানে খনিতে যাচ্ছেন।

রাইএলেকে হত্যার অভিযোগে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে কিন্তু তাঁর বিচার শেষ হয়নি। গ্রেপ্তার ব্যক্তি তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

২০২৩ সাল পর্যন্ত গত ১০ বছরে ব্রাজিলে অবৈধ সোনার খনির আকার প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। সেগুলোর আকার এখন প্রায় ২ লাখ ২০ হাজার হেক্টর। সেখানে কতজন নারী কাজ করেন, তা কেউ জানেন না। কতজন অবৈধ খনি শ্রমিক রয়েছেন, সে তথ্যও কারও হাতে নেই। ব্রাজিল সরকার বলেছে, এ সংখ্যা ৮০ হাজার থেকে ৮ লাখ হতে পারে।

প্রেসিডেন্ট লুলা দ্য সিলভার প্রশাসন অবৈধ এসব খনি বন্ধে ও এসব খনি থেকে উত্তোলিত সোনা ক্রয়-বিক্রয় আটকাতে নানা উদ্যোগ নিচ্ছে। কিন্তু মূল্যবান এ ধাতুর মূল্য দিন দিন যেভাবে বাড়ছে, তাতে মানুষ নিজের ভাগ্য যাচাই করতে সোনার সন্ধানে খনিতে যাচ্ছেন।

ব্রাজিলের অবৈধ সোনার খনিগুলো ঘিরে এভাবেই বসবাস করেন খনিশ্রমিকেরা

উচ্চ ঝুঁকির কারণে ডায়ানও আর খনি এলাকায় কাজে যেতে চান না। কিন্তু তিনি শেষবারের মতো আরেকবার সেখানে যেতে চান এবং দুই-তিন মাসে এতটা অর্থ উপার্জন করতে চান, যেন ফিরে এসে একটা খাবারের দোকান দিতে পারেন। তবে তিনি এ-ও বুঝছেন, ঝুঁকির কারণে হয়তো তিনি এতে সফল হতে পারবেন না।

আমাজনের ঘন জঙ্গলের ভেতর একা হেঁটে যাওয়ার সময় ডায়ান বাড়িতে থাকা তাঁর সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। আশা করেন, একদিন সন্তানেরা তাঁর কষ্ট ও সংগ্রামের কথা বুঝতে পারবে।