ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলা মাদুরো
ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলা মাদুরো

ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন

তৃতীয় মেয়াদে মাদুরোর ফেরা না কি, গণতান্ত্রিক প্রত্যাবর্তন

ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন আজ রোববার। তৃতীয় মেয়াদে মাদুরোকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন সাবেক কূটনীতিক এডমান্ডো গঞ্জালেজ।

নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য আজ রোববার ভোট দিচ্ছেন ভেনেজুয়েলাবাসী। এতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট নিকোলা মাদুরো ও তাঁর প্রতিপক্ষ এডমান্ডো গঞ্জালেজ উরুতিয়ার মধ্যে। গত বৃহস্পতিবার ছিল নির্বাচনী প্রচারের শেষ দিন। মাদুরোর সরকারি দল রাজধানী কারাকাসের রাস্তায় হাজার হাজার মানুষকে নিয়ে নির্বাচনী সমাবেশ করে তাদের শক্তিমত্তা জানিয়েছে।

এবারে তৃতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হতে লড়ছেন মাদুরো। গত বৃহস্পতিবার তিনি শহরের রাস্তায় বিশাল জনসমাবেশের আয়োজন করেন। জমকালো আয়োজনের মধ্যেই তিনি নির্বাচনী বক্তৃতা করেন তিনি। মাদুরো বলেন, বিরোধীরা সহিংসতার প্রচার করছে। তিনি বলেন, একমাত্র তিনিই ভেনেজুয়েলার শান্তি ও স্থিতিশীলতা রাখতে পারেন। তিনি বলেন, দশজন প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর কে শান্তি ও স্থিতিশীলতার নিশ্চয়তা দিতে পারেন?

নির্বাচনী সমাবেশে এ বক্তব্য রাখলেও গত সপ্তাহে মাদুরো হুমকি দিয়ে বলেছেন, নির্বাচনে তিনি হেরে গেলে ‘রক্তস্নান’-এর প্রয়োজন হবে। তাঁর এ বক্তব্যের সমালোচনা করেছিলেন ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা দা সিলভা। ব্রাজিলের নির্বাচনী আদালত ও সাবেক আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট আলবার্তো ফার্নান্দেজ গত বুধবার বলেন, তাঁরা ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠাবেন না।

মাদুরোর সমর্থকেরা বলে থাকেন, মাদুরোই প্রেসিডেন্ট হিসেবে পূর্বসূরি হুগো চাভেজের উত্তরাধিকার অব্যাহত রেখেছেন এবং তিনি দরিদ্রদের জন্য একজন চ্যাম্পিয়ন হিসেবে রয়ে গেছেন।

মাদুরোকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন সাবেক কূটনীতিক এডমান্ডো গঞ্জালেজ। তিনি নতুন সক্রিয় জোটের প্রতিনিধিত্ব করছেন। গঞ্জালেজ বলেন, ভোটের ফল যা-ই হোক না কেন, তিনি আশা করেন, সেনাবাহিনী তাঁর প্রতি সম্মান দেখাবে। দেশটির সেনাবাহিনী দীর্ঘদিন ধরে মাদুরো ও এর আগে চাভেজের সমর্থক। তবে দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেছেন, সেনাবাহিনী জনরায়কে সম্মান জানাবে।

দেশটির আদালত কথিত জালিয়াতির অভিযোগে বিরোধী নেতা মারিয়া করিনা মাচাদোকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার অযোগ্য ঘোষণা করেন। নির্বাচনে অংশ নিতে না পেরে মাচাদোর জোট দেশটির সাবেক কূটনীতিক এডমন্ডো গঞ্জালেজকে সমর্থন দেয়। তিনি বলেন, শান্তিপূর্ণ ভোটে জয়ের আশা করছেন তিনি।

মাদুরোর সরকারের অধীনে ভেনেজুয়েলায় অর্থনৈতিক পতন, জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশের অভিবাসন এবং কূটনৈতিক সম্পর্কের প্রচণ্ড অবনতির মুখোমুখি হয়েছে। দেশটি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়েছে। এতে তেলসমৃদ্ধ দেশটির অর্থনীতি আরও বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে।

গত এপ্রিল মাসে মাদুরোর বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক নির্বাচন নিশ্চিত করতে বিরোধীদের সঙ্গে চুক্তি প্রত্যাহার করার অভিযোগ এনে ভেনেজুয়েলার তেলের ওপর যুক্তরাষ্ট্র নতুন নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ভোট স্থানীয় সময় সকাল ১০টায় শুরু হবে এবং সন্ধ্যা ৬টায় শেষ হবে।

মাদুরোর সরকার ভেনেজুয়েলার সব সরকারি প্রতিষ্ঠানকে নিয়ন্ত্রণ করে। তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে অতীতে ভোটে কারচুপির অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয় বেসরকারি সংস্থাগুলোর অভিযোগ, ৪ জুলাই থেকে বিরোধী নির্বাচনী প্রচারে যুক্ত থাকায় ৭০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে সরকার। তারপরও কারাকাসে অনিশ্চয়তা থেকে গেছে। বিরোধীরা নব-উদ্যমে বিভিন্ন স্থানে প্রচার করেছে। এডমান্ডোর প্রচারে ভেনেজুয়েলা ও দেশের বাইরে ব্যাপক সমর্থন এসেছে। বলা হচ্ছে, দেশটির গত ২৫ বছরের নির্বাচনী ইতিহাসে এবার সরকার সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়তে যাচ্ছে।

বিরোধীদের অভিযোগ, ভেনেজুয়েলা যে বাজে অর্থনৈতিক অবস্থায় পড়েছে এর কারণ, মাদুরোর নীতি ও ধারাবাহিক দুর্নীতি। তবে মাদুরোর দাবি, তাঁর দেশ অর্থনৈতিক যুদ্ধের শিকার। এর মধ্যে রয়েছে দেশটির তেলের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি।

নির্বাচনে গঞ্জালেজ জিতলে অবশ্য ভেনেজুয়েলার পরিস্থিতি বদলাতে পারে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র যদি ভেনেজুয়েলাকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলে মেনে নিয়ে নিষেধাজ্ঞা তুলে দেয়, তবে দেশটির অর্থনীতি ফিরতে পারে। দেশটিতে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তেল সংরক্ষিত রয়েছে। গঞ্জালেজ বলেন, তিনি ভেনেজুয়েলাকে আমেরিকার জ্বালানি হাব গড়ে তুলতে চান।

আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, ভেনেজুয়েলার নির্বাচনের ফলাফল পুরো আমেরিকায় পড়তে পারে, যার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রও রয়েছে। বিশেষ করে অভিবাসনের বিষয়টি এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। যেহেতু ভেনেজুয়েলার অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে, ভেনেজুয়েলার প্রায় ৮০ লাখ নাগরিক ইতিমধ্যেই তাঁদের দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে অনেকেই দক্ষিণ আমেরিকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছেন।

ভেনেজুয়েলার জরিপকারী প্রতিষ্ঠান ওআরসি কনসালটোরস জানায়, সম্প্রতি এক জরিপে দেখা গেছে, মাদুরো জিতলে দেশটির ১৮ শতাংশ নাগরিক দেশ ছাড়ার কথা বলেছেন। অন্যদিকে, গঞ্জালেজ জিতলে তা হবে দেশটির জন্য একটি ইতিহাস। এতে লাতিন আমেরিকার ভূরাজনৈতিক পেন্ডুলাম আরও নড়ে উঠবে।

মাদুরো সরকার চীন, ইরান ও রাশিয়া-ঘনিষ্ঠ। তাদের আরেক মিত্র কিউবা। মায়ামি থেকে মাত্র ১ হাজার ৪০০ কিলোমিটার দূরের কারাকাস অনেক সময় ওয়াশিংটনের উঠানে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের বিচরণক্ষেত্র বলে ধরা হয়।

গঞ্জালেস অন্যদিকে কূটনীতিক হিসেবে অভিজ্ঞ। তিনি এ অঞ্চলের চিত্র বদলে দিতে পারেন। যুক্তরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক মিত্রদের সঙ্গে তিনি নতুন করে সম্পর্ক গড়তে পারেন। এর বাইরে তিনি আইএমএফ, বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে দেশের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ আনতে পারেন।

বর্তমানে ভেনেজুয়েলার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, যেমন সুপ্রিম কোর্ট বা অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসের মতো বিষয়গুলো রাষ্ট্রীয় আস্থাভাজনদের নিয়ন্ত্রণে। গঞ্জালেজ বলেছেন, তিনি এসব প্রতিষ্ঠান রাজনীতিমুক্ত করবেন এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় কারাগারে থাকা নেতাদের মুক্তি দেবেন।

সাম্প্রতিক বছরগুলোকে গণতন্ত্রের সংকট হিসেবে দেখা হচ্ছে। ব্রেক্সিট থেকে ইউরোপে নিওফ্যাসিজমের উত্থান; ভারতের গণতন্ত্রের ক্ষয়, তুরস্ক, ফিলিপাইন এবং সমগ্র দক্ষিণ বিশ্বে গণতন্ত্রের অবক্ষয় থেকে শুরু করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের উত্থান ঘটছে। তবে কারাকাসে একটি নতুন ভোর প্রমাণ করতে পারে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র—এখনো যাঁরা এটি উপভোগ করেন না, তাঁদের কাছেও যথেষ্ট আকর্ষণীয় হতে পারে।