উন্নত জীবনের আশায় ক্যামিলো কন্ডিসের পরিবারের প্রায় সবাই কমিউনিস্ট কিউবা ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্র চলে গিয়েছিল। পরিবারের যে কজন কিউবাতে ছিল, তাদের একজন ৩২ বছরের কন্ডিস। বছর দশেক আগে রাউল কাস্ত্রো কিউবার প্রেসিডেন্ট হন। পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দিয়েই এসেছিলেন রাউল। আর তাতে আস্থা রেখেই ক্যামিলো দেশে থেকে যাওয়াই মনস্থ করেছিলেন।
ক্ষমতায় এসে কিছু সংস্কারের পদক্ষেপ নেন কিউবার বিপ্লবী নেতা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট ফিদেল কাস্ত্রোর ভাই রাউল। বাজার ব্যবস্থার সংস্কার করেছিলেন। সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করেছিলেন চিরশত্রু যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে। কিউবার নাগরিকদের বিদেশও যাওয়া-আসা সহজ করেছিলেন। ব্যক্তিগত সম্পত্তি রাখার অধিকার দেওয়া শুরু হয়। সুযোগ সৃষ্টি হয় মোবাইল ফোন ও কম্পিউটার ব্যবহারের। ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগও বাড়ে।
২০১১ সালে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন কন্ডিস। ঠিক ওই বছরই রাউল তাঁর সংস্কারের ঘোষণা দেন। কন্ডিস এখন রাজধানী হাভানায় একটি ভাড়া করা ফ্ল্যাটে থাকেন। কাজ করেন রেস্তোরাঁয়। বেশ সচ্ছল জীবনই তাঁর। প্রতিদিন সাগরের ঢেউয়ে সার্ফিং করেন। ক্যারিবীয় দ্বীপগুলোয় হুটহাট বেড়াতে চলে যান।
প্রেসিডেন্ট রাউল এ সপ্তাহেই তাঁর পদ ছাড়ছেন। নতুন প্রজন্মের কমিউনিস্ট নেতৃত্বের হাতে তিনি ক্ষমতা ছাড়বেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। এখন সেই কন্ডিস কিউবার ভবিষ্যৎ নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন। তিনি বলছিলেন, ‘এখানেই একটি ভালো ভবিষ্যৎ তৈরি করব। কিন্তু এখন একটা অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে।’
কিউবার বেশির ভাগ মানুষের মতো কন্ডিসের দুর্ভাবনা দেশটির ভঙ্গুর অর্থনীতি। কিউবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক অর্থনীতিবিদ পাভেল ভিদাল বলছিলেন, ১৯৮৫ সালের তুলনায় কিউবার অর্থনীতির আকার এক-তৃতীয়াংশ ছোট হয়ে এসেছে। ওই সময় দেশটির মিত্র দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে সহায়তা মিলত। এখন সেই সুযোগ নেই।
অসুস্থ ভাই ফিদেলের কাছে থেকে রাউল ক্ষমতা নেন ২০০৮ সালে। একদলীয় শাসন বহাল রেখেই তিনি কিছু সামাজিক স্বাধীনতা দিতে শুরু করেন তিনি। তিনি যখন ক্ষমতায় এলেন, অনেকেই এমন ভেবেছিল যে আরেক ফিদেল কাস্ত্রো ক্ষমতায় বসলেন। তবে এরপরও তাঁর সংস্কারে আশাবাদী হয়ে উঠেছিলেন অনেকে। এঁদের একজন সাবেক কূটনীতিক কার্লোস আলজুগারে। তিনি বলেন, ‘তিনি ঠিক পথই ধরেছিলেন। প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কারে হাত দিয়েছিলেন। তবে তিনি প্রাচীন ধ্যানধারণার পরিবর্তন করতে পারেননি।’
কিউবার দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি মানুষের মাসিক গড় আয় ৩০ ডলার। এরা কাজ করে বিভিন্ন অদক্ষ রাষ্ট্রীয় খাতে। তবে মাথাপিছু আয় কম হলেও শিক্ষা, চিকিৎসা সেখানে বিনা মূল্যে মেলে। খাদ্য ও আবাসন খাতেও রয়েছে রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি।
অর্থনীতির সংস্কারে বেশির ভাগ সুবিধা মিলেছে বেসরকারি খাতে। রাজধানী হাভানা এবং শহরাঞ্চলেই এর ছোঁয়া পাওয়া গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্কের ফলে বিশেষ করে হাভানায় পর্যটন খাতের বিকাশ ঘটেছে। তবে গত বছর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কিছু সুযোগ সংকুচিত করার ঘোষণা দেওয়ার পর হাভানাতেও এতে ব্যত্যয় হয়। আরোপ করা হয় নতুন নিয়ন্ত্রণ।
গত এক দশকে কিউবার অর্থনীতি বার্ষিক ২ দশমিক ৪ শতাংশ হারে বেড়েছে। কিউবার রাষ্ট্রীয় পরিসংখ্যান অন্তত তা-ই বলছে। ২০১৪ সালে কিউবার সরকার জানায়, দেশের উন্নতির জন্য বার্ষিক ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি দরকার। ক্ষমতায় আসার পর পতিত জমি ইজারা দেওয়া শুরু করেন। সম্প্রসারণ করেন বেসরকারি খাতের। স্বনিয়োজিত ব্যক্তির সংখ্যা তিন গুণ বেড়ে দাঁড়ায় ৫ লাখ ৮০ হাজারে। চীনের আদলে গড়ে তোলেন শিল্পপার্ক। নতুন আইন করে বিদেশি বিনিয়োগের ওপর থেকে কর কাটছাঁট করেন। বৈশ্বিক বাজারে নতুন করে প্রবেশের জন্য বৈদেশিক ঋণের পুনঃ তফসিলের প্রচেষ্টা চালান। পর্যটন ফুলেফেঁপে ওঠে। বাড়ে বৈদেশিক আয়ের পরিমাণ। ক্ষুদ্র ব্যবসার সুযোগ পায় কিউবার মানুষ।
তবে এসব সুযোগ কিন্তু সীমিত থেকেছে শহরাঞ্চলে। গ্রামীণ কিউবা কিন্তু এখনো উন্নয়নের ছোঁয়াবঞ্চিত। এক দশক ধরে কৃষি উৎপাদন প্রায় স্থবির হয়ে আছে। এখনো দেশটি ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ খাদ্যসামগ্রী আমদানি করে। কৃষক মারিও ক্রুজাতা বলছিলেন, ‘আমাদের উন্নত ধরনের সেচব্যবস্থা দরকার।’
আসলে সংস্কারের ফলে সেবা খাত উন্নত হলেও বেসরকারি বাণিজ্য, যেমন পাইকারি বাজারের অভাব আছে। আমদানি-রপ্তানির অবাধ সুযোগও নেই। স্বনিয়োজিত কাজের ক্ষেত্রও এখানে সীমিত। রেস্তোরাঁ, বিছানা তৈরি, সকালের খাবার তৈরির মতো জনপ্রিয় ব্যবসার নিবন্ধন গত বছর থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
তবে এসব নিয়ন্ত্রণের পরও বিশ্লেষকেরা মনে করেন, দলের ভেতর ও বাইরে তাঁর পরিবর্তনের চেষ্টা দীর্ঘ মেয়াদে সুফল দেবে। আমেরিকান ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক উইলিয়াম লিওগ্রান্দে বলেন, ‘রাউলের উত্তরসূরিরা যদি তাঁর সংস্কারের পথ ধরে হাঁটতে থাকেন, তবে রাউল কিউবার দেং জিয়াও পিং হয়ে থাকবেন। দেং চীনের অচলায়তন ভেঙেছিলেন। তবে সংস্কার যদি থমকে দাঁড়ায়, তাঁকে কেবল একজন সংস্কারবাদী কমিউনিস্ট হিসেবে গণ্য করা হবে; যথেষ্ট চেষ্টা থাকা সত্ত্বেও প্রথাগত ব্যবস্থার কোনো পরিবর্তন যিনি আনতে পারেননি।’