পেরুতে এক উত্তেজনাকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে। কারণ, দেশটিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর ২১ দিন পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত কোনো প্রার্থীকে জয়ী ঘোষণা করা হয়নি। এ অবস্থায় দুই প্রার্থী পেদ্রো কাস্তিলিও ও কিকো ফুজিমোরির বিক্ষুব্ধ সমর্থকেরা রাজপথে নেমে এসেছেন। উভয় পক্ষ নিজেদের জয়ী দাবি করছে। রাজনীতিতে পেদ্রো নবিশ। অন্যদিকে, তাঁর প্রতিপক্ষ কিকো রাজনৈতিক পরিবারে বেড়ে উঠেছেন। অনেক আগেই রাজনীতিতে তাঁর হাতেখড়ি হয়েছে। তাঁকে নিয়ে অনেকের মধ্যে শঙ্কা রয়েছে। কিকোকে নিয়ে শঙ্কার কারণ খুঁজতে পেছনে ফিরে তাকাতে হবে।
কিকোর জন্ম ১৯৭৫ সালে। তাঁরা বাবা আলবার্তো ফুজিমোরি। তিনি পেরুর সাবেক প্রেসিডেন্ট। দুর্নীতি ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দণ্ডিত হয়ে আলবার্তো ২৫ বছরের কারাদণ্ড ভোগ করছেন।
আলবার্তো ১৯৯০ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ২০০০ সাল পর্যন্ত তিনি পেরুর রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলেন। এর মধ্যে ১৯৯২ সালে তিনি সেনাবাহিনীর সমর্থন নিয়ে ক্যু করেছিলেন। শাসনকালে তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিস্তার অভিযোগ উঠেছিল।
২০০০ সালের নভেম্বরে আলবার্তো পালিয়ে জাপানে যান। অভিশংসনের মাধ্যমে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। ২০০৫ সালে চিলি সফরকালে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২০০৭ সালে তাঁকে পেরুর কাছে হস্তান্তর করা হয়। বিভিন্ন অভিযোগে বিচারে তাঁর মোট ২৫ বছরের কারাদণ্ড হয়।
আলবার্তোর বড় মেয়ে কিকো। তিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েছেন। ১৯৯৪ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত তিনি পেরুর ফার্স্ট লেডির দায়িত্ব পালন করেছেন।
ডানপন্থী পপুলিস্ট দল পপুলার ফোর্সের নেতা কিকো। তিনি ২০০৬ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত পেরুর রাজধানী লিমার মেট্রোপলিটন এলাকার নির্বাচিত কংগ্রেসওম্যান ছিলেন। এ ছাড়া ২০১১, ২০১৬ ও ২০২১ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন।
কিকোর বিরুদ্ধে অর্থ পাচার ও দুর্নীতির মামলা রয়েছে। ২০১৮ সাল থেকে তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলার তদন্ত চলছে। সরকারি কৌঁসুলিরা তাঁর ৩০ বছরের বেশি কারাদণ্ড চান। একই সঙ্গে তাঁর রাজনৈতিক দলেরও বিলুপ্তি চান তাঁরা। কিকো কারাগারেও গিয়েছিলেন। ২০২০ সালের মে মাসে শর্তসাপেক্ষ জামিনে ছাড়া পান তিনি।
আগে যখন কিকো প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হয়েছিলেন, তখন তাঁর বিরুদ্ধে পেরুতে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়। তাঁর বাবার অপকর্মের দিকগুলো সামনে এনে হাজারো বিক্ষোভকারী জানিয়ে দেন, ‘পেরুতে ফুজিমোরি আর নয়’। তবে বিরোধিতা সত্ত্বেও কিকো তাঁর প্রেসিডেন্ট হওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষায় লাগাম টানেননি। তিনি ২০২১ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নিয়ে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তোলেন।
৬ জুন পেরুতে দ্বিতীয় দফার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়। এ নির্বাচনের মতো মেরুকরণ আগে দেখেনি পেরু। এ নির্বাচন পেরুর জনগণকে দুই ভাগে বিভক্ত করে ফেলেছে। দেশটির দরিদ্র ও গ্রামীণ ভোটাররা বামপন্থী পেদ্রোকে সমর্থন করেছেন। আর ধনী ও শহুরে ভোটারদের সমর্থন পেয়েছেন ডানপন্থী কিকো।
১৫ জুন ভোট গণনা শেষ হয় বলে জানায় পেরুর ন্যাশনাল অফিস অব ইলেকটোরাল প্রসেসেস (ওএনপিই)। গণনাকৃত ভোটে পেদ্রো পেয়েছেন ৫০ দশমিক ১২৫ শতাংশ ভোট। কিকো পেয়েছেন ৪৯ দশমিক ৮৭৫ শতাংশ ভোট। কিকোর চেয়ে পেদ্রো মাত্র শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ ভোট বেশি পেয়েছেন, যা প্রায় ৪৪ হাজার ভোটের সমান। ভোট গণনা শেষ হতেই পেদ্রো নিজেকে জয়ী দাবি করেন। অন্যদিকে, পরাজয় মানতে অস্বীকৃতি জানান কিকো।
পেরুতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী প্রার্থীর নাম ঘোষণার দায়িত্ব স্বাধীন সংস্থা ন্যাশনাল ইলেকশনস জুরির (জেএনই)। উভয় প্রার্থী নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ তুলে বেশ কিছু ভোট পর্যালোচনার আবেদন জানিয়েছেন। জেএনই বলেছে, যেসব ভোট নিয়ে অভিযোগ এসেছে, তার সব কটি পর্যালোচনার পর তারা বিজয়ী প্রার্থীর নাম ঘোষণা করবে। ভোট পর্যালোচনা শেষ হওয়ার আগপর্যন্ত পেরুর জনগণকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছে জেএনই।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফল নিয়ে অনিশ্চয়তার জেরে গত শনিবার পেরুর রাজধানী লিমার রাজপথে নামেন উভয় প্রার্থীর হাজারো সমর্থক। এ বিক্ষোভে কিকোর সমর্থনে ডানপন্থী ও মধ্যডানপন্থী দলের নেতা-কর্মীদের অংশ নিতে দেখা যায়। পাশাপাশি বিক্ষোভে দেশটির সাবেক সেনা কর্মকর্তাদেরও সরব উপস্থিতি ছিল। কিকোর সমর্থক বিক্ষোভকারীদের ‘কমিউনিজমকে “না” বলুন’ লেখা ব্যানার বহন করতে দেখা যায়। এ লেখার মাধ্যমে তাঁরা পেদ্রোকে ইঙ্গিত করেছেন বলেই ধারণা করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।
পেরুর ক্ষমতায় কিকোর আসা নিয়ে দেশটির অনেক মানুষের মধ্যে একধরনের উদ্বেগ আছে। তিনি এরই মধ্যে ঘোষণা করেছেন, জয়ী হয়ে ক্ষমতায় এলে তাঁর বাবা আলবার্তোর দণ্ড মওকুফ করে তাঁকে কারামুক্তি দেওয়া হবে।
আবার কিকো জয়ী হলে তাঁর কারাগারে যাওয়ার সম্ভাবনা অন্তত ২০২৬ সাল পর্যন্ত থাকবে না। কারণ, তিনি যত দিন ক্ষমতায় থাকবেন, তত দিন তাঁর বিরুদ্ধে থাকা মামলা স্থগিত থাকবে।
অবশ্য কিকোর সমালোচকেরা বলছেন, তাঁর ক্ষমতায় আসার অর্থ হলো পেরুতে সেই পুরোনো শাসকের (আলবার্তো) ফিরে আসা। সেই পুরোনো শাসক, যিনি কিনা দুর্নীতি ও মানবতাবিরোধী অপরাধে এখন জেল খাটছেন।
তবে কি ডান-বামের লড়াইয়ে পেরুতে আরেকবার জয়ী হতে চলেছে ফুজিমোরি পরিবার? এ প্রশ্নের আনুষ্ঠানিক উত্তর জানতে অপেক্ষা করতেই হচ্ছে আর কিছুদিন।
তথ্যসূত্র: এএফপি, রয়টার্স, বিবিসি, আল-জাজিরা ও এনপিআর ডট ওআরজি