কে হচ্ছেন কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট: ‘টিকটক কিং’, নাকি সাবেক বিদ্রোহী নেতা

গুস্তাভো পেত্রো (বাঁয়ে) ও রোদোলফো এরনান্দেজ (ডানে)
ছবি: রয়টার্স

দেশের ইতিহাসে এবারই প্রথম কলম্বিয়ার মানুষ প্রেসিডেন্ট হিসেবে একজন বামপন্থী নেতাকে বিপুল ভোট দিয়েছেন। সাবেক বিদ্রোহী ও বামপন্থী নেতা গুস্তাভো পেত্রো তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী থেকে ১২ শতাংশ ভোটে এগিয়ে আছেন। তবে নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয়ের জন্য প্রয়োজনীয় ৫০ শতাংশ ভোট নিশ্চিত করতে পারেননি তিনি। এমন অবস্থায় কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন দ্বিতীয় দফায় গড়িয়েছে। ১৯ জুন এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

 দ্বিতীয় দফায় পেত্রোর প্রতিদ্বন্দ্বী ৭৭ বছর বয়সী ব্যবসায়ী রোদোলফো এরনান্দেজ। গতানুগতিক পদ্ধতি অবলম্বন না করে টিকটকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার চালিয়ে ভোটারদের কাছে টেনেছেন তিনি। এরনান্দেজ হলেন স্বঘোষিত ‘কিং অব টিকটক’।

দুই প্রার্থীই কলম্বিয়ায় বদল আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। রাজনীতিতেও বড় ধরনের পরিবর্তন আনার অঙ্গীকার করেছেন তাঁরা। তবে ভোটাররা কোন ধরনের বদল চাইছেন, তা জানা যাবে দ্বিতীয় দফার নির্বাচনের ফলাফলের মধ্য দিয়ে। এ দুই প্রার্থীর পরিচয় কী, দ্বিতীয় দফায় দুই প্রার্থীর লড়াই কেমন হবে, তা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিসি।

রোদোলফো এরনান্দেজ: প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চমক

২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বুকারামানগা শহরের মেয়র ছিলেন রোদোলফো এরনান্দেজ। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচার যখন শুরু হয়, তখন বুকারামানগা শহরের বাইরে তাঁকে কমসংখ্যক লোকই চিনতেন। টিকটকের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিডিও পোস্টের মধ্য দিয়ে পরিচিত হন তিনি। এতে অপেক্ষাকৃত পরিচিত মুখ গুস্তাভো পেত্রোর বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ তৈরি হয় তাঁর।

প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সামনে রেখে কলম্বিয়ায় পরিচালিত বিভিন্ন জনমত জরিপে শুরু থেকেই এগিয়ে ছিলেন বামপন্থী গুস্তাভো পেত্রো। তবে এসব জরিপে আভাস দেওয়া হয়েছিল, দ্বিতীয় দফায় রক্ষণশীল প্রার্থী ফেদেরিকো ফিকো গুতিয়ারেজের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে পারে পেত্রোর। তবে জরিপকে মিথ্যা প্রমাণ করে দ্বিতীয় দফার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে যাচ্ছেন গুস্তাভো পেত্রো ও রোদোলফো এরনান্দেজ।

স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ায় এরনান্দেজকে দলের প্রাথমিক প্রার্থী বাছাইপর্বে অংশ নিতে হয়নি। সে কারণে সংবাদমাধ্যমগুলোয় অন্য প্রার্থীদের তুলনায় তাঁর উপস্থিতি কম দেখা গেছে। গতানুগতিক নির্বাচনী সমাবেশে অংশ নেননি তিনি। তাঁকে তুখোড় টিভি বিতর্কেও অংশ নিতে দেখা যায়নি। তিনি বরং টিকটকে সংক্ষিপ্ত বার্তা দিয়ে অনুসারীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলেন।

নির্বাচনী প্রচারণা চলার সময় একটি টিভি অনুষ্ঠানে নিজের মেয়ের একটি ঘটনা উল্লেখ করার পর বিপুল মানুষের সহানুভূতি পেয়েছিলেন এরনান্দেজ। তাঁর মেয়ের নাম জুলিয়ানা এরনান্দেজ। ২০০৪ সালে কলম্বিয়ার বামপন্থী বিদ্রোহী গোষ্ঠী ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মির (ইএলএন) হাতে অপহৃত হন জুলিয়ানা। তখন বয়স ২৩ বছর।

রোদোলফো এরনান্দেজ বলেছেন, ইএলএন তাঁর কাছ থেকে ২০ লাখ ডলার ক্ষতিপূরণ দাবি করেছিল। তবে তিনি তা পরিশোধে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন, এতে পরিবারের অন্য সদস্যরাও অপহৃত হওয়ার উচ্চ ঝুঁকিতে থাকবেন। এ ঘটনার পর জুলিয়ানার আর হদিস মেলেনি। তাঁকে মৃত বলে ধরে নেওয়া হয়।

ইএলএনের হাতে মেয়ের অপহরণের ঘটনার পরও এরনান্দেজ বলেছেন, তিনি যদি প্রেসিডেন্ট হন, তাহলে বিদ্রোহী গোষ্ঠী ফার্কের সঙ্গে কলম্বিয়া সরকারের স্বাক্ষরিত শান্তিচুক্তিতে ইএলএনকেও অন্তর্ভুক্ত করবেন। ২০১৬ সালে ফার্কের সঙ্গে কলম্বিয়া সরকারের ওই চুক্তি হয়।

প্রথম দফার নির্বাচনে জয়ের পর পেত্রো–সমর্থকদের উল্লাস

বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, শান্তিচুক্তির জন্য আগে ইএলএনের সঙ্গে আলোচনা হলেও তা ব্যর্থ হয়। এমন অবস্থায় কীভাবে তাদের সঙ্গে শান্তিচুক্তিতে পৌঁছানো সম্ভব হবে, তা পরিষ্কার নয়।

রোদোলফো এরনান্দেজ বলেন, ফার্কের সঙ্গে সরকারের যে শান্তিচুক্তি হয়েছে, তা সমর্থন করেন তিনি। অথচ ২০১৬ সালের গণভোটে তিনি এর বিপক্ষে ভোট দিয়েছিলেন।

পেত্রো: সাবেক বিদ্রোহী থেকে রাজনীতিবিদ

প্রথম দফার নির্বাচনে গুস্তাভো স্বস্তির জয় পেলেও বামপন্থী এ নেতাকে দ্বিতীয় দফার নির্বাচনে জয় পেতে সুকৌশলী হতে হবে। কারণ, প্রথম দফার নির্বাচনে তৃতীয় স্থান অধিকারী ফিকো গুতিয়ারেজ ইতিমধ্যে এরনান্দেজকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, ডানপন্থী পক্ষগুলো গুস্তাভোকে পরাজিত করতে ভোটারদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে যাচ্ছে।

বিভিন্ন জনমত জরিপে আভাস দেওয়া হয়েছিল, দ্বিতীয় দফার নির্বাচনে ফিকো গুতিয়ারেজ হবেন পেত্রোর প্রতিদ্বন্দ্বী। তবে প্রথম দফার ফলাফল ঘোষণার পর পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। এখন এরনান্দেজের বিরুদ্ধে লড়তে হবে পেত্রোকে। নিজেকে এস্টাবলিশমেন্টের বিপক্ষের মানুষ হিসেবে দাবি করা এরনান্দেজর বিপক্ষে লড়াই করাটা গুস্তাভোর জন্য অনেক বেশি কঠিন হতে পারে।

প্রথম দফার নির্বাচনে জয় পাওয়ার পর এরনান্দেজকে আক্রমণ করে পেত্রো বলেছেন, টিকটকের স্লোগান দিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করা যায় না; যদিও কোনো কোনো সম্মানিত ব্যক্তি তেমনটা মনে করে থাকেন।

পেত্রো আরও বলেন, ‘অবাস্তব কথা বলে আপনাদের ফাঁদে ফেলতে আমরা এখানে আসিনি। আমরা আপনাদের বাস্তবতার মুখোমুখি করতে চাই। আমরা কোন দিকে যাচ্ছি, তা কলম্বিয়ার সমাজকে স্পষ্ট করে বলতে চাই।’

পেত্রোর রানিংমেট ফ্রান্সা মারকেজ তাঁর জন্য ইতিবাচক ভূমিকা রাখবেন বলে মনে করা হচ্ছে। আফ্রো-কলম্বিয়ান এ পরিবেশবিদ ও অধিকারকর্মী নারী, গ্রামীণ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ভোট আকৃষ্ট করতে পারবেন বলে আশা করা হচ্ছে। তা না হলে পেত্রো তাঁদের ভোট না-ও পেতে পারেন।

প্রতিদ্বন্দ্বী এরনান্দেজ তাঁর ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী (রানিংমেট) হিসেবে আফ্রো-কলম্বিয়ান নারী মারেলেন কাস্তিলোকে বেছে নিয়েছেন। কাস্তিলোকে জনসমক্ষে অনেক কম দেখা যায়। একটি সংবাদপত্র তাঁকে ‘অচেনা প্রার্থী’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। অন্যদিকে, মার্কেজ ব্যাপক প্রচারণা চালিয়েছেন। একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী থেকে ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে তাঁর উত্থান কলম্বিয়ার অনেক মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে।

গতানুগতিক নির্বাচনী সমাবেশে অংশ নেননি এরনান্দেজ, বরং টিকটকে অনুসারীদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলেন

গত রোববার রাতে ফেসবুকে একটি ভিডিও পোস্ট করেছেন এরনান্দেজ। তাঁকে দ্বিতীয় দফার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ দেওয়ায় ভোটারদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন তিনি।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, ভোটারদের মধ্যে অনেকে আছেন, যাঁরা গুস্তাভো পেত্রোর অতীত জীবনকে মেনে নিতে পারছেন না। তিনি একসময় এম-১৯ গেরিলার সদস্য ছিলেন; যদিও কয়েক দশক আগে এ বিদ্রোহী গোষ্ঠী বিলুপ্ত হয়ে গেছে। দীর্ঘদিন ধরে গণতান্ত্রিক রাজনীতিবিদ হিসেবে কাজ করছেন পেত্রো।

পেত্রো তাঁর প্রতি ভোটারদের এ নেতিবাচক মনোভাব কাটাতে পারবেন, নাকি ‘দ্য কিং অব টিকটক’ আগামী চার বছরের জন্য কলম্বিয়ার শাসনক্ষমতায় আসীন হবেন, সেটিই এখন দেখার অপেক্ষা।