কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো
কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো

সুতায় ঝুলছে জাস্টিন ট্রুডোর রাজনৈতিক ভাগ্য, সামনে যা ঘটতে পারে

রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে চরম অনিশ্চয়তায় পড়েছেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। পদত্যাগ করেছেন ট্রুডো সরকারের সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ সদস্য ও তাঁর একসময়ের ঘনিষ্ঠ মিত্র। এ থেকেই ট্রুডোর ভাগ্য সুতায় ঝুলতে শুরু করেছে।

ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড—কানাডার উপপ্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী ছিলেন। গত সোমবার প্রধানমন্ত্রী ট্রুডোর উদ্দেশে খোলাচিঠি লিখে পদত্যাগ করেন তিনি। কারণ হিসেবে সরকারি ব্যয় নিয়ে সরকারপ্রধানের সঙ্গে মতবিরোধ ও কানাডার এগিয়ে যাওয়ার জন্য সবচেয়ে ভালো পথের কথা জানান ফ্রিল্যান্ড।

ট্রুডোর সঙ্গে সদ্য পদত্যাগ করা উপপ্রধানমন্ত্রীর বিরোধ মূলত যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে কানাডার পণ্যে আমদানি শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেওয়াকে ঘিরে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ট্রাম্পের শুল্ক আরোপ কানাডার অর্থনীতিতে চরম আঘাত হানতে পারে।

কানাডার সংসদীয় রাজনীতিতে, এমনকি জাস্টিন ট্রুডোর নিজ দল লিবারেল পার্টির কিছু সদস্যের মধ্যেও প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে—এমন সংকটময় সময়ে আসলেই কি তিনি নেতৃত্ব দিতে সক্ষম? এখন ট্রুডো কী করবেন?

এ পরিস্থিতিতে নিজের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে জাস্টিন ট্রুডোর সামনে অল্প কয়েকটি বিকল্প রয়েছে।

পদত্যাগের দাবির বিষয়ে

লিবারেল পার্টি অব কানাডার প্রধান হিসেবে ২০১৩ সাল থেকে দায়িত্ব পালন করছেন জাস্টিন ট্রুডো। ২০১৫ সালে দেশের প্রধানমন্ত্রী হন তিনি। টানা ৯ বছর ধরে তিনি এ পদে আছেন।

জাস্টিন ট্রুডোর সঙ্গে সদ্য পদত্যাগ করা উপপ্রধানমন্ত্রীর বিরোধ মূলত যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে কানাডার পণ্যে আমদানি শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেওয়াকে ঘিরে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, ট্রাম্পের শুল্ক আরোপ কানাডার অর্থনীতিতে চরম আঘাত হানতে পারে।

দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, দলীয় প্রধান চাইলে যেকোনো সময় পদ ছেড়ে দিতে পারেন। তিনি পদত্যাগ করলে দলের সদস্যরা অন্তর্বর্তীকালীন একজন নেতাকে প্রধান করবেন। এরপর সংসদীয় নেতা নির্বাচনে দলের ভেতর ভোটাভুটি হবে কিংবা সমঝোতার ভিত্তিতে কাউকে দায়িত্ব দেওয়া হবে। তত দিন দায়িত্ব পালন করবেন অন্তর্বর্তীকালীন নেতা।

একজন নতুন নেতা নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত ট্রুডো তাঁর পদে থাকার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। নতুন নেতা নির্বাচিত হয়ে গেলে ট্রুডোকে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হবে। উত্তরসূরির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।

নিজ দলেই চ্যালেঞ্জের মুখে

শিগগিরই স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করার কোনো ইঙ্গিত দেননি জাস্টিন ট্রুডো।

ফ্রিল্যান্ডের পদত্যাগের পর ট্রুডো তাঁর ককাসের সঙ্গে জরুরি বৈঠকে বসেছিলেন। গণমাধ্যমের বিভিন্ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তিনি আরও সময় নেবেন বলে নিজ দলের কনিষ্ঠ পার্লামেন্ট সদস্য বা এমপিদের জানিয়ে দিয়েছেন। তাঁদের কেউ কেউ সরাসরি ট্রুডোর পদত্যাগের দাবি তুলেছিলেন।

নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা জগমিৎ সিং গত সোমবার প্রথমবারের মতো ট্রুডোর পদত্যাগের দাবি তুলেছেন। এর মধ্য দিয়ে লিবারেল সরকারের টিকে থাকার ঝুঁকি আরও বেড়েছে। কেননা, দলটির সংসদীয় নেতা বলেছেন, নতুন বছরেও প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো রয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে অনাস্থার পক্ষে ভোট দেবেন দলটির এমপিরা।

গত গ্রীষ্ম থেকেই রাজনৈতিক চাপে রয়েছেন ট্রুডো। ভোটারদের মধ্যে জনপ্রিয়তায় ক্রমেই পড়তি ভাব, নির্বাচনে একসময় লিবারেল পার্টির দখলে থাকা আসনগুলোয় একের পর এক হার ট্রুডোর দলকে বড় ধরনের সমস্যায় ফেলে দিয়েছে।

গত অক্টোবরে নিজ দল থেকেই ছোটখাটো বিদ্রোহের মুখে পড়েন ট্রুডো। লিবারেল পার্টির ২৪ জন এমপি একটি চিঠিতে সই করেন। তাতে ট্রুডোর পদত্যাগের দাবি তোলা হয়।

এ পরিস্থিতিতে বিভিন্ন জনমত জরিপের ফলাফল ট্রুডোর চ্যালেঞ্জ বাড়িয়েছে। জরিপ বলছে, কানাডায় যদি এখনই সাধারণ নির্বাচন হয়, তাহলে বিরোধী রক্ষণশীল পার্টি বড় জয় পাবে।

এতসব চ্যালেঞ্জের মুখেও অনড় জাস্টিন ট্রুডো। তিনি লিবারেল পার্টির নেতা হিসেবে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনে অংশ নিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

কানাডার পার্লামেন্টে লিবারেল পার্টির ১৫৩ জন এমপি আছেন। তাঁদের মধ্যে অবশ্য মাত্র ১৩ জন ট্রুডোর পদত্যাগের প্রকাশ্য দাবি তুলেছেন। তাঁদের প্রায় অর্ধেকই পুনর্নির্বাচন চাইছেন না। সিবিসি নিউজ এ তথ্য জানিয়েছে।

লিবারেল পার্টির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, দলীয় প্রধানের পদ নিয়ে সদস্যরা একটিমাত্র ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিকভাবে ভোটাভুটির পথে হাঁটতে পারেন। সেটা হলো সাধারণ নির্বাচনে দলের পরাজয়।

পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোট

জনপ্রিয়তায় ধস নামার সময়টাতেই ট্রুডো সরকারের বিরুদ্ধে পার্লামেন্টের হাউস অব কমন্সে বেশ কয়েকবার অনাস্থা ভোট আয়োজনের চেষ্টা করেছেন বিরোধী রক্ষণশীলরা। কিন্তু প্রয়োজনীয় সমর্থন না পাওয়ায় তাঁদের সেসব চেষ্টা ব্যর্থ হয়।

যদি সরকার অনাস্থা ভোটে হেরে যায়, তবে প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হবে। পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়া হবে। আর সে ক্ষেত্রে সাধারণ নির্বাচন আয়োজনের পথ সুগম হবে।

কানাডার পার্লামেন্টের আসন ৩৩৮টি। অনাস্থা ভোটে সরকারকে উতরাতে হলে সংখ্যাগরিষ্ঠ এমপির সমর্থন প্রয়োজন হবে। আর এ জন্য ট্রুডোর নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন জোটের কাছে বিরোধীরা ১৭টি আসনে পিছিয়ে আছে।

কাজেই অনাস্থা ভোটে ট্রুডোর জোটের নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টি কিংবা ব্লক কিউবেকুইসের সমর্থন ছাড়া সরকারকে হটানো রক্ষণশীলদের পক্ষে কার্যত সম্ভব না। গতকাল মঙ্গলবার থেকে পার্লামেন্টের অবকাশ শুরু হয়েছে। তাই ট্রুডোর সামনে অন্তত আগামী জানুয়ারির শেষভাগের আগে নতুন করে অনাস্থা ভোটের মুখোমুখি হওয়ার ঝুঁকি কম।

নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা জগমিৎ সিং গত সোমবার প্রথমবারের মতো ট্রুডোর পদত্যাগের দাবি তুলেছেন। এর মধ্য দিয়ে লিবারেল সরকারের টিকে থাকার ঝুঁকি আরও বেড়েছে। কেননা, দলটির সংসদীয় নেতা বলেছেন, নতুন বছরেও প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো রয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে অনাস্থার পক্ষে ভোট দেবেন দলটির এমপিরা।

ডোনাল্ড ট্রাম্প ও জাস্টিন ট্রুডো

অনাস্থা ভোট এড়াতে করণীয়

সম্ভাব্য অনাস্থা ভোট এড়াতে ট্রুডোর সামনে একটি বিকল্প খোলা আছে—পার্লামেন্ট স্থগিত করা। এর অর্থ হলো, পার্লামেন্ট আনুষ্ঠানিকভাবে ভেঙে দেওয়া হবে না। তবে পার্লামেন্টে যেকোনো ধরনের কার্যক্রম, বিতর্ক, ভোটাভুটি বন্ধ থাকবে।

এটা পার্লামেন্টের নিয়মিত একটি প্রক্রিয়ার অংশ। অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সংকট চলমান থাকার প্রেক্ষাপটে সংশ্লিষ্ট সরকারগুলো একটু বাড়তি সময় নিতে এ কৌশল ব্যবহার করে থাকে।

সবশেষ ২০২০ সালের আগস্টে ট্রুডো একবার পার্লামেন্ট স্থগিত করেছিলেন। ওই সময় ট্রুডোর সরকার একটি দাতব্য সংস্থার সঙ্গে চুক্তি পরিচালনার ক্ষেত্রে নীতিসংক্রান্ত কেলেঙ্কারির মুখোমুখি হয়েছিল।

বর্তমান পরিস্থিতিতে জাস্টিন ট্রুডো যে সিদ্ধান্তই নেন না কেন, কানাডায় আগামী মাসগুলোয় একটি সাধারণ নির্বাচন আয়োজন অনিযার্য হয়ে পড়েছে। দেশটিকে অবশ্যই পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন আগামী অক্টোবর কিংবা এর আগেই করতে হবে। শেষ পর্যন্ত এটা হলে ভোটাররা ট্রুডোর রাজনৈতিক ভাগ্য নির্ধারণ করার সুযোগ পাবেন।