রাশিয়ার প্রতি ইউক্রেন থেকে নিঃশর্তভাবে পুরোপুরি সেনা প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়ে তৈরি করা হয়েছিল যৌথ বিবৃতি। কিন্তু রাশিয়ার আপত্তিতে চীন সমর্থন জানানোয় তা আলোর মুখ দেখল না। সে কারণে যৌথ ঘোষণা ছাড়াই শেষ হলো জি–টোয়েন্টি জোটভুক্ত দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলন।
আজ বৃহস্পতিবার ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে দুই দিনের এই সম্মেলন শেষ হয়েছে। ফলে কদিন আগে বেঙ্গালুরুতে এই গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলোর অর্থমন্ত্রীদের সম্মেলনের মতো একই হাল হলো পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্মেলনেও। যৌথ বিবৃতির বদলে গৃহীত হলো এক নির্যাস নথি বা ‘আউটকাম ডকুমেন্ট’।
তবে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর এই প্রথম এই সম্মেলনে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের সঙ্গে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ পরস্পর সাক্ষাৎ করেন। আজ বৃহস্পতিবার সম্মেলনের ফাঁকে এই সাক্ষাতের ফল সম্পর্কে দুই দেশের কূটনীতিকেরা বিশেষ কিছু বলতে চাননি। যদিও দুই তরফেই সাক্ষাতের বিষয়টি সংবাদমাধ্যমের কাছে স্বীকার করা হয়েছে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর দুই তরফে এটাই ছিল প্রথম কথা। দুজনের বাক্যালাপ হয় ১০ মিনিটের মতো।
এই সাক্ষাৎ পূর্বনির্ধারিত ছিল না। দিল্লি আসার আগে ব্লিঙ্কেনও জানিয়েছিলেন, সাক্ষাতের কোনো সম্ভাবনা নেই। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের সাংবাদিকেরা জানিয়েছেন, সম্মেলনে এসে ব্লিঙ্কেনই লাভরভের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। এই সাক্ষাতের পেছনে ভারতের হাত আছে কি না, সে বিষয়ে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর কোনো মন্তব্য করেননি।
সম্মেলনের অবসরে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী চিং গাংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন জয়শঙ্করও। দ্বিপক্ষীয় বিষয়, বিশেষ করে সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ে দুজনের কথা হয়েছে বলে জয়শঙ্কর জানিয়েছেন।
আজ বিকেলে সম্মেলন থেকে সামান্য সময়ের জন্য বের হয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর সংবাদ সম্মেলনে বলেন, অধিকাংশ বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা একমত হয়েছেন। দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলোর বিশেষ অসুবিধা ও উৎকণ্ঠা নিরসনে কী কী করা উচিত, সেসব বিষয়ে সহমত হয়েছেন। কিন্তু কিছু বিষয় রয়েছে, যেমন ইউক্রেন সংঘাত, যা নিয়ে সবাই উদ্বিগ্ন হলেও ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। মতানৈক্যের মীমাংসা করা যায়নি। ফলে যৌথ বিবৃতি গ্রহণ করা সম্ভবপর হয়নি।
আজ সম্মেলনের শুরুতে সমস্যা ও আলোচনার সুর বেঁধে দেওয়ার চেষ্টা করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ভার্চ্যুয়াল ভাষণে পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক সমস্যাগুলোর সমাধান বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ঐকমত্যে পৌঁছানোর কোনো প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। মুষ্টিমেয় কিছু দেশের একতরফা সিদ্ধান্তই প্রাধান্য পাচ্ছে। তিনি বলেন, অর্থনৈতিক সংকট, জলবায়ু পরিবর্তন, অতিমারি, সন্ত্রাসবাদ ও যুদ্ধের মোকাবিলায় বিশ্ব শাসন ব্যর্থ। সেই ব্যর্থতা দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলোকে চরম বিপর্যয়ের মুখোমুখি করে তুলেছে। মতপার্থক্য পাশে সরিয়ে রেখে পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সামনের দিকে এগোনোর বার্তা দেন তিনি।
কিন্তু তা সত্ত্বেও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সম্মেলনের ইতিবাচক উদ্যোগ ঢেকে দেয়। বিবিসি জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ‘বিনা প্ররোচনায় অন্যায় যুদ্ধ’ করার জন্য রাশিয়াকে দোষারোপ করেন। রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী পাল্টা দোষারোপ করেন পশ্চিমা দেশগুলোকে। সম্মেলনে এমন রেষারেষির আগাম আঁচ পাওয়া গিয়েছিল বুধবার রাতের নৈশভোজ থেকে, জি-৭ গোষ্ঠীভুক্ত দেশের অধিকাংশ সদস্যের গরহাজিরার মধ্য দিয়ে। গতকাল জয়শঙ্করের সংবাদ সম্মেলন থেকে এটাও বোঝা গেল, এক বছর অতিক্রান্ত হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের আশু সুরাহার তেমন কোনো আশা নেই। যদিও ভারতের কূটনৈতিক দক্ষতা ও তৎপরতার ওপর পশ্চিমা দুনিয়া এখনো আস্থাবান। ব্লিঙ্কেন-লাভরভ হঠাৎ সাক্ষাৎ অবশ্যই এই সম্মেলনের এক অন্যতম রুপালি রেখা।
জয়শঙ্কর বলেন, সম্মেলনের লক্ষ্য বেশিটাই পূরণ হয়েছে। বৈশ্বিক শাসনকে জোরালো করে তোলা, খাদ্য, সার, শক্তির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, সন্ত্রাসবাদ দমন, জলবায়ু পরিবর্তন, লিঙ্গসমতা রক্ষাসহ অধিকাংশ বিষয়ে সবাই একমত হতে পেরেছেন। এসব বিষয় দক্ষিণ গোলার্ধের অধিকাংশ দেশকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করে রেখেছে। তিনি বলেন, সব বিষয়েই যদি একমত হওয়া যেত, তা হলে যৌথ বিবৃতি অবশ্যই প্রচারিত হতো। ৯০-৯৫ শতাংশ বিষয়ে একমত হয়েও কয়েকটি ক্ষেত্রে সবাইকে এক পঙ্ক্তিতে আনা গেল না।