পাকিস্তানে কে সরকার চালাবে, এর একটা ‘ওপেন সিক্রেট’ সূত্র আছে। সূত্রটি হলো—হয় সামরিক বাহিনী, নয়তো তাদের পছন্দের ব্যক্তি।
আজ বৃহস্পতিবার (৮ ফেব্রুয়ারি) পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন হচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিকভাবেই উল্লিখিত সূত্রের কথা ফিরে ফিরে আসছে।
আজকের নির্বাচনের আলোচিত মুখ দেশটির সাবেক দুই প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ ও ইমরান খান।
কারাগারে থাকা ইমরান যদিও আজকের নির্বাচনে লড়তে পারছেন না, তবু তিনি আছেন আলোচনার কেন্দ্রে।
গত নির্বাচনের সময় নওয়াজের দশাও ঠিক একই রকম ছিল। তখন তিনি ছিলেন কারাগারে। লড়তে পারেননি ভোটে।
এ যেন ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। এ সুবাদে ইতিহাস জানতে একটু পেছনে ফিরে তাকানো যাক।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পছন্দের পাত্র হিসেবে ১৯৯০ সালে প্রথমবার দেশটির প্রধানমন্ত্রী হন নওয়াজ। অচিরেই এ সম্পর্কে টানাপোড়েন দেখা দেয়। এর জেরে ১৯৯৩ সালে তিনি ক্ষমতা হারান।
পাকিস্তান মুসলিম লিগ (পিএমএল-এন) নেতা নওয়াজ ১৯৯৭ সালে দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হন। সেবারও তাঁর সঙ্গে সেনাবাহিনীর বিরোধ বাধে। ১৯৯৯ সালে তিনি সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন।
ক্ষমতাচ্যুত নওয়াজকে গ্রেপ্তার করা হয়। অপহরণ ও সন্ত্রাসবাদের মামলায় তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। দুর্নীতির অভিযোগেও তিনি দোষী সাব্যস্ত হন। তাঁকে রাজনীতিতে আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়।
রিয়াদের মধ্যস্থতায় কারাভোগ থেকে রেহাই পান নওয়াজ। তবে সমঝোতার শর্ত মেনে তাঁকে সৌদি আরবে নির্বাসনে যেতে হয়। আবার সেনাবাহিনীর সঙ্গে সমঝোতা করে তিনি ২০০৭ সালে দেশে ফেরেন। রাজনীতি শুরু করেন।
২০১৩ সালে নওয়াজ তৃতীয় দফায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন। শুরু থেকেই তাঁকে চাপে রাখে সেনাবাহিনী।
ক্রিকেট তারকা থেকে রাজনীতিবিদ বনে যাওয়া পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) নেতা ইমরান ইতিমধ্যে সেনাবাহিনীর ‘প্রিয় মানুষ’ হয়ে ওঠেন। ইমরানকে সর্বাত্মক সমর্থন দিয়ে নওয়াজের শক্ত প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানো হয়। সেনাবাহিনীর ‘প্রক্সি’ হিসেবে মাঠে নামানো হয় ইমরানকে।
পানামা পেপারস-সংক্রান্ত দুর্নীতির তদন্তের জেরে ২০১৭ সালের ২৮ জুলাই নওয়াজকে প্রধানমন্ত্রী পদে অযোগ্য ঘোষণা করেন দেশটির সুপ্রিম কোর্ট। একই দিন তিনি পদত্যাগ করেন।
২০১৮ সালের ১৩ এপ্রিল নওয়াজকে আজীবনের জন্য সরকারি পদে নিষিদ্ধ করা হয়। ৬ জুলাই দুর্নীতির এক মামলায় নওয়াজকে তাঁর অনুপস্থিতিতে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ১৩ জুলাই তাঁকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়।
প্রধানমন্ত্রী পদে অযোগ্য ঘোষণা, রাজনীতিতে আজীবন নিষিদ্ধ করা, কারাদণ্ড দেওয়া—এই প্রক্রিয়ায় সেনাবাহিনীর কলকাঠি নাড়ার অভিযোগ আছে।
২০১৮ সালের ২৫ জুলাই পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন হয়। সামরিক বাহিনীর সমর্থনে নির্বাচনে ইমরানের দল পিটিআই সবচেয়ে বেশি আসন পায়। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় তারা জোট সরকার গঠন করে। এই সরকারের প্রধানমন্ত্রী হন ইমরান।
উচ্চ আদালতের আদেশে ২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর জামিনে মুক্তি পান নওয়াজ। ২৪ ডিসেম্বর দুর্নীতির আরেক মামলায় তাঁকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
সাজা ভোগরত অবস্থায় নওয়াজ আদালতের অনুমতি নিয়ে ২০১৯ সালের ১৯ নভেম্বর চিকিৎসার জন্য যুক্তরাজ্যের লন্ডন যান। চিকিৎসা শেষে দেশে না ফিরে তিনি লন্ডনেই অবস্থান করেন।
ক্ষমতার বসার পর ইমরান সামরিক বাহিনীর সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন। তিনি সামরিক বাহিনীর কর্তৃত্ব চ্যালেঞ্জ করেন। সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান নিয়োগ নিয়ে তৎকালীন সেনাপ্রধান ও ইমরান মুখোমুখি অবস্থানে চলে যান।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে ইউক্রেন যুদ্ধের ডামাডোলের মধ্যে রাশিয়া সফরে যান ইমরান। তাঁর এই সফর যুক্তরাষ্ট্রকে ক্ষুব্ধ করে।
আর কোথায় যান ইমরান! পরিণতি যা হওয়ার, তা-ই হয়।
২০২২ সালের ১০ এপ্রিল পাকিস্তানের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ জাতীয় পরিষদে বিরোধীদের আনা অনাস্থা ভোটে ক্ষমতাচ্যুত হন ইমরান। পরে নওয়াজের ভাই শাহবাজ শরিফের নেতৃত্বে বিরোধীরা জোট সরকার গঠন করে।
ইমরান অভিযোগ করেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনী হাত মিলিয়ে, ষড়যন্ত্র করে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তান সেনাবাহিনী এই অভিযোগ অস্বীকার করে।
ইমরানের পতনের পর থেকেই পিএমএল-এনের নেতারা জোরগলায় বলছিলেন, দলের সর্বোচ্চ নেতা নওয়াজ লন্ডনের স্বেচ্ছানির্বাসন থেকে দেশে ফিরবেন। তিনিই হবেন পাকিস্তানে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী।
ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ইমরানের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা হতে থাকে। তাঁর বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা দেড় শ ছাড়িয়েছে।
গত বছরের ৯ মে দুর্নীতির এক মামলায় ইমরানকে গ্রেপ্তার করা হয়। কয়েকটি মামলায় তাঁর সাজা হয়েছে।
সাজার জেরে ইমরানকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়। তাঁর দলের হাজারো নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
ইমরানের দলের প্রতীক ক্রিকেট ব্যাট কেড়ে নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। এ অবস্থায় পিটিআইয়ের নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটে লড়ছেন।
ভোটের মাঠে পিটিআইয়ের নেতাদের সমান সুযোগ দেওয়া হয়নি। পিটিআইয়ের অনেক নেতার প্রার্থিতা বাতিল করা হয়েছে। পিটিআইয়ের প্রার্থীদের অবাধে প্রচার চালাতে দেওয়া হয়নি। অনেক প্রার্থী আত্মগোপনে থেকে নির্বাচন করছেন।
সেনাবাহিনীর নির্দেশে পিটিআইয়ে বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন চালানোর অভিযোগ করে আসছেন দলটির নেতারা।
পাকিস্তানে ‘মিয়া সাহেব’ নামে পরিচিত নওয়াজ গত বছরের ১৯ অক্টোবর দেশে ফেরেন। দেশে ফেরার পর একে একে সব মামলায় খালাস পান তিনি।
বোঝাই যাচ্ছে, নওয়াজের প্রতি বিশেষ মহলের ‘আশীর্বাদ’ আছে। এই বিশেষ মহলই তাঁর ক্ষমতায় ফেরার পথ মসৃণ করতে ভূমিকা রেখেছে।
নওয়াজের প্রতিপক্ষ ইমরানকে একসময় সেনাবাহিনীর ‘সোনার ছেলে’ হিসেবে দেখা হতো। সেই ইমরান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গিয়ে ক্ষমতা হারিয়ে এখন তিনি কারাগারে দিন গুনছেন। তাঁর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।
আজকের নির্বাচনের ফল কী হবে, সে সম্পর্কে ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যানের মন্তব্য গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বিবিসিকে বলেছেন, পাকিস্তানে যখন কোনো রাজনৈতিক নেতার পেছনে সেনাবাহিনীর সমর্থন থাকে, তখন তাঁর নির্বাচনী সাফল্যের সম্ভাবনা বেশি থাকে।
কুগেলম্যান যে সম্ভাবনার কথা বলেছেন, তা বিবেচনায় নিলে চতুর্থবারের মতো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন নওয়াজ।