পাকিস্তানে প্রায় সাত দশক আগে আজকের এ দিনে (১৬ অক্টোবর) দলের কর্মী–সমর্থকদের সমাবেশে লাখ মানুষের সামনে খুন হয়েছিলেন দেশটির প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে তিনি রেখেছিলেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। পাকিস্তানের জাতির জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ডানহাত বলেও পরিচিত ছিলেন তিনি।
দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের জনপ্রিয়তার কমতি ছিল না। তারপরও কেন তাঁকে এভাবে প্রাণ দিতে হলো, সে রহস্যের কিনারা করতে শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে প্রকাশ পেয়েছিল ‘তীব্র অনীহা’।
১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর, রাওয়ালপিন্ডির কোম্পানিবাগে জনসমাবেশের আয়োজন করেছে মুসলিম সিটি লিগ। বক্তৃতা দেবেন স্বাধীন পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান। সমাবেশ ঘিরে জোরদার করা হয় নিরাপত্তাব্যবস্থা। সমাবেশে আসে প্রায় এক লাখ মানুষ।
সে দিন বিকেল চারটার দিকে সমাবেশস্থলে আসেন প্রধানমন্ত্রী। বক্তৃতা দিতে যথাসময়েই মঞ্চে ওঠেন। প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত সবে কথা বলা শুরু করেছেন, মঞ্চের বিপরীত দিকে দর্শকদের আসনের একেবারে সামনের সারি থেকে তাঁকে লক্ষ্য করে পরপর দুবার গুলি ছোড়া হয়। সঙ্গে সঙ্গেই লুটিয়ে পড়েন প্রধানমন্ত্রী। গুলি তাঁর বুকের বাঁ পাশে লাগে। তাঁকে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হয়, করা হয় অস্ত্রোপচার। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। মারা যান তিনি। তাঁর বয়স হয়েছিল ৫৬ বছর।
লিয়াকত আলী খান খুন হওয়ার পর কোম্পানিবাগের নাম বদলে রাখা হয় লিয়াকত গার্ডেন। লিয়াকত আলী খুন হওয়ার ঠিক ৫৬ বছর পর ২০০৭ সালে এই লিয়াকত গার্ডেনেই গুপ্তহত্যার শিকার হন পাকিস্তানের আরেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো।
লিয়াকত আলী খান খুন হওয়া নিয়ে ভারতীয় লেখক এম এস ভেঙ্কটারমনি তাঁর বই ‘দ্য আমেরিকান রোল ইন পাকিস্তান’ এ লেখেন, লিয়াকত আলী খানের খুনির ছোড়া একটিমাত্র বুলেট দেশটির রাজনীতির পরিবর্তনের অনুঘটক হিসেবে প্রমাণিত হয়। লিয়াকত হত্যাকাণ্ডের পরপরই পাকিস্তানি কর্মকর্তারা সাঈদ আকবরকে খুনি ঘোষণা করেন। তাঁরা বলেন, সাঈদ আফগানিস্তানের নাগরিক।
কিন্তু আফগান সরকার ওই দাবি অস্বীকার করে। রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্য সাঈদের আফগান নাগরিকত্ব আগেই কেড়ে নেওয়া হয়েছিল বলে জানানো হয়। সাঈদ ১৯৪৭ সালের জানুয়ারিতে অবিভক্ত ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় কামনা করেন। সে সময়ের ব্রিটিশ শাসকেরা সাঈদকে শরণার্থীর মর্যাদা দিয়ে নর্থ ওয়েস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার প্রভিন্সে (বর্তমানে খাইবার পাখতুনখাওয়া) আশ্রয় দেন। ভারত বিভক্তির পর পাকিস্তানের পক্ষ থেকে শরণার্থী হিসেবে সাঈদকে ভাতা দেওয়া হচ্ছিল।
কার ইশারায়, কী কারণে গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছিলেন লিয়াকত আলী খান, তা নিয়ে বেশ কিছু ষড়যন্ত্র তত্ত্ব পাওয়া যায়। অনেকের মতে, তাঁকে হত্যার পেছনে বিদেশি শক্তির হাত ছিল। কেউ কেউ বলেন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন তাঁকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিল। লিয়াকতের কমিউনিস্টবিরোধী ও পশ্চিমাপন্থী রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে সোভিয়েত ইউনিয়নের শাসকেরা তাঁর ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। কেউ কেউ মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র লিয়াকতকে খুন করিয়েছে। হত্যার ৬৪ বছর পর মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এক গোপন নথি থেকে জানা গেছে, তৎকালীন আফগান সরকারের সহায়তায় লিয়াকত আলীকে হত্যা করে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ।
‘খুনি’ সাঈদ কীভাবে লিয়াকত আলীর সমাবেশে দর্শক সারির সামনের আসনে পৌঁছেছিলেন, সেই রহস্যও অমীমাংসিত রয়ে গেছে। দর্শক আসনের যে সারিতে সাঈদ বসেছিলেন, তা ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টের (সিআইডি) কর্মকর্তাদের জন্য রাখা ছিল। সেখানে বসার কারণে সাঈদ সহজে প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর লক্ষ্য বানাতে পেরেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর দিকে গুলি চালানোর কয়েক মিনিটের মধ্যে সাঈদকে ঘটনাস্থলে হত্যা করা হয়।
ওই গুলি ছোড়ার পরপরই আশপাশের লোকজন সাঈদের ওপর তীব্র আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাঁকে মেরে মৃতদেহ ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। সাঈদের মৃতদেহে গুলির ক্ষতও ছিল। ভিড়ের মধ্যে কে সাঈদকে গুলি করেন, তা আরেক রহস্যের জন্ম দেয়। পরে অবশ্য এক পুলিশ সদস্য স্বীকার করেন, তিনি সাঈদকে লক্ষ্য করে অন্তত একটি গুলি ছুড়েছিলেন। এটা করতে তাঁকে নির্দেশ দিয়েছিলেন পুলিশের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।
গণপিটুনি থেকে সাঈদকে পুলিশের জীবিত আটক করার সুযোগ ছিল। সাঈদের মৃত্যু লিয়াকত হত্যারহস্যকে আরও অন্ধকারে ঠেলে দেয়। তবে কি মুখবন্ধ করতেই তাঁকে (সাঈদ) হত্যা করা হয়েছিল, ওঠে সেই প্রশ্ন।
হত্যার পর সাঈদের পকেটে ২ হাজারের বেশি রুপি পাওয়া যায়। তাঁর অ্যাবোটাবাদের বাড়ি তল্লাশি করে পাওয়া যায় আরও ১০ হাজার রুপি। তখনকার প্রেক্ষাপটে এটা বেশ বড় অঙ্কের অর্থ। সাঈদের কাছে এত রুপি পাওয়ায় কেউ কেউ ধরে নেন, তিনি ভাড়াটে খুনি। প্রধানমন্ত্রীকে খুন করতেই তাঁকে ভাড়া করা হয় এবং মুখ বন্ধ করতে তাঁকেও ঘটনাস্থলে হত্যার বন্দোবস্ত করেন চক্রান্তকারীরা।
যদিও এমন ধারণার পক্ষে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি হত্যার ৭৩ বছর পরও। লিয়াকত আলী খান হত্যার ৫৫ বছর পর ২০০৭ সালে গুপ্তহত্যার শিকার হন পাকিস্তানের আরেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো। ঘটনার দিন তিনি লিয়াকত গার্ডেনে একটি জনসমাবেশ শেষে মাত্র বেরিয়েছিলেন। বেনজির খুন হওয়ার পর প্রমাণ না খুঁজে দ্রুত ঘটনাস্থল ধুয়ে ফেলেছিল রাওয়ালপিন্ডি ফায়ার ডিপার্টমেন্ট। তারা কি এটি করেছিল, প্রমাণ লোপাট করতে—এ প্রশ্নের উত্তরও অজানা।
কার ইশারায়, কী কারণে গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছিলেন লিয়াকত আলী খান, তা নিয়ে বেশ কিছু ষড়যন্ত্র তত্ত্ব পাওয়া যায়। অনেকের মতে, তাঁকে হত্যার পেছনে বিদেশি শক্তির হাত ছিল। কেউ কেউ বলেন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন তাঁকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিল। লিয়াকতের কমিউনিস্টবিরোধী ও পশ্চিমাপন্থী রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে সোভিয়েত ইউনিয়নের শাসকেরা তাঁর ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। কেউ কেউ মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র লিয়াকতকে খুন করিয়েছে। হত্যার ৬৪ বছর পর মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এক গোপন নথি থেকে জানা গেছে, তৎকালীন আফগান সরকারের সহায়তায় লিয়াকত আলীকে হত্যা করে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ।
ওই নথির বরাতে জানা যায়, গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে মার্কিন তেল কোম্পানিগুলোকে ইরানে তেল-সংশ্লিষ্ট চুক্তি পাইয়ে দেওয়ার জন্য লিয়াকত আলী খানকে অনুরোধ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। সে সময় লিয়াকতের সঙ্গে ইরানের বেশ সুসম্পর্ক ছিল। কিন্তু লিয়াকত যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবে রাজি হননি। তার ওপর তিনি পাকিস্তান থেকে মার্কিন বিমান ঘাঁটি সরানোর দাবি তোলেন। এ কারণে তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা করে সিআইএ।
কেউ কেউ আবার ‘খুনি’ সাঈদ আকবরের ব্যক্তিগত ক্ষোভের কথাও বলেন। সাঈদ পশতু ছিলেন। হয়তো তিনি ভেবেছিলেন, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকতের মৃত্যু একটি ঐক্যবদ্ধ পাখতুনিস্তান (পশতুনিস্তান) গঠনের পথ প্রশস্ত করতে সহায়তা করবেন।
এসব তত্ত্বের কোনটিই অবশ্য প্রমাণিত নয়।
লিয়াকত আলী খান হত্যাকাণ্ডের তদন্তভার ছিল নবাবজাদা এইতজাজউদ্দিনের হাতে। নতুন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের সঙ্গে দেখা করে তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্ক জানাতে তিনি আকাশপথে রওনা হয়েছিলেন। কিন্তু পথে বিমানের ইঞ্জিনে আগুন ধরে যায় এবং সেটি বিধ্বস্ত হয়। সব আরোহী মারা যান। সেই সঙ্গে ধ্বংস হয়ে যায় তদন্তের সব নথিপত্রও।
প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত হত্যার খবর প্রকাশ নিয়ে সে সময় পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম রহস্যজনক আচরণ করেছিল। তারা সন্দেহভাজন খুনি সাঈদের ওপর খবর প্রকাশে বেশি মনযোগ দেয়। লিয়াকত হত্যাকাণ্ড নিয়ে সেই সময় পাকিস্তান সরকার থেকে দেওয়া নানা বিবৃতিও ছিল পরস্পরবিরোধী। যে কারণে সরকারের ওপর থেকে জনগণ বিশ্বাস উঠে যায়।
প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত হত্যাকাণ্ড নিয়ে সে সময় পাকিস্তানের জাতীয় দৈনিক এবং অন্যান্য সংবাদমাধ্যমগুলোর ভূমিকাও ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। গুলি খাওয়ার ঘণ্টাখানেকের মাথায় হাসপাতালে লিয়াকত আলী খানের মৃত্যু হয়। কিন্তু পরদিন বেশিরভাগ জাতীয় দৈনিকে প্রধানমন্ত্রীর অবস্থা নিয়ে পরিষ্কার কোনো তথ্য জনগণ পায়নি।
ওই সময়ে উর্দু ভাষায় প্রকাশিত পাকিস্তানের দুই শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্র দৈনিক ইমরোজ (করাচি) ও দৈনিক জমিদার (লাহোর) প্রধানমন্ত্রীকে গুপ্তহত্যা নিয়ে কোনো খবর প্রকাশ করেনি।
১৭ অক্টোবর ১৯৫১ সালে ডেইলি পাকিস্তান টাইমস অথবা ডেইলি সিভিল অ্যান্ড মিলিটারি গেজেটে আগের দিনের ঘটনা নিয়ে কোনো ছবি ছাপা হয়নি।
তবে কি পাকিস্তানের তথ্য মন্ত্রণালয় কিছু আড়াল করতে চাইছিল? কেন ১৬ অক্টোবরের ঘটনার ছবি জনগণের কাছে গোপন রাখা হয়েছিল? লিয়াকত হত্যার ষড়যন্ত্রকারীদের সঙ্গে কি তাহলে তথ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের গোপন আঁতাত হয়েছিল? ওঠে এমন সব প্রশ্ন। তবে কোনোটির জবাব পাওয়া যায়নি।
পাকিস্তানের সামরিক শাসক আইয়ুব খান তাঁর স্মৃতিকথা ‘ফ্রেন্ডস নট মাস্টার্স’ বইয়ে লিয়াকত আলী খান হত্যাপরবর্তী পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করেছেন। মেজর জেনারেল আইয়ুব খান পাকিস্তানের প্রথম পাকিস্তানি সেনাপ্রধান। লিয়াকত আলী খান তাঁকে সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন।
আইয়ুব খান তাঁর স্মৃতিকথায় লেখেন, ‘পাকিস্তানে ফিরে আমি করাচির নতুন মন্ত্রিসভার বেশ কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। তাঁদের মধ্যে ছিলেন (নতুন) প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন, চৌধুরি মোহাম্মদ আলী, মুস্তাক আহমদ গুরমানিসহ আরও কয়েকজন। তাঁদের কেউই লিয়াকত আলী খানকে নিয়ে কোনো কথা বলেননি। এমনকি আমি তাঁদের কারেও মুখ থেকে সমবেদনা বা দুঃখপ্রকাশ করে একটি শব্দও উচ্চারণ করতে শুনিনি।’
সেই সময় গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদের আচরণ দেখে আইয়ুব খানের মনে হয়েছিল, দেশের একজন প্রখ্যাত ও যোগ্য প্রধানমন্ত্রী যে খুন হয়েছেন, সেই সত্যের বিষয়ে তিনি যেন কিছুই অবগত নন। প্রধানমন্ত্রী খুন হওয়া তাঁদের পেশাজীবনে নতুন এক সূচনা এনে দিয়েছিল বলেই মনে হয়েছিল আইয়ুব খানের।
আইয়ুব খান আরও লেখেন, ‘এটা ঘৃণ্য ও বিদ্রোহপূর্ণ ছিল। এটি হয়তো কঠোর শোনাবে, কিন্তু আমার স্পষ্ট মনে হচ্ছিল, তাঁরা সবাই যেন স্বস্তি বোধ করছেন। মনে হচ্ছিল, তিনি (লিয়াকত আলী) একমাত্র ব্যক্তি ছিলেন, যিনি তাঁদের শাসনে রাখতে পারতেন। কিন্তু তিনিই দৃশ্যপট থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছেন।’
এরপর সময় অনেক গড়িয়েছে। কিন্তু ষড়যন্ত্রের রাজনীতি থেকে পাকিস্তান ও দেশটির সরকার আর বের হতে পারেনি। স্বাধীনতার পর এখন পর্যন্ত পাকিস্তানের কোনো প্রধানমন্ত্রী নিজের পূর্ণ মেয়াদ শেষ করতে পারেননি। মেয়াদ শেষের আগেই তাঁদের ক্ষমতা থেকে সরে যেতে বাধ্য করা হয়েছে।
তথ্যসূত্র: দ্য ডন, ব্রিটানিকা, কোরা ডটকম