রিমান্ডে ইমরান খান

বিক্ষোভ-সংঘর্ষে উত্তাল পাকিস্তান

ইসলামাবাদ ও পাঞ্জাবে সেনা মোতায়েন। সংঘর্ষে নিহত ৫। তবে ইমরানের দলের দাবি, নিহত ৪৭।

পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে গতকালও রাস্তায় নামেন তাঁর দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের কর্মী–সমর্থকেরা। একপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে ব্যাপক সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন তাঁরা। রাজধানী ইসলামাবাদে
ছবি: এএফপি

সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে গ্রেপ্তারের পর উত্তাল পাকিস্তান। গতকাল বুধবার তাঁকে আট দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। এতেই বিক্ষোভ আরও জোরালো হয়েছে। ইমরান খানের দল পিটিআইয়ের নেতা–কর্মীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘর্ষ হয়েছে। পেশোয়ারে চারজনসহ গতকাল পর্যন্ত পাঁচজন নিহত হয়েছেন। তবে পিটিআই দাবি করেছে, দুদিনের বিক্ষোভে ৪৭ জন প্রাণ হারিয়েছেন। তবে এতেও থামছে না বিক্ষোভ। পরিস্থিতি সামাল দিতে রাজধানী ইসলামাবাদ ও পাঞ্জাব প্রদেশে সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। এ ছাড়া আরও দুই প্রদেশে সেনা মোতায়েনের প্রস্তুতি চলছে। দেশের কোথাও কোথাও ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

ইমরান খানকে গত মঙ্গলবার ইসলামাবাদের আদালত চত্বর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তখন বলা হয়েছিল, আল–কাদির ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে গতকাল আনা হলো অন্য অভিযোগ। প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় পাওয়া উপহার তোষাখানায় জমা না দিয়ে বিক্রির মামলায় তাঁকে আদালতে অভিযুক্ত করা হয়েছে।

রাজধানী ইসলামাবাদের হাইকোর্টে গত মঙ্গলবার নিয়মিত হাজিরার অংশ হিসেবে দুটি মামলায় হাজিরা দিতে যান পাকিস্তান তেহরিক–ই–ইনসাফ (পিটিআই) নেতা ইমরান খান। সেখানে আদালত চত্বর থেকেই তাঁকে গ্রেপ্তার করে আধা সামরিক বাহিনী রেঞ্জার্সের সদস্যরা। এরপরই অবশ্য হাইকোর্ট জানতে চেয়েছিলেন, তাঁকে কোন মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রানা সানাউল্লাহ বলেন, দুর্নীতি মামলায় ইমরান খানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জাতীয় জবাবদিহি ব্যুরো (ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টেবিলিটি ব্যুরো–এনএবি) তাঁকে গ্রেপ্তার করেছে।

অভিযোগ উঠেছে, ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় সরকারি উপহার বিক্রি করেছিলেন ইমরান খান। বেআইনিভাবে এই উপহার বিক্রির অভিযোগ আনা হয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। এই মামলায় তাঁকে আট দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। অবশ্য এনএবি ১৪ দিনের রিমান্ডের আবেদন করেছিল। তবে আদালত ৮ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

পুলিশের হেফাজতে ইমরান

ইমরান খানকে মঙ্গলবার আদালত চত্বর থেকে গ্রেপ্তার করে প্রথমে একটি কালো গাড়িতে তুলে নিয়ে যায় আধা সামরিক বাহিনী রেঞ্জার্স। তবে কোথায় রাখা হয়েছে, জানা যায়নি। গতকাল জানা যায়, তাঁকে ইসলামাবাদে পুলিশের একটি অতিথিশালায় রাখা হয়েছে।

জিও টেলিভিশনের ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, গতকাল পুলিশের একটি ভবনে ইমরানের জন্য অস্থায়ী আদালত বসানো হয়েছিল। সেখানে তাঁকে হাজির করা হয়। সেখানে তিনি একটি চেয়ারে বসে আছেন। তাঁর হাতে কিছু নথি রয়েছে। এ সময় তাঁকে শান্ত, তবে ক্লান্ত দেখাচ্ছিল।

ইমরানের বিরুদ্ধে তোষাখানা মামলাটি করেছেন বর্তমান ক্ষমতাসীন জোটের আইনপ্রণেতা মহসিন শাহনেওয়াজ রানঝা। গতকাল তিনি বলেন, ইমরান দেশকে ঝুঁকির মুখে ফেলেছেন।

তবে এই মামলায় বিচার শুরুর বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি ইমরানের দল পিটিআই। যদিও ইমরানের গ্রেপ্তার নিয়েই তারা আইনি লড়াই চালাচ্ছে। তাদের পক্ষ থেকে সুপ্রিম কোর্টে এই গ্রেপ্তারের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আবেদন করা হয়েছে।

ইন্টারনেট বন্ধ, হামলা, গ্রেপ্তার, নিহত

গত মঙ্গলবার ইমরানকে গ্রেপ্তারের পরপরই পাকিস্তানজুড়ে বিক্ষোভ শুরু হয়। ওই দিনই কোয়েটা শহরে একজন এবং পেশোয়ার শহরে একজন নিহত হন। এরপর গতকাল পেশোয়ারে আরও তিনজন নিহত হন। সংঘর্ষে যাঁরা নিহত হয়েছেন, তাঁরা সাধারণ মানুষ বা ইমরানের সমর্থক। তবে ইমরানের দলের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, পেশোয়ারে নিহত হয়েছেন ১৪ জন। দলটির দাবি অনুসারে সবচেয়ে বেশি নিহত হয়েছেন খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের বাতখেলা শহরে। সেখানে নিহত হয়েছেন ২০ জন। এ ছাড়া লাহোর, মালাকান্দ, ফয়সালাবাদসহ আরও কয়েকটি শহরে ১৩ জন নিহত হয়েছেন।

ইমরান খান যেসব প্রদেশে জনপ্রিয়, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম পাঞ্জাব। সেখানে পিটিআইয়ের কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে পুলিশের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। সেখানে এক হাজারের বেশি পিটিআই কর্মী-সমর্থককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এতে তাদের ১৫৭ কর্মকর্তা আহত হয়েছেন। পুলিশ পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে স্থানীয় প্রশাসন সেনা মোতায়েনের আহ্বান জানায়। এই অনুরোধের পরপরই সেখানে সেনা মোতায়েন করা হয়েছে।

পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান

দেশজুড়ে এসব হামলায় পুলিশ সদস্যের পাশাপাশি ইমরানের কর্মী-সমর্থকেরাও আহত হয়েছেন। তবে কী পরিমাণ কর্মী-সমর্থক আহত হয়েছেন, তার সঠিক চিত্র এখনো জানা যায়নি। তবে পিটিআইয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তাদের ১০০ জন আহত হয়েছেন।

পেশোয়ারেও ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এখানে ১৪৪ ধারা জারির পরও সেখানেই সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির ঘটনা ঘটল। সেখানে দুই দিনে চারজন মারা গেছেন।

পেশোয়ারে রেডিও পাকিস্তান ভবনে গতকাল হামলা চালিয়েছেন ইমরানের সমর্থকেরা। সেখানকার পুলিশ কর্মকর্তা নাইম খান বলেন, পিটিআইয়ের কর্মীরা রেডিও অফিসের যন্ত্রপাতি ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন। ভেতরে রেডিও পাকিস্তানের বেশ কিছু কর্মী আটকা পড়েছেন।

ইমরানকে গ্রেপ্তারের পর দেশজুড়ে সংঘর্ষ শুরু হলে কোথাও কোথাও মুঠোফোন ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এই সেবা গতকালও বন্ধ ছিল। আবার কিছু কিছু জায়গায় ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা চালু থাকলেও গতকাল অনলাইননির্ভর অনেক সেবা পাওয়া যায়নি। ফেসবুক ও টুইটার সেবা গতকাল ব্যাহত হয়েছে। এ ছাড়া অনেকে ইউটিউবও ব্যবহার করতে পারেননি।

পরিস্থিতি সামাল দিতে খাইবার পাখতুনখাওয়া ও বেলুচিস্তান প্রদেশের প্রশাসনের পক্ষ থেকে সেনা চাওয়া হয়েছে। জিও টিভির খবরে বলা হয়েছে, শিগগিরই এসব এলাকায় সেনা মোতায়েনের অনুমোদন দিতে পারে সরকার।

এদিকে বিক্ষোভের সময় সরকারি স্থাপনায় হামলার ঘটনার কঠোর সমালোচনা করেছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ। জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে এসব ঘটনাকে সন্ত্রাসী হামলা হিসেবে আখ্যা দিয়ে তিনি বলেছেন, শক্ত হাতে তাদের মোকাবিলা করা হবে।

অহিংস আন্দোলনের ঘোষণা পিটিআইয়ের

ইমরানকে গ্রেপ্তারের পর সারা দেশ অচল করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল পিটিআই। তবে সেই অবস্থান থেকে খানিকটা সরে এসেছে তারা। গতকাল দলটির পক্ষ থেকে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ও বিক্ষোভের আহ্বান জানানো হয়েছে। তবে এই আহ্বানে ইমরানের সমর্থকেরা কতটা সাড়া দেবেন, সেটা দেখার বিষয়। কারণ, পিটিআইয়ের এই আহ্বানের পরও বিক্ষোভ থেকে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।

বিক্ষোভ শুরুর পর পিটিআইয়ের নেতাদের গ্রেপ্তার নিয়ে নানান তথ্য ছড়ানো হচ্ছে। গতকাল পাকিস্তানের গণমাধ্যমের খবরে প্রথমে বলা হয়, পিটিআইয়ের ভাইস চেয়ারম্যান শাহ মাহমুদ কুরেশি গ্রেপ্তার হয়েছেন। পরে এই নেতা বিবৃতি দিয়ে জানান, তিনি গ্রেপ্তার হননি।

তবে পিটিআইয়ের আরেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা ও দলটির মহাসচিব আসাদ ওমরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ইমরান খানের গ্রেপ্তারের বিষয়টিকে চ্যালেঞ্জ করতে সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার পথে তিনি গ্রেপ্তার হন। এ ছাড়া ইমরান সরকারের সাবেক জ্বালানিমন্ত্রী মুহাম্মদ হাম্মাদ আজহারের বাড়িতে তল্লাশি চালিয়েছে পুলিশ। এ ছাড়া আরও নয়জন নেতার বাসায় তল্লাশি চালানো হয়েছে বলে দাবি করেছে পিটিআই।

ক্ষোভ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে

ইমরানের নিজ শহর লাহোরে ব্যাপক বিক্ষোভ চলছে। সেখানে সেনানিবাসে হামলা চালান ইমরানের সমর্থকেরা। কয়েক ঘণ্টা ধরে চলে এই হামলা। সেখানে সেনাবাহিনীর এক শীর্ষ জেনারেলের বাসায়ও হামলা চালানো হয়। এ ছাড়া রাওয়ালপিন্ডিতে সেনা সদর দপ্তরেও হামলা চালিয়েছিলেন ইমরানের সমর্থকেরা।

এসব হামলা ও দেশজুড়ে সহিংসতার নিন্দা জানিয়েছে সেনাবাহিনী। এ ঘটনাকে দেশটির ইতিহাসে ‘কালো অধ্যায়’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে তারা। পাকিস্তানের আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে আইন অনুযায়ী গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারের পরপরই সেনাবাহিনীর বিভিন্ন স্থাপনা ও অবকাঠামো লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়েছে। বাহিনীর বিরুদ্ধে স্লোগান দেওয়া হয়েছে। এভাবে কাউকে আইন নিজের হাতে তুলে নিতে দেওয়া হবে না। এ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

হামলার পর পাকিস্তানের প্রভাবশালী পত্রিকা ডন–এর সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, ইমরান খানকে গ্রেপ্তারের পরে যেভাবে হামলা চালানো হয়েছে এবং যেসব স্থানে হামলা চালানো হয়েছে, তাতে এটাই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, সেবাহিনীর ওপর জনসাধারণের ক্ষোভ রয়েছে।

ইমরানের নির্বাচন নিয়ে ধোঁয়াশা

গত বছর পিটিআইয়ের নেতৃত্বাধীন জোটে ফাটল ধরলে আস্থা ভোটে হেরে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন ইমরান খান। এর পর থেকেই তাঁর বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা হচ্ছিল। সর্বশেষ গত বছরের নভেম্বরে নির্বাচনের দাবিতে লংমার্চ শুরু করলে তাঁর ওপর হামলা চালানো হয়। ইমরান তাঁর সরকারের পতন ও লংমার্চে তাঁর ওপর হামলার জন্য বারবার সেনাবাহিনীকে দায়ী করছিলেন। এই অভিযোগের বিপরীতে গত সোমবার সেনাবাহিনী বিবৃতি দিয়ে ইমরানের দাবিকে ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দেয়। এরপর ২৪ ঘণ্টা না পেরোতেই মঙ্গলবার তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।

ক্ষমতা ছাড়ার পর ইমরানের বিরুদ্ধে শতাধিক দুর্নীতির মামলা হয়েছে। এসব মামলা বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, কোনো মামলায় অভিযোগ প্রমাণিত হলে তিনি আর নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। চলতি বছরের শেষ দিকে পাকিস্তানে নির্বাচন হতে পারে। ফলে ইমরান খান আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন কি না, তা নিয়ে একধরনের ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে।