পাকিস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর লাহোর। এই শহরের বাসিন্দা নিদা জিশান। ৩২ বছর বয়সী এই নারীর বাড়িতে একটি নিয়ম আছে। নিয়মটি হচ্ছে, পরিবারের সদস্যরা যখন এক হবেন, তখন রাজনীতি নিয়ে কোনো আলাপ চলবে না।
২০১৮ সালের জুলাইয়ে ইমরান খান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরই জিশানদের বাড়িতে নিয়মটি কার্যকর হয়।
জিশান নিজেকে ইমরানের একজন ঘোর সমর্থক হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, ‘আমার মনে আছে, আমার বাবা ২০১৮ সালের নির্বাচনে ইমরানকে ভোট দেননি। এ জন্য আমি ও আমার বোন তিন মাস তাঁর (বাবা) সঙ্গে কথা বলিনি। আমরা একত্রে খাবার খেতে বা কিছু করার জন্য একসঙ্গে বসতে পর্যন্ত পারিনি।’
পরিবার ও বন্ধুদের মধ্যে রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে পাকিস্তানে পারিবারিক-সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে যতটা চিড় ইমরানকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে, তা দেশটির আর কোনো রাজনীতিবিদকে ঘিরে হয়নি।
ক্রিকেট তারকা থেকে রাজনীতিবিদ বনে যান ইমরান। তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই ও পাকিস্তানের ভঙ্গুর অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার অঙ্গীকার করে ২০১৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন। ২০২২ সালে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন। গত বছরের মাঝামাঝি থেকে তিনি কারাগারে।
ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে ইমরানের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা হচ্ছে। ইতিমধ্যে কয়েকটি মামলায় তাঁর সাজা হয়েছে। সাজার কারণে আগামী বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠেয় সাধারণ নির্বাচনে তিনি লড়তে পারছেন না।
৭১ বছর বয়সী ইমরানের দাবি, নির্বাচন থেকে তাঁকে দূরে রাখতেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তাঁর বিরুদ্ধে মামলাগুলো করা হয়েছে।
প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে না পারলেও ৮ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের আগে পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিসরে, সামাজিক আলোচনায় ইমরানকে নিয়েই আলোচনা বেশি।
জিশান বলেন, ‘আমি জোর গলায় বলতে পারি, আমি ইমরানকে ভালোবাসি। কিন্তু আমার বাবা মনে করেন, তিনি (ইমরান) ভালো রাজনীতিবিদ নন।’
জিশান বলেন, তিনি বিশেষ করে ইমরানের একটি ইসলামিক কল্যাণ রাষ্ট্রের আদর্শের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। এই রাষ্ট্রে সবার জন্য সমতা থাকবে—এমনটাই বলেছিলেন ইমরান।
কিন্তু জিশানের বাবা জনতুষ্টিবাদী (পপুলিস্ট) রাজনীতিক ইমরানকে সমর্থন করেন না। তাঁকে সমর্থন না করার মূলে আছে—রাজনৈতিক জীবনের শুরুতে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে ইমরানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার বিষয়টি।
পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীকে দেশটির সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণ্য করা হয়। দেশটির রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর গভীর প্রভাব রয়েছে।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়। পাকিস্তান সৃষ্টির পর তিন দশকের বেশি সময় দেশটি সরাসরি শাসন করেছে সামরিক বাহিনী। এখনো পাকিস্তানের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর বড় ধরনের ভূমিকা রয়েছে।
পাকিস্তানের কোনো প্রধানমন্ত্রী কখনো পাঁচ বছরের মেয়াদকাল শেষ করতে পারেননি। তবে ৪ জন সামরিক স্বৈরশাসকের মধ্যে ৩ জনই ৯ বছরের বেশি সময় ধরে দেশটি শাসন করেছিলেন।
জিশান বলেন, ‘আমি মনে করি, আমার বাবা ইমরানকে তাঁর অতীত জীবন দিয়ে বিচার করছেন। যা-ই হোক না কেন, রাজনৈতিক মতপার্থক্যের সমাধান কঠিন। তাই আমরা যখন একত্র হই, তখন রাজনীতি নিয়ে কথা না বলার বিষয়ে সম্মত হয়েছি।’
পাকিস্তানে ব্যাপকভাবে ধারণা রয়েছে, দেশটির সামরিক বাহিনীর সমর্থনে ইমরান প্রথমে রাজনৈতিকভাবে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। কিন্তু তিনি ক্ষমতায় আসার পর উভয় পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। দেশটির গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানের নিয়োগ নিয়ে তৎকালীন সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে ইমরানের বিরোধ দেখা দিয়েছিল বলে জোর আলোচনা ছিল।
প্রধানমন্ত্রী পদে চার বছর থাকার পর পার্লামেন্টে বিরোধীদের আনা অনাস্থা ভোটে ইমরান ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন।
ইমরান অভিযোগ করেন, তাঁকে ষড়যন্ত্র করে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত এই বিদেশি ষড়যন্ত্রে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীও জড়িত ছিল।
অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তান সামরিক বাহিনী উভয়ে ইমরানের তোলা অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
ইমরানকে ক্ষমতাচ্যুতির ঘটনা পিটিআইয়ের সমর্থকদের উত্তেজিত করে তোলে। জিশানের মতো ব্যক্তিরা ইমরানের পক্ষে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
জিশান বলেন, দুর্ভাগ্যবশত ইমরান তাঁর পরিকল্পনার সবটা বাস্তবায়নের জন্য পর্যাপ্ত সময় ও সুযোগ পাননি। তা ছাড়া দেশের পরিস্থিতি ও অন্যান্য শক্তি তাঁকে কাজ করতে দেয়নি।
ইমরান কারাগারে থাকলেও তাঁর জনপ্রিয়তা কমেনি।
গত ডিসেম্বরে গ্যালাপের জরিপে দেখা যায়, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নওয়াজ শরিফের চেয়ে ইমরানের প্রতি জনসমর্থন ৫ শতাংশ বেশি।
গত মাসে ব্লুমবার্গের পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, পাকিস্তানের নাজুক অর্থনীতি সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য কিছু পাকিস্তানি বিশেষজ্ঞের কাছে পছন্দের শীর্ষ আছেন ইমরান।
পাকিস্তানের কিছু নাগরিক বলছেন, ইমরান নিজেকে একজন ‘পরিবর্তনের প্রার্থী’ হিসেবে চিত্রিত করে দেশটিতে একটি রাজনৈতিক জাগরণ সৃষ্টি করেছিলেন। তিনি পাকিস্তানে পারিবারিক রাজনীতির অবসানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
পাকিস্তানের পাঞ্জাবের নবীপুরা গ্রামের বাসিন্দা মুহাম্মদ হাফিজ। পেশায় কৃষক হাফিজ বলেন, ইমরান ও তাঁর দল পিটিআই তাঁর মতো একজন গ্রামবাসীর কাছে এই বিষয় তুলে ধরেছিলেন যে কীভাবে দুটি দল জাতির সম্পদ লুণ্ঠন করেছে। তিনিই শিখিয়েছেন, কীভাবে পরিবর্তনের জন্য ভোট দিতে হয়।
হাফিজ এখানে লুণ্ঠনকারী দল বলতে, পাকিস্তান মুসলিম লীগ (পিএমএল-এন) ও পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) কথা বুঝিয়েছেন। এই দুটি রাজনৈতিক পরিবার কয়েক দশক ধরে পাকিস্তানের রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করে আসছে।
পিএমএল-এন ও পিপিপি একসময় পরস্পরের প্রতিপক্ষ ছিল। কিন্তু ২০২২ সালে ইমরান ও তাঁর দল পিটিআইকে ক্ষমতাচ্যুত করতে তারা এক জোট হয়েছিল।
পিএমএল-এনের প্রার্থী নওয়াজ শরিফ নির্বাচনে জয়লাভ করে রেকর্ড চতুর্থ মেয়াদে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবেন বলে ব্যাপকভাবে ধারণা করা হচ্ছে।
বিষয়টিকে নওয়াজের রাজনৈতিক ভাগ্যের নাটকীয় পরিবর্তন হিসেবে দেখা হচ্ছে। ১৯৯৯ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানে তাঁকে তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদের প্রধানমন্ত্রিত্বের পদ থেকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছিল। অপহরণ ও সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। দুর্নীতির অভিযোগে তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল।
সৌদি আরবে নির্বাসনে গিয়েছিলেন নওয়াজ। ২০০৭ সালে তিনি সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরে আসেন। ২০১৩ সালে তিনি তৃতীয়বারের মতো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন।
পানামা পেপারস-সংক্রান্ত দুর্নীতির তদন্তের জেরে ২০১৭ সালে নওয়াজকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করা হয়। এক বছর পর পৃথক দুর্নীতির মামলায় তাঁকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এই ঘটনা ইমরানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথ তৈরি করে দেয়।
এখন ইমরান কারাগারে। আর নওয়াজের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথ পরিষ্কার। অনেকেই মনে করছেন, এবার নওয়াজই দেশটির সেনাবাহিনীর পছন্দের প্রার্থী।
কৃষক হাফিজ বলেন, ইমরান মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করেছেন। আগে মানুষ নিজেদের অধিকারের পক্ষে কথা বলার জন্য রাজনৈতিকভাবে যথেষ্ট সচেতন ছিল না।
তবে অন্যান্য পর্যবেক্ষক অভিযোগ করে থাকেন, ইমরানের রাজনীতি জনগণকে উত্তেজিত করা ও জনতুষ্টিবাদ ছাড়া আর কিছুই নয়।
কেউ কেউ মনে করেন, ইমরানের সবচেয়ে বড় ‘অপরাধ’ ছিল দেশটির সামরিক বাহিনীকে চ্যালেঞ্জ করা। কারণ, তারা দীর্ঘদিন ধরেই পাকিস্তানের রাজনীতির চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রক। তারা ‘এস্টাবলিশমেন্ট’ হিসেবে পরিচিত।
দেশটির কিছু অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। তাঁদের অভিযোগ, এই কথা বলে তাঁরা সামরিক নেতাদের রোষে পড়েছেন।
একজন অবসরপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তা বলেন, তাঁকে ইমরানের পক্ষে কথা বলা বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
অবসরপ্রাপ্ত এই সামরিক কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘আমি বলেছি, আমি তাঁর (ইমরান) পক্ষে কথা বলছি না। আমি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধেও বলছি না। আমি কিছু ব্যক্তির নীতি ও হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে বলছি, যাঁরা দেশের ক্ষতি করছেন।’
কিছু অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেন, ইমরানের বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোটে সমর্থন না করায় তাঁদের দোষারোপ করা হয়েছে। কেউ কেউ দাবি করেন, তাঁদের পেনশন ও অন্যান্য সরকারি সুবিধা স্থগিত করা হয়েছে। আবার কাউকে কাউকে হুমকি দেওয়া হয়েছে, তাঁদের বিরুদ্ধে আরও পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তখন থেকে অনেকেই চুপ হয়ে গেছেন।
বিবিসির পক্ষ থেকে সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে যোগাযোগ করা হলেও তারা কোনো জবাব দেয়নি। গত বছর সেনাবাহিনীর এক মুখপাত্র বলেন, অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তারা সেনাবাহিনীর সম্পদ। কিন্তু তাঁরা আইনের ঊর্ধ্বে নন। তিনি সতর্ক করে দেন, তাঁদের কোনো সংগঠনের সঙ্গে জড়িত হওয়া উচিত নয়।
ইমরানকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন গত মাসে ব্যালট পেপারে ইমরানের দলের ক্রিকেট ব্যাট প্রতীক নিষিদ্ধ করে। নির্বাচন কমিশনের এই সিদ্ধান্তে ইমরানের দল পিটিআই বড় ধরনের ধাক্কা খায়। সবকিছু মিলিয়ে মনে হতে পারে, ইমরানকে কার্যকরভাবে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া হয়েছে।
ইমরানকে নিষ্ক্রিয় করার চেষ্টা করলে কী হবে, তাঁকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানজুড়ে রাজনৈতিক বিভাজন আরও গভীর হতে চলছে।
ইমরানের সমর্থক জিশান বলছিলেন, এমনকি বন্ধুরাও তাঁর রাজনৈতিক সীমারেখা জানে। যখনই কেউ এই সীমারেখা অতিক্রমের চেষ্টা করে, তিনি সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ বন্ধ করে দেন।