ইসলামাবাদ ঘিরে থাকা সড়কগুলোয় কয়েক সপ্তাহ ধরেই সারি করে রাখা জাহাজের কনটেইনার; আছে অন্যান্য প্রতিবন্ধকতাও। যেকোনো বিক্ষোভে যাতে তাৎক্ষণিকভাবে কাজে লাগানো যায়, সেভাবেই প্রস্তুত রাখা হয়েছে এগুলো।
পাকিস্তানের রাজধানীকে এভাবে অবরুদ্ধ করে রাখা এখন এক নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অস্থিরতা তৈরি হওয়ার কোনো ইঙ্গিত পেলেই রাজধানীকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে কর্তৃপক্ষ। সড়কগুলোয় থাকা ওই সব কনটেইনার ও প্রতিবন্ধকতা নগরবাসীকে যেকোনো মুহূর্তে যেকোনো কিছু ঘটার কথাই সর্বক্ষণ মনে করিয়ে দেয়।
গত রোববারের ঘটনা। নগরের চারপাশজুড়ে ২৯টি রুট (পথ) আটকে দেওয়া হয় কনটেইনার দিয়ে। কারাবন্দী সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের পাকিস্তান তেহরিক–ই–ইনসাফ (পিটিআই) দলের সমর্থকেরা পূর্বঘোষিত মিছিল ও সমাবেশে অংশ নিতে রাজধানী অভিমুখে রওনা দেন। অনেকের হাতে ছিল পতাকা, ব্যানার। ছিল ইমরানের ছবিসংবলিত বড় পোস্টার। সমর্থকেরা ‘ইমরান খান জিন্দাবাদ’সহ (ইমরান খান দীর্ঘজীবী হোন) নানা স্লোগানে এলাকা মুখরিত করে তোলেন।
‘দ্য পিসফুল অ্যাসেম্বলি অ্যান্ড পাবলিক অর্ডার অ্যাক্ট ২০২৪’ নামে গত সপ্তাহে পাস করা আইনে সমাবেশের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। ‘অবৈধভাবে’ সমাবেশ করা ব্যক্তিদের তিন বছর ও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তির করলে ১০ বছর কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে আইনটিতে।
সড়কে রাখা বিশাল বিশাল কনটেইনার আটকে রাখতে পারেনি ইমরান খানের সমর্থকদের স্রোত। সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত ভিডিওতে দেখা যায়, সমর্থকেরা সারি বেঁধে ঠেলে ধাতব প্রতিবন্ধকতাগুলো একপাশে সরিয়ে দিচ্ছেন। এভাবেই সমাবেশস্থল অভিমুখে এগিয়ে চলেছেন তাঁরা।
কিন্তু যাঁর মুখচ্ছবি সমর্থকদের হাতে হাতে, তিনিই (ইমরান খান) সমাবেশে নেই। এক বছরের বেশি সময় ধরে ইমরান কারাগারে রয়েছেন। দুর্নীতি ও রাষ্ট্রীয় গোপন নথি ফাঁস করার অভিযোগ আনা হয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।
ইমরান তাঁর বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে আখ্যা দিয়েছেন। জাতিসংঘের একটি ওয়ার্কিং গ্রুপও বলেছে, স্বৈরাচারী কায়দায় আটক করা হয়েছে তাঁকে। তবে তাঁকে মুক্তি দেওয়ার সম্ভাবনা কমই দেখা যাচ্ছে। অধিকাংশ বিশ্লেষক বলছেন, পাকিস্তানে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী সামরিক বাহিনীর সম্মতি ছাড়া ইমরান খানের মুক্তি নেই।
কিন্তু এরপরও দমে নেই পিটিআইয়ের নেতা–কর্মী ও সমর্থকেরা। সব প্রতিন্ধকতা ডিঙিয়ে রোববার সমাবেশ করেছেন তাঁরা।
খাইবার পাখতুনখাওয়ার মুখ্যমন্ত্রী আলি আমিন গান্ডাপুর বলেন, ‘পাকিস্তানিদের কথা শুনুন। যদি এক বা দুই সপ্তাহের মধ্যে ইমরানকে আইনগতভাবে মুক্তি না দেওয়া হয়, তবে স্রষ্টার নামে শপথ করছি, আমরা নিজেরাই তাঁকে মুক্ত করব। আপনি কি তৈরি?’
বিক্ষোভ দমনে সরকারের প্রতিক্রিয়া ছিল তাৎক্ষণিক। সমাবেশের পরের দিন সন্ধ্যা থেকে সামাজিক মাধ্যম ও টেলিভিশনে এ কথা ছড়িয়ে পড়তে থাকে যে দমনাভিযান শুরু হয়েছে। পাকিস্তানের পার্লামেন্টের এক ফুটেজে দেখা যায়, পিটিআই চেয়ারম্যান ও আইনপ্রণেতা গওহার আলি খানকে সেখান থেকে জোরপূর্বক বের করে আনা হচ্ছে, পুলিশ তাঁর হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে আর তাঁকে ঘিরে আছে ক্যামেরা ও মুঠোফোন।
এর (সরকার ও পিটিআইয়ের ইঁদুর–বেড়াল খেলা) পরিণাম বিপজ্জনক। সবচেয়ে খারাপ যে ফলাফল হতে পারে সেটি হলো, পাকিস্তান আরও অস্থিতিশীল হয়ে পড়তে পারে। এতে দেশটির অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা আগের চেয়ে বেশি কঠিন হবে।মাইকেল কুগেলম্যান, উইলসন সেন্টারের সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক
এদিকে, সিসিটিভির ফুটেজে দেখা যায়, জাতীয় পরিষদের আরেক সদস্য সোয়েব শাহিনকে তাঁর কক্ষ থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ঘটনাস্থলে কিছু মানুষ বিভিন্ন দরজা দিয়ে ঢুকছেন, ও বের হচ্ছেন।
এই নেতাদের মধ্যে ঠিক কাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তা নিয়ে বিভিন্ন হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে ধোঁয়াশা তৈরি হয়। ওই ঘটনার পরদিন সকালে পুলিশ বিবিসিকে নিশ্চিত করে, তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে তারা। অবশ্য, পিটিআই বলেছে, গ্রেপ্তারের এ সংখ্যা ১০–এর বেশি। পরে গওহার আলি খানকে মুক্তি দেওয়া হয়, কিন্তু অন্যরা এখনো পুলিশি হেফাজতে রয়েছেন।
এই নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে এক নতুন আইনে। গত সপ্তাহে পাস করা এ আইনকে মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ‘শান্তপূর্ণভাবে সমাবেশের অধিকারের ওপর আরেক হামলা’ বলে আখ্যায়িত করে। ‘দ্য পিসফুল অ্যাসেম্বলি অ্যান্ড পাবলিক অর্ডার অ্যাক্ট ২০২৪’ নামের এ আইনে সমাবেশের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। ‘অবৈধভাবে’ সমাবেশ করা ব্যক্তিদের তিন বছর ও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তির করলে ১০ বছর কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে আইনটিতে।
রোববার সমাবেশ আয়োজনের অনুমতি নিয়েছিল পিটিআই। কিন্তু পুলিশ অভিযোগ করে, নির্ধারিত সময়ের পরও সমাবেশ চলে এবং এতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বড় রকমের ব্যত্যয় ঘটে।
ইমরান খানের পিটিআই দল ও সরকারি কর্তৃপক্ষের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে ‘ইঁদুর–বেড়াল খেলা’ চলার মধ্যে চলে ওই ধরপাকড়। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন ওঠে, পাকিস্তানের ওপর ক্ষমতার এ দ্বন্দ্বের তাৎপর্য কী।
ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান উইলসন সেন্টারের সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, এর পরিণাম বিপজ্জনক। সবচেয়ে খারাপ যে ফলাফল হতে পারে, সেটি হলো পাকিস্তান আরও অস্থিতিশীল হয়ে পড়তে পারে। এতে দেশটির অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা আগের চেয়ে বেশি কঠিন হবে।
ইমরান তাঁর বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে আখ্যা দিয়েছেন। জাতিসংঘের একটি ওয়ার্কিং গ্রুপও বলেছে, স্বৈরাচারী কায়দায় আটক করা হয়েছে তাঁকে। তবে তাঁকে মুক্তি দেওয়ার সম্ভাবনা কমই দেখা যাচ্ছে। অধিকাংশ বিশ্লেষক বলছেন, পাকিস্তানে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী সামরিক বাহিনীর সম্মতি ছাড়া ইমরান খানের মুক্তি নেই।
বর্তমানে পাকিস্তান তার অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। পাশাপাশি দেশটিতে বেড়েছে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা।
কুগেলম্যান বলেন, ‘পিটিআই নেতা–কর্মীদের দমনে সেনাবাহিনীকে মূল চালিকা শক্তি হিসেবে ধরা হয়। অনেক বছর ধরে সেনাবাহিনী নিজেদের মতো করে ভিন্নমত মোকাবিলা করেছে। দমনাভিযান চালানোর মধ্য দিয়ে তাতে সফলও হয়েছে তারা। কিন্তু এখন সামাজিক মাধ্যমের যুগ। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলে পিটিআইও সামাজিক মাধ্যমের সদ্ব্যবহারে সক্ষম হচ্ছে।’
এ অবস্থাকে সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে ‘খুব উদ্বেগের’ বলে বর্ণনা করেন মাইকেল কুগেলম্যান। তিনি বলেন, এমন পরিস্থিতিতে এটা বিস্ময়ের হবে না যে তারা (সেনাবাহিনী) বিরোধীদের দমনে এমন পন্থা অবলম্বন করবে, যা দৃশ্যত মনে হবে মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগের, কিন্তু তাকে পুরোপুরি অগণতান্ত্রিক বলা যাবে না।
‘অবৈধ’ সভা–সমাবেশ করা নিয়ে আইন প্রণয়ন, পার্লামেন্ট ভবন থেকে আইনপ্রণেতাদের গ্রেপ্তারের ঘটনার বাইরে অনলাইন কার্যক্রম সীমিত করা নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনায় নেমেছেন ডিজিটাল অধিকারের পক্ষে সোচ্চার হওয়া কর্মীরা।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর থেকে পাকিস্তানে সামাজিক মাধ্যম ‘এক্স’ ভিপিএন ছাড়া কাজ করছে না। সামরিক বাহিনী বারবার ‘সাইবার সন্ত্রাসের’ বিপদ নিয়ে কথা বলেছে। সরকারও সম্প্রতি বলেছে, সাইবার নিরাপত্তায় একটি ফায়ারওয়াল (বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা) গড়ে তুলছে তারা। কিন্তু এটি বাক্স্বাধীনতা সীমিত করবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে একজন মন্ত্রী বলেছেন, ‘এটা কোনো কিছুই আটকাবে না।’
তবে সরকারের এ পদক্ষেপকে পিটিআইয়ের সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার সীমিত করার চেষ্টা হিসেবেই দেখছেন অনেকে।