চার বছর লন্ডনে স্বেচ্ছানির্বাসনে থাকার পর আজ শনিবার সাবেক পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ দেশে ফিরেছেন। পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনকে সামনে রেখে তাঁর দেশে প্রত্যাবর্তন।
পাকিস্তানে নওয়াজ শরিফের দীর্ঘদিনের ক্যারিয়ারের দিকে তাকালে দেখা যাবে, বেশির ভাগ সময় দেশটির ক্ষমতাশালী সেনাবাহিনীর পাশে তিনি ছিলেন একটি কাঁটার মতো। সবশেষ পাকিস্তান ছাড়ার আগেও তিনি দুর্নীতির অভিযোগে কারারুদ্ধ ছিলেন। শারীরিক অসুস্থতার কারণে চিকিৎসার কথা বিবেচনা করে ২০১৯ সালের নভেম্বরে তাঁকে কারাগার থেকে বিদেশে চিকিৎসার অনুমতি দেওয়া হয়। তিনি তখন লন্ডনে চলে যান।
তবে এখন পরিস্থিতি পাল্টেছে। অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে সেনাবাহিনী নওয়াজকে উৎখাত করেছিল, তারাই আবার এখন তাঁকে অভ্যর্থনার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এমনকি তাঁকে আবার প্রধানমন্ত্রীও করা হতে পারে।
আরও কিছু পরিবর্তন হয়েছে। নওয়াজ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ২০১৮ সালে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ইমরান খান প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। কিন্তু এখন আর তিনি প্রধানমন্ত্রী নেই। তিনি ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন এবং কারাগারে আছেন।
চার বছর আগে চিকিৎসার জন্য জামিনে ছাড়া পাওয়ার পর এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে লন্ডনে যান পাকিস্তানের তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ। গত চার বছর সেখানেই ছিলেন তিনি।
২০২২ সালে পার্লামেন্টে অনুষ্ঠিত অনাস্থা ভোটের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইমরান খান ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর নওয়াজের রাজনৈতিক তৎপরতা বাড়তে দেখা যায়।
নওয়াজ শরিফের দল পিএমএল-এন সর্বশেষ পাকিস্তানের শাসনক্ষমতায় ছিল। তাঁর ছোট ভাই শাহবাজ শরিফ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এখন বড় ভাই দেশে ফিরেছেন।
নওয়াজের বিরুদ্ধে মামলাগুলো এখনো শেষ হয়নি। তবে দেশে ফেরার পর নওয়াজ শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত গ্রেপ্তার হননি। গ্রেপ্তার হওয়ার আশঙ্কাও নেই। আগামী সপ্তাহের শুনানি পর্যন্ত তাঁকে জামিন দেওয়া হয়েছে।
নওয়াজের দল পরিষ্কার করে বলে দিয়েছে, তিনিই আসন্ন নির্বাচনে দলের প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হবেন। চলতি বছর নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। তবে তা পিছিয়ে ২০২৪ সাল করা হয়েছে।
তবে তার আগে ৭৩ বছর বয়সী নওয়াজকে কিছু বিষয় সামাল দিতে হবে। দেশের অর্থনৈতিক সংকটের জন্য অনেকে নওয়াজের দলকে দায়ী করে থাকে। এ বিষয়টি তাঁকে সামাল দিতে হবে। শুধু তা–ই নয়, অনেকের আশঙ্কা প্রধান বিরোধী নেতাকে কারাগারে আটকে রেখে নির্বাচন হলে তা সুষ্ঠু হবে না। এ ছাড়া, নওয়াজকে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সঙ্গেও বোঝাপড়া করতে হবে। কারণ, পাকিস্তান কীভাবে পরিচালিত হবে, তা নির্ধারণে দেশটির সেনাবাহিনীর ভূমিকা অনেক বেশি।
বিদেশে নির্বাসনে থাকাকালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে সরব ছিলেন। বিশেষ করে তিনি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার জন্য দেশটির গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের সাবেক প্রধান এবং সাবেক সেনাপ্রধানকে দায়ী করতেন। তবে তাঁরা দুজনই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
নওয়াজের অভিযোগ, তাঁকে ‘ভুয়া মামলায়’ ফাঁসানো হয়েছে। এ ক্ষেত্রে পাকিস্তানের বিচারপতিদের যোগসাজশ ছিল বলেও দাবি করেন তিনি। নওয়াজের অভিযোগ, এ ধরনের কর্মকাণ্ড দেশের গণতন্ত্রকে পঙ্গু করে দিয়েছে। এসব কারণে পাকিস্তানের কোনো প্রধানমন্ত্রী তাঁদের সাংবিধানিক মেয়াদ শেষ করতে পারেননি।
নওয়াজের রাজনৈতিক বিরোধীদের সন্দেহ, সেনাবাহিনীর সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে পিএমএল-এন নেতা দেশে ফেরার সুযোগ পেয়েছেন। তবে তাঁরা মনে করেন, এর মধ্য দিয়ে নওয়াজ যে নির্বাচনে জয়ী হবেন, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
ইমরান খানের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান তেহরিক–ই–ইনসাফ (পিটিআই) দলের নেতা জুলফি বুখারি বিবিসিকে বলেন, ‘আমি তাঁকে আবারও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চাই না। কারণ, তাঁর বিরুদ্ধে মামলা আছে। তা ছাড়া আদালত তাঁকে আজীবনের জন্য অযোগ্য ঘোষণা করেছিলেন।’
রাজনীতি বিশ্লেষক ওয়াজাহাত মাসুদ মনে করেন, যা কিছু হচ্ছে তাতে পাকিস্তানের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বা পরিস্থিতির কোনো বদল ঘটবে না। শুধু রাজনৈতিক অঙ্গনের মানুষগুলোরই অদলবদল ঘটছে।
বিবিসিকে তিনি বলেন, ২০১৮ সালে নির্বাচনের সময় ইমরান খান রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছ থেকে সুবিধা পেয়েছেন। এবার নির্বাচনে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী নওয়াজ শরিফের পক্ষে কাজ করছে।
তবে নওয়াজকে সমর্থন দেওয়া নিয়ে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এখনো কিছু বলেনি।
নওয়াজের প্রতিদ্বন্দ্বী ইমরান খান এখন কারাগারে আছেন। তাঁর গ্রেপ্তারকে কেন্দ্র বিক্ষোভ করার কারণে সমর্থকদের ওপরও ধরপাকড় চালানো হয়েছে। এতে ইমরানের দল পিটিআই অনেকটাই কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। এমন অবস্থায় অনেকে আশঙ্কা জানিয়েছেন নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না।
ইমরান খান গ্রেপ্তার হওয়ার আগে পরিচালিত জনমত জরিপে তাঁর দল পিটিআই এগিয়ে ছিল। পিটিআই নেতা জুলফি বুখারি মনে করেন এখন আর নির্বাচনের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নেই।
বুখারি বলেন, ‘নির্বাচনের আগে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতাকে কীভাবে কারাবন্দী করে রেখেছেন আপনারা? আপনারা যদি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করেন, তবে দেখবেন ইমরানের ভোটব্যাংক কতটা শক্তিশালী।’
২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে নওয়াজ যখন কারাগারে ছিলেন, তখন তাঁর দলের সদস্যরাও একই ধরনের কথা বলেছিলেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটছে। তবে এবার পিটিআই লাভবান হবে না, এবার সুবিধা পাবে পিএমএল-এন।
পাকিস্তানের রাজনীতিতে দেশটির সেনাবাহিনীর প্রভাবশালী ভূমিকা আছে। তারা দেশটিতে বেশ কয়েকবার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা গ্রহণ করেছিল। নওয়াজের সঙ্গেও তাদের দীর্ঘদিনের তিক্ততা দেখা গেছে। তবে রাজনীতি পর্যবেক্ষক ওয়াজাহাত মাসুদ মনে করেন, এসবের পরও পাকিস্তানের সেনাবাহিনী নওয়াজকে আরেকটি সুযোগ দিতে চাইছে বলে মনে হচ্ছে।
মাসুদ বলেন, প্রথমে সেনাবাহিনী ইমরান খানকে নিরাপদ ভেবেছিল এবং তাঁকে বেছে নিয়েছিল। তবে যখন তারা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ল তখন ইমরানকে ক্ষমতা থেকে নামিয়ে দেওয়া হলো।
নিজের ক্যারিয়ারের বেশির ভাগ সময় সেনাবাহিনীর সঙ্গে দ্বন্দ্ব থাকা নওয়াজ এখন কী ভূমিকা পালন করবেন, সে প্রশ্নও দেখা দিয়েছে।
এ ব্যাপারে সাবেক পার্লামেন্ট সদস্য নাদিম আফজাল চ্যান বলেন, তিনি (নওয়াজ) ‘ইয়েস স্যার’ বলার মতো ভূমিকা পালন করবেন না। নাদিম মনে করেন, নওয়াজ তাঁর সীমা সম্পর্কে জানেন। সে সীমা কখন ভাঙতে হবে তাও তিনি জানেন।
ইমরান খান প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে তাঁর মুখপাত্র হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন নাদিম আফজাল।
তিনি এবং অন্য বিশ্লেষকদের ধারণা, কিছু ক্ষেত্রে দ্বন্দ্ব হবেই। এটা সময়ের ব্যাপার মাত্র।
তাঁরা মনে করেন, প্রথমে নির্বাচনের তারিখ ঠিক করতে হবে। অর্থনীতিকে ধসে পড়া থেকে রক্ষা করাই নির্বাচনী প্রচারের মূল বিষয হওয়া উচিত।