পাকিস্তানের নির্বাচনে জাতীয় পরিষদের ১৮টি আসনে ফল পাল্টে দেওয়ার অভিযোগ করেছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই)। দলটির দাবি, এসব আসনে তাদের প্রার্থীরা জয়লাভ করেছিলেন। এদিকে অনিয়মের তদন্ত না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচনের ফলাফলকে স্বীকৃতি না দিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন কয়েকজন মার্কিন আইনপ্রণেতা।
গতকাল রোববার পিটিআইয়ের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, জাতীয় পরিষদের ১৮টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের প্রাপ্ত ভোটের হিসাবসংক্রান্ত ‘ফরম ৪৭’ পাল্টে দিয়েছেন রিটার্নিং কর্মকর্তারা।
গত বৃহস্পতিবার জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে ভোট গ্রহণের দিন মুঠোফোন সেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। প্রাথমিক ফলাফল ঘোষণাও বিলম্বিত হয়। ফল পেতে শনিবার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে।
জাতীয় পরিষদের ২৬৬ আসনে ভোট হয়ে থাকে। তবে প্রার্থী মারা যাওয়ায় এক আসনে ভোট গ্রহণ স্থগিত করা হয়। এখন পর্যন্ত ২৬৪ আসনের ফল প্রকাশ করেছে পাকিস্তান নির্বাচন কমিশন।
ঘোষিত ফলাফল অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি ১০১ আসনে জয় পেয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। তাঁদের প্রায় সবাই পিটিআই–সমর্থিত। এরপরই পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন) ৭৫ আসনে, পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) ৫৪ ও মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট পাকিস্তান (এমকিউএম) ১৭ আসনে জয়ী হয়েছে। এ ছাড়া অন্যান্য দল পেয়েছে ১৭টি আসন।
পিটিআই দাবি করেছে, জাতীয় পরিষদ এবং দুটি প্রাদেশিক পরিষদের তারা একক দল হিসেবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। নির্বাচনের আগে হারানো ‘ক্রিকেট ব্যাট’ প্রতীক ফিরে পাওয়ারও অঙ্গীকার করেছে দলটি।
কয়েকটি মামলায় দণ্ডিত ইমরান খান বর্তমানে কারাগারে আছেন। তাঁর অফিশিয়াল এক্স অ্যাকাউন্টে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করে দেওয়া এক বার্তায় নির্বাচনে ‘দুই-তৃতীয়াংশ’ আসনে বিজয়ী হওয়ায় সমর্থকদের অভিনন্দন জানান দলটির সাবেক এই প্রধান। কারচুপির অভিযোগ করে এতে বলা হয়, প্রাথমিক গণনার ‘ফরম ৪৫’ অনুযায়ী পিটিআই ১৭০ আসনে জয় পেয়েছে।
অনিয়মের অভিযোগ তদন্ত না হওয়া পর্যন্ত পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলকে স্বীকৃতি না দিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান উভয় দলের কয়েকজন আইনপ্রণেতা।
এদিকে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপের অভিযোগের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে এক বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেছেন, ‘হস্তক্ষেপ ও জালিয়াতির অভিযোগ পুরোপুরি তদন্ত হওয়া উচিত।’
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘আমরা নির্ভরযোগ্য আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের মূল্যায়নের সঙ্গে একমত পোষণ করছি যে এই নির্বাচনে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সংগঠিত হওয়া এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশের ওপর অযাচিত বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে।’
প্রতিনিধি পরিষদের ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির চেয়ারম্যান মাইকেল ম্যাককল বলেন, ‘পাকিস্তানের গণতন্ত্রের সমর্থনে হাউস ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির চেয়ারম্যান, র্যাঙ্কিং সদস্য গ্রেগরি মিকস এবং অন্যান্য বিশিষ্ট আইনপ্রণেতাদের সাম্প্রতিক জোরালো বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বাইডেন প্রশাসন ও কংগ্রেসকে ভোট গণনার অনিয়ম ও কারচুপির মারাত্মক উদ্বেগের প্রতি নজর দেওয়ার আহ্বান জানাই।’
প্রতিনিধি পরিষদের ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির জ্যেষ্ঠ সদস্য ব্র্যাড শেরমান বলেন, ‘পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যমগুলোকে ভোট গণনা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশে স্বাধীন হওয়া উচিত এবং ফলাফল ঘোষণায় কোনো ধরনের অযৌক্তিক বিলম্ব করা উচিত নয়।’
কংগ্রেস সদস্য রাশিদা তালিব বলেছেন, ‘পাকিস্তানের গণতন্ত্র মারাত্মক হুমকিতে থাকায় আমাদের অবশ্যই দেশটির জনগণের পাশে দাঁড়ানো উচিত। নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ এবং কারচুপি ছাড়াই তাঁদের নিজেদের নেতৃত্ব নির্বাচন করতে পারা উচিত। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে দুর্বল করে, এমন কারও কাছে আমাদের করের অর্থ যাতে না যায়, যুক্তরাষ্ট্রের অবশ্যই তা নিশ্চিত করতে হবে।’
কর্মকর্তাদের আইনের শাসন মেনে চলার আহ্বান জানিয়ে কংগ্রেস সদস্য ডিনা টিটাস বলেছেন, তিনি মাঠের পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। পাকিস্তানে রাজনৈতিক সহিংসতা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বিধিনিষেধের নিন্দা জানিয়ে টিটাস বলেন, ‘অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন একটি কার্যকর গণতন্ত্রের ভিত্তি।’
কংগ্রেস সদস্য ইলহান ওমর নির্বাচনে অসদাচরণের অসংখ্য অভিযোগের বিষয়টি উল্লেখ করেন। এসব অভিযোগের ‘বিশ্বাসযোগ্য ও স্বাধীন তদন্ত না হওয়া পর্যন্ত ফলাফল স্বীকৃতি দেওয়া থেকে বিরত থাকতে’ তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতি আহ্বান জানান।
ইলহান ওমর আরও বলেন, ‘পাকিস্তানের নির্বাচনে হস্তক্ষেপের খবরে আমি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। যেকোনো নতুন সরকারের বৈধতা নির্ভর করে কারচুপি, ভয়ভীতি বা জালিয়াতিমুক্ত সুষ্ঠু নির্বাচনের ওপর। পাকিস্তানের জনগণ একটি স্বচ্ছ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং সত্যিকারের প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারের চেয়ে কম কিছু পেতে পারে না।’
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে (সাবেক টুইটার) দেওয়া এক পোস্টে কংগ্রেস সদস্য গ্রেগ ক্যাসার বলেন, ‘আমি পাকিস্তানে নির্বাচনী হস্তক্ষেপ ও জালিয়াতির তদন্তে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আহ্বান প্রতিধ্বনিত করছি। নির্বাচনের ফলাফলকে স্বীকৃতি দেওয়ার আগে একটি বিশ্বাসযোগ্য ও স্বাধীন তদন্ত সম্পন্নের বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের নিশ্চিত করা উচিত।’
এদিকে ইমরান খানসহ পিটিআইয়ের ‘রাজবন্দীদের’ মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন দলটির বর্তমান প্রধান গহর আলী খান। নির্বাচনের পর ‘বিভক্তি কমিয়ে আনা’ নিয়ে সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনিরের বক্তব্যের জবাবে গতকাল তিনি এ আহ্বান জানান।