গত শুক্রবার রাতের ঘটনা। লাহোরে দলের সদর দপ্তরের বারান্দায় এলেন নওয়াজ শরিফ। পাকিস্তানের তিনবারের এই প্রধানমন্ত্রী বারান্দায় পা ফেলার সঙ্গে সঙ্গে আতশবাজি ফোটানো শুরু হলো। তাঁকে স্বাগত জানাতে সেখানে সেদিন সমবেত হয়েছিলেন প্রায় দেড় হাজার মানুষ।
নওয়াজ কথা শুরু করেন সাম্প্রতিক সময়ে জনসমাবেশে তাঁর বক্তৃতার পরিচিত ধরনে। শুরুতেই পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজের (পিএমএল-এন) সমর্থকদের উদ্দেশে দলটির সুপ্রিমো বলেন, ‘তোমরা কি আমাকে ভালোবাসো?’ তখন সমস্বরে জবাব এল, ‘আমরা আপনাকে ভালোবাসি।’
গত বৃহস্পতিবার জাতীয় নির্বাচন হয়েছে পাকিস্তানে। নওয়াজের প্রতি তাঁর সমর্থকদের এমন অকুণ্ঠ সমর্থনের সঙ্গে ২৪ কোটি মানুষের দেশ পাকিস্তান যে একাত্ম বোধ করে, নির্বাচনে তাঁর প্রমাণ মিলেছে সামান্যই। ভোটারদের ভোট দেওয়ার ধরন নির্বাচনী বিশ্লেষকদেরও অবাক করেছে।
জাতীয় নির্বাচনের এক মাস আগেও বিশেষজ্ঞরা বলছিলেন, নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়েই পিএমএল-এন ক্ষমতায় আসছে। এতে চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ পাবেন ৭৪ বছর বয়সী বর্ষীয়ান রাজনীতিক নওয়াজ। এর বড় কারণ, একসময় পাকিস্তানে ক্ষমতাধর সেনাবাহিনীর চক্ষুশূলে পরিণত হওয়া নওয়াজ এবারের নির্বাচনে ছিলেন জেনারেলদের ‘আশীর্বাদপুষ্ট’।
নওয়াজ ও তাঁর দলও জয়ের ব্যাপারে এতটাই আত্মবিশ্বাসী ছিল যে ভোট গ্রহণ শেষ হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই গত বৃহস্পতিবার রাতে আগে থেকে প্রস্তুত করে রাখা ‘বিজয় ভাষণ’ দিয়ে দেন তিনি। এরপর ভোটের ফল আসতে থাকলে ‘পাশার দান’ উল্টে যেতে থাকে।
নির্বাচনবিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মাজিদ নিজামি বলছেন, ‘ভোটের ফলাফলে দলগুলোর অবস্থান স্পষ্ট হতে থাকলে তা পিএমএল-এনকে বিস্মিত ও হতভম্ব করে। পিএমএল-এন যে ফল প্রত্যাশা করেছিল, তা পায়নি।’
নওয়াজের পিএমএল-এনের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত প্রায় অর্ধেক আসনে জয়ী হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা, যাঁরা সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) সমর্থন নিয়ে নির্বাচনে লড়েছেন। জাতীয় পরিষদে ৭৫ আসন পাওয়া পিএমএল-এন পিটিআইয়ের স্বতন্ত্রদের চেয়ে ২০ আসন পিছিয়ে আছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাম্প্রতিক কয়েক মাসে পিটিআইকে ব্যাপক রাজনৈতিক ও আইনি হেনস্তার মুখে পড়তে হয়। জ্যেষ্ঠ নেতারা গ্রেপ্তার হন। অনেকে দৃশ্যত দল ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। এমনকি দলীয় প্রতীক ‘ক্রিকেট ব্যাট’ও ব্যবহার করতে পারেনি পিটিআই। প্রার্থীরা লড়েছেন স্বতন্ত্র হয়ে।
তবে পিটিআই একমাত্র দল নয়, যারা এমন দমন–পীড়নের মুখোমুখি হয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক সালমান গনি বলেন, এই দমন–পীড়নের পেছনে সামরিক বাহিনী ও পিএমএল-এন ছিল বলে মনে করেন সাধারণ পাকিস্তানিরা। এই দুই পক্ষই ইমরান খানের জনপ্রিয়তাকে খাটো করে দেখে ভুল করেছিল।
সালমান গনি বলেন, ‘যখন একজন ব্যক্তি নিপীড়িত হন, তখন তাঁর জনপ্রিয়তা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। আমরা নওয়াজের ক্ষেত্রেও বিষয়টি দেখেছি। যখন কারও দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায়, তখন সে পাল্টা জবাব দিতে মরিয়া চেষ্টা চালায়। পিএমএল-এন তা বুঝতে পারেনি।’
এ বিষয়ে একমত রাজনৈতিক বিশ্লেষক বদর আলমও। তিনি বলেন, ‘এমনকি একবারের জন্যও পিটিআইয়ের ওপর সহিংসতা ও নিপীড়নের নিন্দা করেনি পিএমএল-এন। প্রকৃতপক্ষে পিটিআইকে সম্পূর্ণভাবে বশে আনার ভূমিকা নিয়েছিল তারা। এটি পিএমএল-এনকে নিপীড়কের কাতারে দাঁড় করিয়েছে। এতে তাদের প্রতি জনগণ ক্ষুব্ধ হয়েছিল।’