জাতীয় নির্বাচন-পরবর্তী রাজনৈতিক অচলাবস্থা কাটিয়ে পাকিস্তানের ২৪তম প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজের (পিএমএল-এন) প্রেসিডেন্ট শাহবাজ শরিফ। রোববার প্রধানমন্ত্রী পদে তাঁকে সমর্থন দিয়েছেন দেশটির পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ জাতীয় পরিষদের বেশির ভাগ সদস্য। প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর শাহবাজের ভাষ্য, পাকিস্তানকে স্বয়ংসম্পূর্ণ হিসেবে গড়তে চায় তাঁর সরকার।
প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনে রোববার জাতীয় পরিষদে ভোটাভুটি হয়। এতে শাহবাজ শরিফের পক্ষে ভোট দেন ২০১ আইনপ্রণেতা। প্রধানমন্ত্রী পদে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন কারাবন্দী ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) নেতা ওমর আইয়ুব খান। তিনি পেয়েছেন ৯২ ভোট। প্রধানমন্ত্রী পদে নির্বাচিত হতে জাতীয় পরিষদের ৩৩৬ সদস্যের মধ্যে অন্তত ১৬৯ জনের সমর্থন প্রয়োজন হয়।
গত ৮ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে জাতীয় পরিষদে সরাসরি ভোট হওয়া ২৬৪ আসনের মধ্যে ৯০টি আসন পান পিটিআই-সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। পিএমএল-এন পায় ৭৯টি। পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) দখলে যায় ৫৪টি আসন। এককভাবে সরকার গঠনের জন্য নির্বাচনে কোনো দলই প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। শেষ পর্যন্ত জোট করে সরকার গঠনের পথই খোলা থাকে।
প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনে শাহবাজ শরিফের জয় একপ্রকার নিশ্চিতই ছিল। সাংবিধানিক ক্ষমতা ভাগাভাগির শর্তে আগে থেকেই তাঁর প্রতি সমর্থন ছিল পিপিপি, মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট-পাকিস্তানসহ (এমকিউএম-পি) সাতটি দলের। তারাই গতকাল ভোট দিয়ে শাহবাজকে জিতিয়েছে। অপর দিকে ভোটাভুটিতে পিটিআই-সমর্থিত প্রার্থীদের সঙ্গে ছিল সুন্নি ইত্তেহাদ কাউন্সিল (এসআইসি)। জাতীয় পরিষদে সংরক্ষিত আসন পেতে দলটিতে যোগ দিয়েছিলেন তাঁরা।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শাহবাজ শরিফের নির্বাচিত হওয়া পাকিস্তানের রাজনীতিতে একটি ইতিহাস। কারণ, এর আগে দেশটিতে পরপর দুই মেয়াদে কোনো রাজনীতিক প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হননি। এর আগে ২০২২ সালের এপ্রিলে পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটে ইমরান খানের পিটিআইয়ের পতনের পর তাঁর নেতৃত্বেই নতুন সরকার গঠিত হয়েছিল।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর রোববার জাতীয় পরিষদে ভাষণ দেন শাহবাজ শরিফ। প্রথমেই তাঁকে নির্বাচিত করার জন্য পিপিপি ও এমকিউএম-পিসহ মিত্রদলগুলোকে ধন্যবাদ জানান তিনি। এরপর পাকিস্তানের চলমান নানা সংকট এবং সেগুলোর সম্ভাব্য সমাধানের কথা তুলে ধরেন। শোনান নানা আশাবাদের কথাও।
পিএমএল-এন প্রেসিডেন্ট শাহবাজ বলেন, পাকিস্তানে বিদেশি ঋণের সংকট ভয়াবহ পরিস্থিতি ধারণ করেছে। হয় এই ঋণ থেকে পাকিস্তানকে বের হতে হবে, না হয় লজ্জায় মাথা নত করে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। তবে তা হতে দেওয়া যাবে না। পাকিস্তান ঘুরে দাঁড়াবে। এই সরকার পাকিস্তানকে স্বয়ংসম্পূর্ণ হিসেবে গড়ে তুলবে।
এ সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন পিএমএল-এন প্রতিষ্ঠাতা ও শাহবাজের বড় ভাই নওয়াজ শরিফ। তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয়, আগামী দেড় থেকে দুই বছর পাকিস্তানের সময়টা কঠিন হবে। তবে আমাদের একজোট থাকতে হবে এবং প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা করতে হবে। দেড় থেকে দুই বছরের মধ্যে পাকিস্তান সংকট থেকে বেরিয়ে আসবে।’
জাতীয় পরিষদে রোববার অধিবেশন শুরুর পরপরই এসআইসি সদস্যরা ‘আজাদি’ (স্বাধীনতা) ও ‘কয়েদি ৮০৪’ বলে স্লোগান দিতে থাকেন। এ সময় ‘নওয়াজ দীর্ঘজীবী হোক’ বলে পাল্টা স্লোগান দেন পিএমএল-এন সদস্যরা। এমন পরিস্থিতিতে সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানান স্পিকার।
‘আজাদি’ ও ‘কয়েদি ৮০৪’ স্লোগানের মাধ্যমে মূলত ইমরান খানের মুক্তির দাবি জানানো হয়েছে। একাধিক মামলায় সাজা পেয়ে বর্তমানে তিনি রাওয়ালপিন্ডির আদিয়ালা কারাগারে বন্দী। তাঁর কয়েদি নম্বর ৮০৪। ২০২২ সালে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকেই ইমরানসহ পিটিআই নেতা-কর্মীদের ওপর দমন-পীড়ন চলছে। নিজস্ব প্রতীক না পেয়ে এবারের নির্বাচনে স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচনী লড়াইয়ে নামতে হয়েছে দলটির নেতাদের।
এদিকে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের ভোট গ্রহণের সময় অধিবেশনকক্ষ থেকে বের হয়ে যান জমিয়ত উলেমা-ই-ইসলাম-ফজল (জেইউআই-এফ) সদস্যরা। প্রধানমন্ত্রী, প্রেসিডেন্টসহ অন্যান্য সাংবিধানিক পদে ভোট না দেওয়ার ঘোষণা আগেই দিয়েছিল দলটি। প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনে ভোট দেননি বেলুচিস্তান ন্যাশনাল পার্টির সদস্য সরদার আখতার মেঙ্গালও।
রোববার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন শেষে জাতীয় পরিষদে পিটিআই নেতা ওমর আইয়ুব খান বলেন, নতুন প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ কারচুপির মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। এদিকে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের পর পার্লামেন্ট ভবনের বাইরে সাংবাদিকদের পিটিআইয়ের চেয়ারম্যান গহর আলী খান বলেন, নির্বাচনে কারচুপির প্রতিবাদে পিটিআইয়ের বিক্ষোভ চলবে। তবে তাঁরা জাতীয় পরিষদের কার্যক্রম বর্জন করবেন না। সেখান থেকেও তাঁরা সরকারকে মোকাবিলা করবেন।