পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান
পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান

ইমরান খানের বিচার কি সামরিক আদালতেই হবে

পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান গত বছরের আগস্ট থেকে কারাগারে বন্দী। সামরিক আদালতে তাঁর বিচার করা হতে পারে, সম্প্রতি এমন ইঙ্গিত দিয়েছে দেশটির সামরিক বাহিনী ও বেসামরিক সরকার।

পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে, যেগুলো ইঙ্গিত দিচ্ছে যে তাঁর বিচার সামরিক আদালতে হবে। তবে কী প্রমাণ, সে সম্পর্কে বিস্তারিত বলেননি তিনি।

খাজা আসিফ এ কথা বলেছিলেন পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর প্রেস উইংয়ের প্রধান জেনারেল আহমেদ শরিফ চৌধুরীর এক সংবাদ সম্মেলনের পর। ৫ সেপ্টেম্বরের ওই সংবাদ সম্মেলনে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য সেনাসদস্যদের সঙ্গে যেসব বেসামরিক লোকজন ষড়যন্ত্র করবেন, তাঁদের আইনের আওতায় আনা হবে।

গত বছরের ৯ মে একটি দুর্নীতি মামলায় গ্রেপ্তার হন ইমরান খান। এর প্রতিবাদে সেদিন বিক্ষোভ করেন তাঁর দল পাকিস্তান তেহরিক–ই–ইনসাফের (পিটিআই) নেতা–কর্মীরা। হামলা চালানো হয় অনেক সামরিক স্থাপনায়। এ ঘটনার জেরে হাজারো মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের মধ্যে সামরিক আদালতে বিচার হয় প্রায় ১০০ জনের। ওই বিক্ষোভে জড়িত থাকার অভিযোগে ইমরানেরও সামরিক আদালতে বিচার হতে পারে বলে জল্পনা রয়েছে।

পাকিস্তানের সরকার বলছে, দেশটির সংবিধানে বেসামরিক নাগরিকদের সামরিক আদালতে বিচারের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

ইমরানের বিরুদ্ধে কি সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হবে

পাকিস্তানের সামরিক আইন অনুযায়ী, ব্যতিক্রম পরিস্থিতিতে বেসামরিক লোকজনকে সামরিক আদালতে নিয়ে বিচার করা যেতে পারে। এই আইনে ইমরান খানেরও বিচার হতে পারে কি না, এমন প্রশ্ন ঘিরে আইনি বিতর্ক দেখা দিয়েছে। যদিও জেনারেল আহমেদ শরিফ চৌধুরী যে বক্তব্য দিয়েছিলেন, তাতে সুনির্দিষ্টভাবে ইমরানের নাম উল্লেখ করেননি।

৯ মের সহিংসতার জন্য সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে ইমরান খান আঁতাত করেছিলেন, এমন অভিযোগ এখনো আনেনি পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী। তবে সম্প্রতি পাকিস্তানের সাবেক গোয়েন্দাপ্রধান ফাইজ হামিদ ও তাঁর তিন সহযোগীর বিরুদ্ধে সামরিক আদালতে বিচার শুরু হয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে নেওয়া আইনি পদক্ষেপের সঙ্গে ইমরানকে জড়ানো হতে পারে কি না, তা নিয়ে জল্পনা চলছে।

পাকিস্তানে সামরিক আদালতে বেসামরিক নাগরিকদের বিচারের ইতিহাস রয়েছে। তবে কোনো সাবেক প্রধানমন্ত্রীর এ আদালতে বিচার করা হয়নি।

২০২৩ সালে গ্রেপ্তারের পর তিনটি মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন ইমরান খান। রাষ্ট্রীয় উপহার তছরুপের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা থাকায় তিনি এখন রাওয়ালপিন্ডির আদিয়ালা কারাগারে বন্দী। আদালতের আদেশে তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করে দেওয়া তিনটি রায়ই হয় বাতিল, না হয় স্থগিত করা হয়েছে। তবে ৯ মে সহিংসতার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।

বেসামরিক কারও কি সামরিক আদালতে বিচার করা যায়

পাকিস্তানের সরকার বলছে, দেশটির সংবিধানে বেসামরিক নাগরিকদের সামরিক আদালতে বিচারের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। বলা চলে, ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ইমরান খান প্রধানমন্ত্রী থাকার সময়ের কথা–ই। তখন বেশ কয়েকজন বেসামরিক ব্যক্তির বিচার সামরিক আইনে করা হয়েছিল। যদিও ৯ মে সহিংসতার জেরে সামরিক আদালতে বেসামরিক ব্যক্তিদের বিচারের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেছে ইমরান খানের দল পিটিআই।

এ বিষয়ে আইনজীবী রিদা হোসেইন বলেন, ২০২৩ সালে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের একটি বেঞ্চ একটি রায় দেন। তাতে সামরিক আদালতে বেসামরিক লোকজনের বিচারকে অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। ওই রায়ের বিরুদ্ধে পরে আপিল করেছিল সরকার। ফলে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে রায়টি স্থগিত করা হয়। যেহেতু রায়টি এখন স্থগিত, তাই সামরিক আদালতে বেসামরিক লোকজনের বিচারে কোনো বাধা নেই।

ইমরানকে কি সামরিক বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হবে

ইসলামাবাদভিত্তিক আইনজীবী সালার খানের মতে, ইমরান খানের বিরুদ্ধে কোনো মামলার বিচার সামরিক আদালতে হবে কি না, তা পরিষ্কার নয়। আইনে সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে বেসামরিক কোনো ব্যক্তিকে সামরিক বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

তবে এটা স্বয়ংক্রিয় কোনো প্রক্রিয়া নয় বলে উল্লেখ করেছেন আইনজীবী রিদা হোসেইন। তাঁর ভাষ্যমতে, বেসামরিক কোনো ব্যক্তিকে নিজেদের হেফাজতে নিতে পারে না সেনা কর্তৃপক্ষ। ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে অবশ্যই প্রথমে বেসামরিক আদালতে সঙ্গত কোনো অভিযোগ আনতে হবে। তাঁকে সামরিক কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেওয়ার আগে একজন বিচারককে এর পক্ষে যুক্তিযুক্ত মতামত দিতে হবে।

সামরিক আদালতে বেসামরিক নাগরিকদের কী কী অধিকার আছে

পাকিস্তানে সামরিক আদালতের বিচার অনুষ্ঠানিকভাবে ‘ফিল্ড জেনারেল কোর্ট মার্শাল’ (এফজিসিএম) নামে পরিচিত। সামরিক বাহিনীর আইনসংক্রান্ত অধিদপ্তরের শাখা জজ অ্যাডভোকেট জেনারেলের (জেএজি) অধীনে এই বিচার হয়। এই আদালতের প্রেসিডেন্ট ও কৌঁসুলি হিসেবে সামরিক কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করেন।

সামরিক আদালতের বিচারকাজ চলে গোপনে। আদালতের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা থাকে সীমিত। বিচারের সময় বেসামরিক কেউ উপস্থিত থাকেন না। তবে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের আইনজীবী নিয়োগের অধিকার দেওয়া হয়। কারও যদি আইনজীবী নিয়োগের সক্ষমতা না থাকে, তাহলে নিজের পক্ষে কোনো সামরিক কর্মকর্তাকে আইনজীবী হিসেবে নিয়োগের অনুরোধ করতে পারেন তিনি।

সামরিক আদালতে কেউ যদি দোষী সাব্যস্ত হন, তাহলে তিনি সামরিক আদালতের আপিল বিভাগে ৪০ দিনের মধ্যে ওই রায়ের বিরুদ্ধে আবেদন করতে পারেন। আপিল বিভাগের রায়েও সন্তুষ্ট না হলে বেসামরিক উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হওয়া যাবে।

পাকিস্তানে সাবেক কোনো প্রধানমন্ত্রীর কি সামরিক আদালতে বিচার হয়েছে

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠান পর গত ৭৭ বছরের ইতিহাসে কোনো প্রধানমন্ত্রীই পাঁচ বছরের মেয়াদ পূরণ করতে পারেননি। তাঁদের অনেকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা হয়েছে। অনেকে দোষী সাব্যস্ত হয়ে কারাগারেও গিয়েছেন। পাকিস্তানে সামরিক আদালতে বেসামরিক নাগরিকদের বিচারের ইতিহাস রয়েছে। তবে কোনো সাবেক প্রধানমন্ত্রীর এ আদালতে বিচার করা হয়নি।

ইমরান খানের বিচার সামরিক আদালত পর্যন্ত গড়াবে না বলে মনে করেন সাবেক সামরিক কর্মকর্তা ও আইনজীবী ইনাম–উল–রাহিম। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি না, ইমরান খানের মামলা সামরিক আদালত পর্যন্ত নিয়ে যাবে সরকার।’ এ ধারণার পক্ষে যুক্তি হিসেবে তিনি বলেন, ইমরান খান একজন রাজনৈতিক নেতা হওয়ায় সামরিক আদালতে তাঁর বিচারে প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেনাবাহিনীর সুনাম ক্ষুণ্ন হতে পারে।