জেনারেল আসিম মুনিরের নিয়োগ ভারতসহ বিশ্বের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ

লেফটেন্যান্ট জেনারেল আসিম মুনির
ছবি: রয়টার্স

মাত্র আর কয়েক দিন বাকি। ২৯ নভেম্বর অবসরে যাচ্ছেন পাকিস্তানের বর্তমান সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া। সব ঠিক থাকলে এরপর দেশটির প্রভাবশালী সেনাবাহিনীর হাল ধরতে যাচ্ছেন জেনারেল আসিম মুনির।

সেনাপ্রধান হিসেবে আসিম মুনিরের এ নিয়োগকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। বর্তমানে পাকিস্তানের রাজনীতি চরম অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে এ পরিস্থিতিতে বদল আনতে বড় ভূমিকা রাখতে পারেন নতুন সেনাপ্রধান। কারণ, পাকিস্তানের রাজনীতিতে সব সময়ই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রভাব রয়েছে সেনাবাহিনীর।

পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতিতেও দেখা যায় দেশটির সেনাবাহিনীর ছায়া। তাই চিরবৈরী প্রতিবেশী ভারতসহ অন্যান্য দেশের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক ভবিষ্যতে কোন দিকে গড়াবে, তা-ও ঠিক করে দিতে পারেন নতুন সেনাপ্রধান আসিম মুনির।

পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর ভূমিকা

১৯৪৭ সালে ভারত উপমহাদেশ ভাগের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের সৃষ্টি। এরপর ৭৫ বছর পেরিয়েছে। এ সময়ের মধ্যে দেশটিতে তিনবার ক্ষমতা দখল করেছে সেনাবাহিনী। তিন দশকের বেশি সময় সরাসরি পাকিস্তান শাসন করেছেন সেনাশাসকেরা। ভারতের সঙ্গেও তিনবার যুদ্ধে জড়িয়েছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী।

পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলে পারমাণবিক শক্তিধর ভারতের সঙ্গে দেশটির সীমান্ত রয়েছে। এ সীমান্তে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ানোর ঝুঁকি এড়াতে বড় ভূমিকা পালন করতে পারেন পাকিস্তানের এই সেনাপ্রধান। এদিকে দেশটির পশ্চিমে সীমান্ত রয়েছে আফগানিস্তানের সঙ্গে। ভবিষ্যতে এ সীমান্তে অস্থিতিশীলতা ও সংঘাত ঠেকাতেও তিনি কাজ করতে পারেন।

এমনকি পাকিস্তানে যখন বেসামরিক সরকার ক্ষমতায় ছিল, তখনো রাজনৈতিক নেতাদের ওপর ছড়ি ঘুরিয়েছেন সেনা কর্মকর্তারা। আর দেশটির নিরাপত্তাসংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় ও পররাষ্ট্রনীতিতে বরাবরই নাক গলিয়ে আসছেন পাকিস্তানি জেনারেলরা।

কে এই আসিম মুনির

পাকিস্তানশাসিত কাশ্মীরের মাংলায় অবস্থিত অফিসার্স ট্রেনিং স্কুলের মাধ্যমে সেনাবাহিনীতে পা রাখেন আসিম মুনির। তাঁর স্থান হয় সেনাবাহিনীর ছয়টি পদাতিক রেজিমেন্টের একটি ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্টে। এরপর তিনি সেনাবাহিনীর হয়ে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছেন।

সেনাবাহিনীর হয়ে আসিম মুনির কাজ করেছেন আজাদ কাশ্মীরে। সৌদি আরবেও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন একটা সময়। ২০১৭ সালে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা শাখা মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের (এমআই) প্রধান হন তিনি। ২০১৮ সালে প্রভাবশালী গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্সের (আইএসআই) প্রধান হন।

তবে আইএসআই প্রধান হিসেবে আসিম মুনিরের মেয়াদ ছিল সবচেয়ে কম সময়ের। মাত্র আট মাসের মাথায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের জোরাজুরিতে তাঁকে এ পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। আইএসআইয়ের নতুন প্রধান হন লেফটেন্যান্ট জেনারেল ফাইজ হামিদ।

আইএসআইয়ের প্রধানের পদ থেকে সরে যাওয়ার পর আসিম মুনিরকে গুজরানওয়ালা কোরের কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এ পদে তিনি দুই বছর ছিলেন। সর্বশেষ রাওয়ালপিন্ডিতে সেনাবাহিনীর প্রধান কার্যালয়ে কোয়ার্টার মাস্টার জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গুরুত্ব কতটা

পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলে পারমাণবিক শক্তিধর ভারতের সঙ্গে দেশটির সীমান্ত রয়েছে। এ সীমান্তে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ানোর ঝুঁকি এড়াতে বড় ভূমিকা রাখতে পারেন পাকিস্তানের নতুন সেনাপ্রধান। এদিকে দেশটির পশ্চিমের সীমান্ত আফগানিস্তানের সঙ্গে। ভবিষ্যতে এ সীমান্তে অস্থিতিশীলতা ও সংঘাত ঠেকাতেও আসিম মুনির কাজ করতে পারেন।

বাজওয়া সেনাপ্রধান থাকাকালে ২০১৯ সালে সংঘর্ষে জড়িয়েছিল ভারত ও পাকিস্তানের বিমানবাহিনী। তবে দুই দেশের সম্পর্ক ঠিক রাখতে তাঁর ভূমিকা রয়েছে। চলতি বছরই ভারতের একটি ক্ষেপণাস্ত্র পাকিস্তানের ভূখণ্ডে গিয়ে পড়ে। এ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। ওই উত্তেজনা সামাল দিতে সফল হয়েছিলেন বাজওয়া।

এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, চীনসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর। এর একটি কারণ, দেশটির কৌশলগত ভৌগোলিক অবস্থান। আরেকটি কারণ, পাকিস্তানের সমুদ্র উপকূলের কাছ দিয়ে তেলসমৃদ্ধ উপসাগরীয় দেশগুলোর জাহাজের চলাচল।

এদিকে পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্রের নিরাপত্তা নিয়ে বাইরের দেশগুলোতে প্রশ্ন আছে। কারণ, ভারত ও পশ্চিমাবিদ্বেষী বিভিন্ন সশস্ত্র সংগঠনের তৎপরতা রয়েছে পাকিস্তানে। এমনকি পশতুন ও বালুচ অঞ্চলে জাতিগত বিদ্রোহের কারণেও দেশটির অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংকটের মুখে বলে ধরা হয়। তবে নিজেদের পারমাণবিক অস্ত্রের নিরাপত্তার ঝুঁকির বিষয়টি বরাবর উড়িয়ে দিয়েছে পাকিস্তান সরকার ও সেনাবাহিনী।

পাকিস্তানের ভেতরে কতটা গুরুত্বপূর্ণ

পাকিস্তানের অভ্যন্তরে সেনাবাহিনীকে নিয়ে বড় একটি অভিযোগ রয়েছে। সেটি হলো, নিজেদের ‘আধিপত্য’ বজায় রাখতে দেশটির গণতন্ত্রে দীর্ঘদিন ধরে হস্তক্ষেপ করে আসছে তারা। এযাবৎকালে পাকিস্তানের ৩০ জন প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ১৯ জন জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। তবে তাঁদের কেউই পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি।

পাকিস্তানের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের বিষয়টি বিদায়ী সেনাপ্রধান জেনারেল বাজওয়াও গত সপ্তাহে একটি ভাষণে স্বীকার করেছেন। তবে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে এটাও বলা হয়েছে, তারা আর রাজনীতিতে নাক গলাবে না। নতুন সেনাপ্রধান যদি এ প্রতিশ্রুতি ধরে রাখেন, তাহলে তা দেশটিতে গণতন্ত্রের বিকাশে বড় ভূমিকা রাখবে।

এদিকে গত এপ্রিলে পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটের মুখে পতন হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) প্রধান ইমরান খানের নেতৃত্বাধীন সরকারের। এর পর থেকে দেশজুড়ে নতুন সরকারবিরোধী বিক্ষোভ করে আসছেন ইমরান। তাঁর দাবি, দেশে আগাম নির্বাচন দিতে হবে। এরই মধ্যে এক দফা হামলায় আহত হলেও বেঁচে গেছেন তিনি। এমন পরিস্থিতিতে দেশটি রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে।

একে তো পাকিস্তান চরম অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে; তারপর আবার সাম্প্রতিক বন্যায় ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে দেশটি। এ অবস্থায় পাকিস্তানে রাজনৈতিক উত্তাপ কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন নতুন সেনাপ্রধান আসিম মুনির।

পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া

বিদায়ী সেনাপ্রধান বাজওয়ার ভূমিকা কেমন ছিল

সেনাপ্রধান থাকাকালে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কে একটি ভারসাম্য রাখার চেষ্টা করেছেন জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া। তাঁর সময়ে ইসলামাবাদ ও বেইজিংয়ের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়েছে। তবে বেইজিংয়ের সঙ্গে বৈরী সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ ওয়াশিংটনের সঙ্গেও সম্পর্ক জোরদার করার চেষ্টা করেছেন তিনি। যেমন ২০২১ সালে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের সময় যুক্তরাষ্ট্রের পাশে থেকে কাজ করেছে পাকিস্তান।

পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বিষয়াদি নিয়েও সক্রিয় ছিলেন জেনারেল বাজওয়া। পাকিস্তানে আর্থিক সহায়তা আনতে তিনি চীন ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় সফর করেছেন। এমনকি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ঋণ পেতে ওয়াশিংটনের কাছে তদবির করেছেন।

অর্থনীতিকে সংকট থেকে টেনে তুলতে দেশের অভ্যন্তরেও কাজ করেছেন বাজওয়া। পাকিস্তানের শীর্ষ শিল্পপতিদের নিয়ে সেনাবাহিনীর প্রধান কার্যালয়ে একটি বৈঠক করেছিলেন তিনি। সেখানে তাঁদের বেশি বেশি কর দিতে উৎসাহ দেন সেনাপ্রধান।

বাজওয়া সেনাপ্রধান থাকাকালে ২০১৯ সালে সংঘর্ষে জড়িয়েছে ভারত ও পাকিস্তানের বিমানবাহিনী। তবে দুই দেশের সম্পর্ক ঠিক রাখতেও তাঁর ভূমিকা রয়েছে। চলতি বছরই ভারতের একটি ক্ষেপণাস্ত্র পাকিস্তানের ভূখণ্ডে গিয়ে পড়ে। এ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। ওই উত্তেজনা সামাল দিতে সফল হয়েছিলেন বাজওয়া।

তবে পাকিস্তানের রাজনীতিতে বারবার হস্তক্ষেপের অভিযোগ উঠেছে জেনারেল বাজওয়ার বিরুদ্ধে। ২০১৮ সালে তাঁর সহায়তায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ক্ষমতায় এসেছিলেন বলে অভিযোগ তোলেন অনেক রাজনীতিক। পরে ইমরানই দাবি করেন, তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার পেছনে বাজওয়ার হাত রয়েছে।