১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার পর স্বাধীন পাকিস্তানের বয়স ৭৫ বছর পেরিয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ এ সময়ে পাকিস্তানের কোনো প্রধানমন্ত্রীই পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। বিভিন্ন কারণে নির্ধারিত সময়ের আগেই ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছে তাঁদের। সর্বশেষ গত বছর অনাস্থা ভোটে হেরে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়তে হয় সাবেক কিংবদন্তি ক্রিকেটার থেকে রাজনীতিক বনে যাওয়া ইমরান খানকে। তিনি পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) দলের চেয়ারম্যান। সম্প্রতি সহিংসতার ঘটনায় সরকারের পক্ষ থেকে পিটিআইকে নিষিদ্ধ করার কথা তোলা হয়েছে।
গত মঙ্গলবার ইসলামাবাদ হাইকোর্টে হাজিরা দিতে গেলে আল-কাদির ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় ইমরানকে গ্রেপ্তার করে এনএবি। তাঁকে গ্রেপ্তারের পর বিক্ষোভের ডাক দেন পিটিআইর শীর্ষ নেতারা। এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে ইসলামাবাদ, লাহোর, করাচি, রাওয়ালপিন্ডিসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভে নামেন পিটিআইর সমর্থকেরা। ক্ষুব্ধ সমর্থকেরা লাহোরে শীর্ষ এক সেনা কর্মকর্তার বাসভবনেও আগুন ধরিয়ে দেন। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে গুরুত্বপূর্ণ সরকারি স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর চালান বিক্ষোভকারীরা।
অব্যাহত বিক্ষোভ ও সহিংসতার মধ্যে ইমরান খানকে জামিন দেন পাকিস্তানের আদালত। কিন্তু তাঁকে গ্রেপ্তারের পর দেশজুড়ে যে ভাঙচুর ও সহিংস ঘটনা ঘটেছে, এ জন্য পিটিআইকে দায়ী করেছে ক্ষমতাসীন পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (পিডিএম) ও তাদের ১৩টি রাজনৈতিক দলের জোট। এসব ঘটনায় পিটিআইর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ারও দাবি জানিয়েছেন এসব দলের নেতারা।
শুধু তা-ই নয়, সহিংসতায় জড়িত থাকার অভিযোগে সরকার পিটিআইকে নিষিদ্ধ করার চিন্তাভাবনা করছে বলেও গুজব উঠেছে। যদিও এ নিয়ে ক্ষমতাসীন দলগুলোর মধ্যে দুটি ভাগ হয়ে গেছে।
ইমরানের দল পিটিআইর ভাগ্যে কী ঘটবে, সেটা নিশ্চয়ই ভবিষ্যতে জানা যাবে। তবে সেনাবাহিনী ও ক্ষমতাসীন দলের বিরাগভাজন হওয়ায় পাকিস্তানে পাঁচটি রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এই তালিকায় আওয়ামী লীগের নামও আছে। যেসব দলকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল—
ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতা লাভের কিছুদিন পরই কমিউনিস্ট পার্টি অব পাকিস্তানকে নিষিদ্ধ করা হয়। লিয়াকত আলী খানের নেতৃত্বাধীন সরকারকে উৎখাতের অভিযোগে ১৯৫৪ সালে দলটিকে নিষিদ্ধ করে পাকিস্তান সরকার।
তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের মদদে মেজর জেনারেল আকবর আলী খান সরকার উৎখাতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সেই ঘটনা ‘রাওয়ালপিন্ডি ষড়যন্ত্র’ নামে পরিচিত ছিল। এই ষড়যন্ত্রের কুশীলব জেনারেল আকবর চৌকস ও দক্ষ সেনা কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি কেবল সরকারের কাশ্মীর-নীতিতে ক্ষুব্ধ ছিলেন না, আমেরিকাঘেঁষা নীতিরও প্রচণ্ড বিরোধী ছিলেন।
সরকার হটানোর অভিযোগে কমিউনিস্ট পার্টি অব পাকিস্তানের সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ জহির, কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ, জেনারেল আকবরের স্ত্রী ও কয়েক ডজন সেনা কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বাংলাদেশে অপারেশন সার্চলাইট চালায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী। ঢাকাসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ শহরে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালায় তারা। সরকারকে অসহযোগিতার অভিযোগে পরদিন ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান।
১৯৬৭ সালে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর প্রতিষ্ঠিত ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) ভেঙে যায়। এক পক্ষের নেতৃত্ব দেন আবদুল ওয়ালি খান।
আবদুল ওয়ালি খান ন্যাপের একাংশের দায়িত্ব নেওয়ার পর দুই দফায় দলটিকে নিষিদ্ধ করে পাকিস্তান সরকার। প্রথমবার ১৯৭১ সালে দলটিকে নিষিদ্ধ করে ইয়াহিয়া খানের সরকার। দ্বিতীয় দফায় ১৯৭৫ সালে জুলফিকার আলী ভুট্টোর সরকারও একই পথে হাঁটে।
২০২০ সালের মে মাসে পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল জয় সিন্ধ কওমি মাহাজ-আরিসারকে নিষিদ্ধ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। দলটির বিরুদ্ধে জঙ্গি সংগঠন দ্য সিন্ধুদেশ লিবারেশন আর্মি ও সিন্ধুদেশ রেভল্যুশন আর্মির সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগ আনা হয়। এসব সংগঠন সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে জড়িত, এমন যৌক্তিক প্রমাণ পাওয়ায় এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) কঠোর সমালোচক ছিল জয় সিন্ধ কওমি মাহাজ-আরিসার। বিআরআই হচ্ছে অবকাঠামো উন্নয়ন ও বিনিয়োগের জন্য চীন সরকারের বৈশ্বিক উন্নয়নকৌশল।
২০২১ সালের ১৫ এপ্রিল তেহরিক-ই-লাব্বাইক পাকিস্তানকে (টিএলপি) নিষিদ্ধ করে পাঞ্জাব সরকার। সহিংস বিক্ষোভের মাধ্যমে পুলিশ সদস্যদের হত্যার অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
পাঞ্জাব সরকারের এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ২০২১ সালের ২৯ এপ্রিল আদালতে রিভিউ পিটিশন করে টিএলপি। তবে রাজ্য সরকার নিষিদ্ধ করলেও পাকিস্তানের নির্বাচন টিএলপির নিবন্ধন বাতিল করেনি। তাই নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ পায় দলটি।
দলটি ২০২১ সালের অক্টোবরে আবার বিক্ষোভের ডাক দেয়। পরে একই বছরের ৭ নভেম্বর দলটির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে সম্মত হয় সরকার। ১৮ নভেম্বর দলটির প্রধান সাদ রিজভীকে মুক্তি দেওয়া হয়।