রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের সব আভাস ভুল প্রমাণ করে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনের ফলাফলে এগিয়ে আছে ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক–ই–ইনসাফের (পিটিআই) সমর্থিত প্রার্থীরা। গত বৃহস্পতিবার পাকিস্তানের স্থানীয় সময় বিকেল ৫টায় ভোট গ্রহণ শেষ হওয়ার পর ৪২ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণা করা হয়নি।
তবে চূড়ান্ত ফল ঘোষণার আগেই পিএমএল-এন প্রধান নওয়াজ শরিফ বিজয় ভাষণ দিয়ে দিয়েছেন। ওই ভাষণে তিনি জোট সরকার গঠনের ইঙ্গিত দেন। তবে পিটিআই–সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা কী করবেন বা তাঁদের অবস্থান কোথায়, তা এখনো জানা যায়নি।
২৬৫ আসনের মধ্যে নির্বাচন কমিশন ঘোষিত ২৫১ আসনের প্রাথমিক ফলাফলে ইমরানের দল পিটিআই-সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরাই সবচেয়ে বেশি আসনে জয়ী হয়েছেন। আসনসংখ্যায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের দল পিএমএল–এন। তৃতীয় স্থানে বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারির পিপিপি।
তবে নির্বাচনী সাফল্যের পরও পিটিআই এখনো সুবিধাজনক অবস্থানে নেই। কারণ, এবারের নির্বাচনে তারা ব্যাট প্রতীক ব্যবহারের অনুমতি পায়নি। তাদের শীর্ষ নেতা ইমরান খান একের পর এক মামলায় কারাগারে আছেন। এর মানে হলো প্রার্থীরা যদি সর্বোচ্চসংখ্যক আসনে জয়ীও হন, তবুও দলটি হয়তো সরকার গঠন করতে পারবে না। কারণ, সংখ্যালঘুদের জন্য নির্ধারিত আসনে তাদের জন্য কোটা বরাদ্দ থাকবে না। তাহলে পিটিআইয়ের সামনে এখন কোন পথ খোলা আছে? এ নিয়ে কয়েকজন বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হয়েছিল ডন। তার ভিত্তিতে কিছু প্রশ্নের জবাব খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে।
সাংবাদিক উসাতুল্লাহ খান বলেন, জেনারেল জিয়াউল হকের সময়ে এর চেয়ে বেশি স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছেন। তখন গোটা পার্লামেন্টই স্বতন্ত্রদের দখলে ছিল।
উসাতুল্লাহ খান বিষয়টি আরেকটু ব্যাখ্যা করে বলেন, ১৯৮৫ সালে দলভিত্তিক নির্বাচন হয়নি। কোনো দলকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের অনুমতি দেওয়া হয়নি। তখন সবাই ব্যক্তিগত সক্ষমতা অনুযায়ী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। যদিও পেছন থেকে তাঁরা সবাই কারও না কারও সমর্থনপুষ্ট ছিলেন, তবে কাগজে–কলমে তাঁদের পরিচয় ছিল স্বতন্ত্র। নির্বাচিত প্রার্থীরা পার্লামেন্টে যাওয়ার পর ঐক্যবদ্ধ হয়ে নিজেদের দলের নাম দেন পাকিস্তান মুসলিম লিগ, যার থেকে বর্তমান পিএমএল-এন এবং পিএমএল-কিউয়ের সৃষ্টি।
সাংবাদিক উসাতুল্লাহ খান মনে করেন, ইমরানপন্থী স্বতন্ত্ররা যদি এমন সিদ্ধান্ত নেন, তবে তা তাঁদের জন্য ভালো ফল বয়ে আনবে না।
‘তাঁরা এমনটা আগেও করেছেন এবং আপনারা দেখেছেন, তাঁদের সঙ্গে কী হয়েছে। গতবার তাঁরা যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন, তাতে আমার মনে হয় না, এবার তাঁরা আবারও ঝুঁকি নেওয়ার চেষ্টা করবেন’, বলেন উসাতুল্লাহ।
তাঁর ধারণা, স্বতন্ত্র প্রার্থীরা মিলে একটি দল গঠনের চেষ্টা করবেন। এর নাম হতে পারে ইনসাফ বা অন্য কোনো কিছু।
আইনজীবী আবদুল মইজ জাফেরি বলেন, নির্বাচনে পিটিআই তাদের প্রতীক ব্যবহারের অনুমতি পায়নি, কিন্তু দলটিকে তো আর নির্বাচনের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়নি। পিটিআই একটি বৈধ রাজনৈতিক দল। এ ক্ষেত্রে পিটিআই–সমর্থিত প্রার্থী সালমান আকরাম রাজার প্রসঙ্গ টেনে আনেন তিনি। নিজেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে বিবেচনা না করে পিটিআই দলের প্রার্থী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানিয়েছেন রাজা। আবেদনে রাজা আরও যুক্তি দেখিয়েছেন, পিটিআইকে দলীয় প্রতীক ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া না হলেও দলটির অস্তিত্ব ও কর্মকাণ্ডের ওপর এর কোনো প্রভাব পড়েনি। দলটি বিলুপ্ত হয়ে যায়নি।
সাংবাদিক জারার খুহরো বলেন, ‘বিপুলসংখ্যক মানুষ তাদের সঙ্গে জোট করার ব্যাপারে আগ্রহী হবে। সব স্বতন্ত্র, আমার ধারণা আমরা পিটিআই–সংশ্লিষ্ট স্বতন্ত্রদের নিয়ে কথা বলছি—তা করবেন কি না, তা নিয়ে ঢালাওভাবে বলতে আমি সংকোচ বোধ করছি।’
তবে জারার খুহরো মনে করেন, অঞ্চলভেদে পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারে। খাইবার পাখতুনখাওয়ায় পিটিআইয়ের দলত্যাগী নেতাদের জনগণ ভালো চোখে দেখবেন না। তবে দক্ষিণ পাঞ্জাবের ক্ষেত্রে আবার ভিন্ন চিত্র দেখা যেতে পারে। সেখানে পিএমএল-এন অনেক স্বতন্ত্রকে দলে ভেরাতে সমর্থ হতে পারে।
সাংবাদিক শাহজেব জিলানি বলেন, নির্বাচিত হওয়ার পর প্রার্থীরা স্বতন্ত্রভাবে কোনো দলকে সমর্থন করবেন, নাকি ঐক্যবদ্ধ হয়ে কোনো দলে যোগ দেবেন, সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য তাঁরা তিন দিন সময় পাবেন।
শাহজেব জিলানি বলেন, পিটিআই–সমর্থিত স্বতন্ত্ররা যদি পার্লামেন্টের সংখ্যাগরিষ্ঠ পক্ষ হতে চান, তবে তাঁদের বিদ্যমান কোনো রাজনৈতিক দলে যোগ দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে মজলিশ ওয়াহদাত-ই-মুসলিমিনের (এমডব্লিউএম) নাম শোনা যাচ্ছে, যেটি একটি নিবন্ধিত দল। এর আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে এই দুই দল জোট গঠন করেছিল। পিটিআই–সমর্থিত স্বতন্ত্ররা যদি দলটিতে যোগ দেন, তবে তাঁরা সংরক্ষিত আসনগুলোও পাবেন এবং তাঁদের সংখ্যা আরও বেড়ে যাবে। এরপর তাঁরা পার্লামেন্টের নেতা হওয়ার প্রতিযোগিতায় নামতে পারেন।
জিলানি বলেন, এ ক্ষেত্রেও পিটিআইকে একটি রাজনৈতিক দলে যোগ দিতে হবে। তাঁরা যদি বিদ্যমান দলগুলোর কোনো একটিতে যোগ দেন এবং তাঁদের সংখ্যা যদি বেশি থাকে, তবে তাঁরা অবশ্যই পার্লামেন্টের নেতা নির্বাচন করতে চাইবেন। তবে কোনো কারণে তাঁরা যদি তা না করতে পারেন, তবে অবশ্যই বিকল্প হিসেবে বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচনের উদ্যোগ নেবেন।