পাকিস্তানে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে। রাষ্ট্রীয় উপহার (তোশাখানা) কেনাবেচাসংক্রান্ত দুর্নীতির মামলায় গত শনিবার দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে তিন বছরের কারাদণ্ড দেন ইসলামাবাদের একটি আদালত। সাজা ঘোষণার পরই তাঁকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়। সবশেষ এই ঘটনার জেরে দেশটির রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক সাইফুল সামিন।
পাকিস্তানে সব সময়ই একটা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা চলে আসছে। কেন এই অবস্থা?
ইমতিয়াজ আহমেদ: শুরু থেকেই পাকিস্তান রাষ্ট্র একটি অনিরাপত্তায় ভুগছিল। এই অনিরাপত্তা তারাই তৈরি করেছিল। এর মধ্যে আছে কাশ্মীর ইস্যু। এই অনিরাপত্তা থেকে তারা বৈশ্বিকভাবেই জড়িয়ে যায়। পাকিস্তান সেনটো ও সিয়েটো জোটের সদস্য হয়। অনিরাপত্তার কারণেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী শক্তিশালী হয়ে যায়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী এত বড়, এত শক্তশালী হয়ে গেল যে তারাই দেশটির নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠল। এই কাঠামোতে বেসামরিক প্রশাসনকে স্থান দেওয়ার জায়গা রইল না। ফলে এই কাঠামোতে পাকিস্তানে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসাটা কঠিন। তা ছাড়া পাকিস্তানের এলিট শ্রেণিও দেশটির গণতন্ত্রের দিকে নজর দেয়নি।
পাকিস্তানের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে?
ইমতিয়াজ আহমেদ: ইমরান খান রাজনীতিবিদ ছিলেন না। তিনি সামরিক বাহিনীর সহায়তায় ক্ষমতায় এসেছিলেন বলে একটা ধারণা প্রচলিত আছে। ক্ষমতায় থাকতে গেলে স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে চলতে হয়। ইমরানের সরকার সব সময়ই নড়বড়ে ছিল। এ অবস্থাতে তিনি সেনাবাহিনীসহ অন্য স্টেকহোল্ডারদের বিচ্ছিন্ন করে চলতে গিয়েছিলেন। এই কাজ করতে গিয়েই তিনি বিপদে পড়েছেন। তাঁকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছে। এখন অন্য সবাই তাঁকে চেপে ধরেছে। তিনি যাদের বিচ্ছিন্ন করেছিলেন, এখন তারা চাইবে, ইমরানকে দমিয়ে ক্ষমতা ধরে রাখতে। ইমরানবিরোধী স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে যে ঐক্যটা হয়েছে, তা অস্বাভাবিক। তবে তারা যত দিন এক থাকবে, তত দিন ইমরানের উঠে আসার সম্ভাবনা কম।
দুর্নীতির মামলায় সাজার পর কারাগারে যাওয়া ইমরান খানের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কি হুমকি মুখে পড়ল?
ইমতিয়াজ আহমেদ: ইমরানকে এখন তাঁর বিরোধী শক্তিগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে। পিপিপি ও মুসলিম লিগ (নওয়াজ)-এর মধ্যে গন্ডগোল লাগলে তা ইমরানের জন্য ইতিবাচক হবে। আবার কোনো কারণে পিপিপি ও মুসলিম লিগ (নওয়াজ)-এর সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরোধ বাধতে পারে। সে ক্ষেত্রেও ইমরান সুবিধা পাবেন। আবার পাকিস্তানের জনগণ ইমরানের সাজা ও কারাগারে যাওয়ার বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। জনগণ যদি ইমরানের জন্য রাস্তায় নামেন, তুমুল আন্দোলন গড়ে তোলেন, তা হলে ইমরানের ফিরে আসার সম্ভাবনা আছে।
ইমরান খান কি পাকিস্তানিদের কাছে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বেন?
ইমতিয়াজ আহমেদ: ইমরান ক্ষমতায় থাকাকালে ভেবেছিলেন, জনগণ তাঁর সঙ্গে আছে। তাই তাঁর জোট সরকারের অবস্থা নড়বড়ে থাকা সত্ত্বেও তিনি নানা আগ্রাসী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। পরে তিনি ক্ষমতা হারালেন। আন্দোলন শুরু করলেন। এখন তিনি দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কারাগারে গেলেন। এই পরিস্থিতিতে তিনি তাঁর দেশের জনগণকে কতটা তাঁর পাশে নিয়ে আসতে পারেন, সেটা তাঁর রাজনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তিনি সাজার বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাবেন। অতীতে, বিশেষ করে পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের একটা বিশ্বাসযোগ্যতা দেখা গেছে। সেখানে কী হয়, তা দেখতে হবে। জনগণ চাইলে, আপিলে ভিন্ন কিছু হলে ইমরানের জন্য তা আশীর্বাদ হয়ে আসবে।
পাকিস্তানে যথাসময়ে সাধারণ নির্বাচন হবে বলে মনে হয় কি?
ইমতিয়াজ আহমেদ: অনেকে মনে করেন, পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন যত বিলম্বিত হবে, ততই দেশটির বর্তমান ক্ষমতাসীন জোটের লাভ। কারণ, তত দিনে পাকিস্তানের জনগণ ইমরানের কথা ভুলে যাবেন। আবার এমন মতও আছে যে যথাসময়ে নির্বাচন হলে তা ক্ষমতাসীন জোটের জন্যই ভালো হবে। জোটে টিকে থাকা অবস্থায় এবং জোটের মধ্যে ঐক্য থাকা অবস্থায় নির্বাচন হওয়া ভালো। আমি মনে করি, ইমরানবিরোধীরা যথাসময়ই সাধারণ নির্বাচন করতে চাইবেন।
পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এখন কী চায়?
ইমতিয়াজ আহমেদ: পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এই অভিজ্ঞতা হয়েছে, সরাসরি দেশের ক্ষমতা দখল করলে তাদের ওপর চাপ আসে, সমালোচনা হয়। এই চাপ, এই সমালোচনার কারণে তারা একসময় ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়। ফলে এখন পাকিস্তান সেনাবাহিনী সরাসরি ক্ষমতা দখল করতে চাইবে না। তারা চাইবে অনুগত রাজনৈতিক শক্তিকে সামনে রেখে পেছন থেকে ক্ষমতার কলকাঠি নাড়তে। তারা চাইবে ‘ভাগ কর, শাসন করো’ নীতি দিয়ে ক্ষমতার লাগাম পেছন থেকে ধরে রাখতে।
ইমরান খানের গ্রেপ্তারকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলেছে যুক্তরাষ্ট্র। বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?
ইমতিয়াজ আহমেদ: যুক্তরাষ্ট্রের বিপরীতধর্মী কথাবার্তা ও আচরণ নতুন নয়। তারা আগেও এমন বিপরীতধর্মী আচরণ করেছে। তারা কোথাও গণতন্ত্র-মানবাধিকার-সুশাসনের পক্ষে খুব সোচ্চার থাকে। আবার তারা কোথাও চুপ করে থাকে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বড় ধরনের সম্পর্ক রয়েছে। এই সম্পর্কের কারণেই তারা পাকিস্তানের ক্ষেত্রে একটা বিপরীতধর্মী অবস্থান নিয়েছে। তারা যেমন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কথা শোনে। আবার তাদের কথাও পাকিস্তান সেনাবাহিনী শোনে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের এই আচরণে আমি অবাক নই। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের এই আচরণের ফলে বিশ্বে তাদের গ্রহণযোগ্যতা কমবে।
আপনাকে ধন্যবাদ।
ইমতিয়াজ আহমেদ: প্রথম আলোকেও ধন্যবাদ।