পাকিস্তানের এবারের বিক্ষোভ যে কারণে ‘ব্যতিক্রম’

এর আগেও ইমরান খানকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা হয়েছে। তখনো বিক্ষোভের ঘটনা ঘটেছে। তবে এবারের বিক্ষোভকে ‘ব্যতিক্রমী’ বলছেন বিশ্লেষকেরা।

ইমরান খানকে গ্রেপ্তারের পর লাহোর সেনানিবাস এলাকার এই বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেন বিক্ষোভকারীরা

পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) চেয়ারম্যান, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে দুর্নীতি মামলায় গত মঙ্গলবার গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে দেশটিতে সহিংস গণবিক্ষোভ চলছে। এতে কয়েকজন নিহত হয়েছেন। এর আগেও ইমরান খানকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা হয়েছে। তখনো বিক্ষোভের ঘটনা ঘটেছে। তবে এবারের বিক্ষোভকে ‘ব্যতিক্রমী’ বলছেন বিশ্লেষকেরা।

পিটিআই কর্মী–সমর্থকদের বিক্ষোভ চলাকালে পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনীর বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। সেনাবাহিনীর সদর দপ্তর ও সেনানিবাস ঘিরে বিক্ষোভ করেছেন পিটিআইয়ের কর্মী-সমর্থকেরা, যা ছিল দেশটির ইতিহাসে ‘নজিরবিহীন’।

পাকিস্তানজুড়ে ছড়িয়ে পড়া এই গণবিক্ষোভকে ‘ব্যতিক্রমী’ বলছেন সাংবাদিক ও সশস্ত্র গোষ্ঠী বিশেষজ্ঞ তাহির খান। ইসলামাবাদ থেকে আল-জাজিরাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ইমরান খানের দলের একধরনের ‘স্টেট পাওয়ার’ আছে।

ইমরান খানের সমর্থনে চলা গণবিক্ষোভের বিষয়ে তাহির খান বলেন, ‘এ ধরনের ত্বরিত প্রতিক্রিয়া সাম্প্রতিক সময়ে আমি দেখিনি—একটি দলের কর্মীদের দেওয়া জবাব, বিশেষ করে এ ধরনের গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে।’

সেনাবিরোধী ‘বিরল’ প্রতিক্রিয়া

পাকিস্তানি এই সাংবাদিক বলেন, ‘পাকিস্তানে সামরিক বাহিনীর স্থাপনাকে লক্ষ্যবস্তু করার ঘটনা বিরল। বিষয়টি এখন মারাত্মক পর্যায়ে গড়িয়েছে...আমি মনে করি না, এই বিক্ষোভ থামবে। কারণ, পিটিআই ইতিমধ্যেই বলে দিয়েছে, ইমরান খান চূড়ান্ত সীমা (রেড লাইন)।’

সামরিক বাহিনীর প্রতি এ ধরনের জনরোষ চোখ এড়ায়নি দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক মার্কিন গবেষক মাইকেল কুগেলম্যানেরও। এক টুইটে তিনি বলেছেন, ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতি এমন পর্যায়ের জনরোষ বহুদিন দেখা যায়নি।’

কুগেলম্যান বলেন, ‘সামরিক বাহিনীর স্থাপনায় জনগণের হামলা ও সামরিক সম্পত্তি পুড়িয়ে দেওয়ার আজকের চিত্র কয়েক বছর আগে কল্পনাও করা যেত না। এত অল্প সময়ের মধ্যে এ ধরনের নাটকীয় পরিবর্তন।’

পাকিস্তানের করাচিতে গত মঙ্গলবার জ্বলন্ত পুলিশ ভ্যান থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে বিজয়চিহ্ন দেখাচ্ছেন এক নারী

‘কালো অধ্যায়’ বলছে সেনাবাহিনী

ডনের প্রতিবেদনে বলা হয়, ইমরান খানকে গ্রেপ্তারের পর মঙ্গলবার লাহোরে সেনানিবাসসহ সেনাবাহিনীর বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা চালান বিক্ষোভকারীরা। এ ঘটনাকে দেশের ইতিহাসে ‘কালো অধ্যায়’ হিসেবে স্মরণ করা হবে বলে মন্তব্য করেছে সেনাবাহিনী। বুধবার পাকিস্তানের আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) এক বিবৃতিতে এমন মন্তব্য করা হয়েছে।

বিবৃতিতে বলা হয়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে আইন অনুযায়ী গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারের পরপরই সেনাবাহিনীর বিভিন্ন স্থাপনা ও অবকাঠামো লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়। এ সময় সেনাবাহিনীবিরোধী স্লোগানও দেওয়া হয়েছে। এভাবে কাউকে আইন নিজের হাতে তুলে নিতে দেওয়া হবে না।

আইএসপিআর বলছে, ‘একদিকে নিজেদের সংকীর্ণ ও স্বার্থপর উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য এই দুর্বৃত্তরা জাতির আবেগ নিয়ে খেলছে। অন্যদিকে সেনাবাহিনীর গুরুত্ব তুলে ধরে তারা জনগণের সঙ্গে ধোঁকাবাজি করছে। এটা প্রতারণার একটি উদাহরণ।’

‘ষড়যন্ত্র’ নস্যাৎ করে দেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে আইএসপিআরের বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আমরা ভালোভাবেই জানি, এর (ষড়যন্ত্রের) পেছনে ছিল রাজনৈতিক দলের কয়েকজন ক্ষতিকর নেতার ইশারা, নির্দেশনা ও পূর্বপরিকল্পনা।’

ইসলামাবাদে লংমার্চ করার সময় ইমরান খানের ডান পায়ে তিনটি গুলি লাগে

যেভাবে সেনা-ইমরান বিরোধ

রয়টার্সের এক বিশ্লেষণে বলা হয়, একসময়ের পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ছত্রচ্ছায়ায় থাকার কারণে সমালোচিত ইমরান খান ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধেই ক্ষোভ প্রকাশ করেন। সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়ার সঙ্গে তাঁর বাজে সম্পর্কের বিষয়টি সামনে আসে।

ডনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মঙ্গলবার গ্রেপ্তার হওয়ার আগে আবারও দায়িত্বরত এক জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ তোলেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। ওই কর্মকর্তা তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করছেন বলে একাধিক অনুষ্ঠানে অভিযোগ করেছেন ইমরান খান।

ইসলামাবাদ হাইকোর্টের উদ্দেশে রওনা হওয়ার আগে পিটিআই চেয়ারম্যান নতুন করে একই অভিযোগ করেন। পরে হাইকোর্ট চত্বর থেকে আধা সামরিক বাহিনী রেঞ্জারসের সদস্যরা তাঁকে গ্রেপ্তার করেন।

আইএসপিআরের আগের দিন দেওয়া এক বিবৃতিতে ইমরান খানের ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন ও ভিত্তিহীন’ অভিযোগের নিন্দা জানানো হয়। জবাবে ইমরান খান বলেন, ‘এখান থেকে রওনা হওয়ার আগে আমি দুটি বিষয় বলতে চাই। প্রথমত, আইএসপিআর এক বিবৃতিতে বলেছে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে (সামরিক বাহিনী) অসম্মান করা হচ্ছে। আমাকে দুবার হত্যার চেষ্টা করা গোয়েন্দা কর্মকর্তার নাম বলায় সেনাবাহিনীর সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে।’

ইমরান খান বলেন, ‘আইএসপিআর সাহেব, মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শুনুন। সম্মানের বিষয়টি কেবল একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সীমাবদ্ধ নয়, সব নাগরিকের প্রতি সম্মানবোধ থাকা উচিত।’ তিনি বলেন, ‘এই লোক আমাকে দুবার হত্যার চেষ্টা চালিয়েছে। যখনই কোনো তদন্ত হোক না কেন, আমি প্রমাণ করে দিতে পারব, ইনিই ছিলেন সেই লোক এবং তাঁর সঙ্গে পুরো একটি চক্র আছে।’

গত বছরের নভেম্বরে ইমরান খান গাড়িবহর নিয়ে ইসলামাবাদে লংমার্চ করার সময় গুলিবিদ্ধ হন। ওই ঘটনায় তাঁর পায়ে একাধিক গুলি লাগে। তবে এ যাত্রায় প্রাণে বেঁচে যান ক্রিকেট তারকা থেকে রাজনীতিক বনে যাওয়া সাবেক এই পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী।