পাকিস্তানে দ্বিতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন আসিফ আলী জারদারি। দেশটির প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) কো-চেয়ারম্যান তিনি। সেই সঙ্গে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও পিপিপি নেত্রী প্রয়াত বেনজির ভুট্টোর স্বামী এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টোর জামাতা জারদারি।
গতকাল শনিবারের ভোটাভুটিতে পাকিস্তানের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যেরা রাষ্ট্রপ্রধানের পদে জারদারিকে বেছে নিয়েছেন। ভোটের লড়াইয়ে পাকিস্তান তেহরিক-ই–ইনসাফ (পিটিআই)–সমর্থিত সুন্নি ইত্তিহাদ কাউন্সিলের প্রার্থী মাহমুদ খান আচাকজাইকে হারিয়েছেন তিনি।
এর আগে ২০০৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ছিলেন জারদারি। এবার দেশটির ১৪তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। পাকিস্তানে প্রেসিডেন্টের মেয়াদ পাঁচ বছর।
আসিফ আলী জারদারির আগে আরও ১২ জন পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব সামলেছেন। আসুন জেনে নিই, তাঁরা কারা? কে কত বছর প্রেসিডেন্টের পদে ছিলেন?
পাকিস্তানের চতুর্থ গভর্নর জেনারেল ও প্রথম প্রেসিডেন্ট ছিলেন ইস্কান্দার মির্জা। তিনি ১৯৫৬ থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত দেশটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন। পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান গৃহীত হওয়ার পর রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব নেন ইস্কান্দার। চরম রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিরোধের কারণে তাঁর শাসনামল বেশ আলোচিত। পরে ১৯৫৮ সালে মার্শাল ল জারি হয় পাকিস্তানে।
সামরিক কর্মকর্তা আইয়ুব খান ১৯৫৮ সালে ইস্কান্দার মির্জাকে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করেন। পরে তিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হন। ক্ষমতায় ছিলেন ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত। আইয়ুবের আমলে পাকিস্তানে ব্যাপক অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছিল। তবে রাজনীতি ছিল অস্থিরতায় ভরা। মৌলিক গণতন্ত্র নামে পাকিস্তানে ব্যতিক্রমী গণতন্ত্র চালু করেছিলেন তিনি। ব্যাপক গণ-আন্দোলনের মুখে ১৯৬৯ সালে ক্ষমতা ছাড়েন আইয়ুব।
আইয়ুবের বিদায়ের পর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হন আরেক সামরিক কর্মকর্তা, জেনারেল ইয়াহিয়া খান। ১৯৬৯ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত তিনি ক্ষমতায় ছিলেন। তাঁর আমলে চরম রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হয়। শোষণ ও বৈষম্যের শিকার তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন শুরু করে। ৯ মাস পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন হয় বাংলাদেশ। পরে পাকিস্তানের ক্ষমতা ছাড়েন ইয়াহিয়া খান।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হন জুলফিকার আলী ভুট্টো। ক্ষমতায় ছিলেন ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত। নতুন সংবিধান প্রণয়ন, পার্লামেন্টভিত্তিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালুসহ বিভিন্ন সংস্কারের জন্য আলোচিত ছিলেন ভুট্টো। তাঁর হাত ধরেই প্রধানমন্ত্রী পদটি পাকিস্তানে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ক্ষমতা ছাড়ার বেশ পরে ১৯৭৯ সালের ৪ এপ্রিল ভুট্টোকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
পাকিস্তানের পঞ্চম প্রেসিডেন্ট ফজল ইলাহী চৌধুরী। ১৯৭৩ সালে ক্ষমতায় এসেছিলেন তিনি। ছিলেন ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত। ১৯৭৩ সালে গৃহীত পাকিস্তানের নতুন সংবিধানের অধীনে প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ছিলেন তিনি। যদিও তাঁর ক্ষমতা ছিল আলংকারিক। মূলত ক্ষমতা ছিল প্রধানমন্ত্রী ও পার্লামেন্টের হাতে। শেষ অবধি প্রেসিডেন্টের পদ থেকে পদত্যাগ করে বিদায় নেন ফজল চৌধুরী।
জেনারেল জিয়াউল হক ১৯৭৮ সালে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেন। তিনি টানা এক দশক ক্ষমতায় ছিলেন। ইসলামপন্থী নীতি প্রণয়নের জন্য আলোচিত ছিলেন জিয়াউল। ১৯৮৮ সালে উড়োজাহাজ দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় তাঁর।
প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হকের মৃত্যুর পর রাষ্ট্রক্ষমতায় আসেন গুলাম ইশহাক খান। ১৯৮৮ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত তিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। চরম রাজনৈতিক সংকট ও বেনজির ভুট্টোর নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে রাষ্ট্রপ্রধানের পদ ছাড়তে হয় তাঁকে। বেনজিরের সরকারকে উৎখাত করতে চেয়েছিলেন ইশহাক খান। কিন্তু শেষ অবধি তাঁকেই বিদায় নিতে হয়।
পাকিস্তানের অষ্টম প্রেসিডেন্ট ফারুক লেঘারি। ক্ষমতায় ছিলেন ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত। দেশের গণতন্ত্রকে সুসংহত করা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখেন তিনি। যদিও দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার জন্য সমালোচিত ছিলেন তিনি। বিরোধ ছিল প্রধানমন্ত্রী বেনজিরের সঙ্গেও। ১৯৯৭ সালে পদত্যাগ করেন প্রেসিডেন্ট ফারুক।
১৯৯৭ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ছিলেন মোহাম্মদ রফিক তারার। দেশের গণতন্ত্রকে এগিয়ে নেওয়া, রাষ্ট্রীয় সংগঠনগুলোকে শক্তিশালী করার জন্য পরিচিতি পান। তবে নওয়াজ শরিফের সরকারের সঙ্গে তাঁর চরম বিরোধ ছিল। শেষ পর্যন্ত পদত্যাগ করেছিলেন রফিক তারার।
২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন সামরিক শাসক পারভেজ মোশাররফ। ১৯৯৯ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তিনি ক্ষমতায় আসেন। তাঁর শাসনামলে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধে সমর্থন দেয় পাকিস্তান।
দেশের ভেতরকার রাজনৈতিক বিরোধী পক্ষকে দমনের জন্যও সমালোচিত ছিলেন মোশাররফ। তাঁর আমলে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো। ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে ২০০৭ সালে দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন মোশাররফ। শেষ রক্ষা হয়নি। এক বছর পর রাষ্ট্রপ্রধানের পদ ছাড়তে হয় তাঁকে। পাকিস্তানের সর্বশেষ সামরিক শাসক পারভেজ মোশাররফ।
সেনা শাসনের বিদায়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেন বেনজির ভুট্টোর স্বামী আসিফ আলী জারদারি। তখন ২০০৮ সাল। জারদারি এ পদে ছিলেন ২০১৩ সাল পর্যন্ত। রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সংকট ছিল তাঁর শাসনামলে। এরপরও পাঁচ বছরের শাসনকাল পার করতে পেরেছিলেন জারদারি।
পাকিস্তানের রাজনীতিতে মামনুন হুসেইন খুব একটি পরিচিত মুখ ছিলেন না। আসিফ আলী জারদারির বিদায়ে তাঁকে বেছে নেওয়া হয় পাকিস্তানের ১২তম প্রেসিডেন্ট পদে। ২০১৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্ব সামলেছেন। তিনিও পাঁচ বছরের শাসনকাল পার করেছেন। ২০২১ সালে মারা গেছেন মামনুন।
পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট ইমরান খানের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত আরিফ আলভি। ২০১৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের ১৩তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেন। মেয়াদ পূর্ণ করে জারদারির হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়ে সবে বিদায় নিলেন তিনি। দেশজুড়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, প্রযুক্তি ও সুশাসনের বিকাশ এবং দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরায় আলভির অবদান স্মরণ করে পাকিস্তানবাসী।