অনেক বছর ধরেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিশ্বাস ছিল দেশের জন্য একজন ‘ত্রাতা’ খুঁজে পেয়েছে তারা। এ ত্রাতা হলেন ইমরান খান। কিন্তু লেখক ও সাংবাদিক মোহাম্মদ হানিফ লিখেছেন, ক্ষমতা থেকে অপসারিত হওয়ার এক বছরের মাথায় এসে দেখা যাচ্ছে, সেই ইমরান খানই সেনাবাহিনীর ‘চিরশত্রু’ হয়ে উঠছেন। ইমরানের আক্রোশ থেকে বাঁচতে সেনাবাহিনীও সর্বশক্তি ব্যবহার করছে।
ইমরান খান ও তাঁর দল পাকিস্তান তেহরিক–ই–ইনসাফের (পিটিআই) বিরুদ্ধে দেশজুড়ে ধরপাকড় ও সাঁড়াশি অভিযান চলছে। এতে পুরো পাকিস্তানই স্থবির হওয়ার মতো অবস্থা তৈরি হয়েছে।
নিত্যপণ্যের দাম অনেক বেড়ে যাওয়ার কারণে ভুগছে পুরো পাকিস্তানের লোকজন। তীব্র গরমে প্রাণ ওষ্ঠাগত। দেশটির ইতিহাসে এবার গ্রীষ্মকাল সবচেয়ে উষ্ণ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিদ্যুৎ–বিভ্রাট। বেশির ভাগ সময় বিদ্যুৎ থাকছে না। এ পরিস্থিতির মধ্যে দেখা দিয়েছে চরম রাজনৈতিক সংকট। ইমরান এরপর কী করবেন, তাঁকে ঠেকাতে সেনাবাহিনী কী পদক্ষেপ নেয়, সেই চিন্তাই গ্রাস করেছে পুরো জাতিকে।
এক বছরের বেশি সময় আগে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দিতে বাধ্য হন ইমরান খান। তাঁর সমর্থকেরা হুমকি দিয়ে আসছিলেন, ইমরান খানকে গ্রেপ্তার করা হলে দেশে আগুন জ্বলবে। কয়েকবারের ব্যর্থ চেষ্টার পর ৯ মে ইমরান খানকে গ্রেপ্তার করে আধা সামরিক বাহিনীর সদস্যরা।
ইমরান খানকে গ্রেপ্তার করার পরে পুরো দেশ না জ্বললেও সেনানিবাস পর্যন্ত সহিংসতা হয়েছে। পাকিস্তানের সবচেয়ে সুরক্ষিত জায়গা মনে করা হয় দেশটির সেনাবাহিনীর সদর দপ্তরকে, যেটি জেনারেল হেডকোয়ার্টার্স (জিএইচকিউ) নামে পরিচিত। ইমরান খানের দলের কর্মী ও সমর্থকেরা সেই সেনা সদর দপ্তরে ঢুকে, সেনাবাহিনীর পতাকাসংবলিত সাইনবোর্ড খুলে ফেলেছিল।
লাহোরে সেনাবাহিনীর একজন জ্যেষ্ঠ জেনারেলের বাসভবনে আগুন দেওয়া হয়। জেনারেলের বাড়ির আসবাব ও গাড়িতে আগুন দেওয়ার সময় সেই দৃশ্য ক্যামেরায় ধারণ করতে দেখা যায় ইমরান খানের সমর্থকদের। জেনারেলের সামরিক পোশাক পরে এক বিক্ষোভকারীকে ওই বাড়ি থেকে বের হতে দেখা যায়। আরেকজনকে দেখা যায়, জেনারেলের পোষা ময়ূরটি নিয়ে যাচ্ছেন।
দেশটির প্রথম নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছিল। তাঁর মেয়ে বেনজির ভুট্টোকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে দুবার অপসারণ করা হয়। পরে আত্মঘাতী বোমা হামলায় তিনি নিহত হন। হামলাকারী ছিল একজন কিশোর। সে ঘটনার পূর্ণ তদন্ত কখনো হয়নি। আরেক সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকেও অপসারণ করা হয়েছিল। এরপর তিনি কারাগারে ছিলেন, পরে নির্বাসিত হন। এখনো বিদেশে আছেন। নওয়াজের ছোট ভাই শাহবাজ শরিফ এখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। তাঁর মাধ্যমে নওয়াজই কার্যত দেশ চালালেও তিনি এখনো পাকিস্তানে ফিরতে পারেননি।
ইমরান খানের কর্মী–সমর্থকদের এ কর্মকাণ্ডে বিপ্লবের সব নমুনা থাকলেও তা ‘বিপ্লব’ ছিল না। সেনাবাহিনী প্রথম ইমরানকে ভালোবেসে কাছে টেনে নিলেও পরে তাঁকে দূরে ঠেলে দেয়। এখন তাঁর সমর্থকেরা প্রতিশোধ নিচ্ছেন। একে বিপ্লব বলা যায় না, হতে পারে খুনসুটিমূলক ঝগড়ার বেশি।
সেনাবাহিনীর সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পাকিস্তানে প্রধানমন্ত্রীদের ক্ষমতা হারানো রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দেশটির প্রথম নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছিল। তাঁর মেয়ে বেনজির ভুট্টোকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে দুবার অপসারণ করা হয়। পরে আত্মঘাতী বোমা হামলায় তিনি নিহত হন। হামলাকারী ছিল একজন কিশোর। সে ঘটনার পূর্ণ তদন্ত কখনো হয়নি। আরেক সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকেও অপসারণ করা হয়েছিল। এরপর তিনি কারাগারে ছিলেন, পরে নির্বাসিত হন। এখনো বিদেশে আছেন। নওয়াজের ছোট ভাই শাহবাজ শরিফ এখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। তাঁর মাধ্যমে নওয়াজই কার্যত দেশ চালালেও তিনি এখনো পাকিস্তানে ফিরতে পারেননি।
ইমরান খানকে গ্রেপ্তারের পর তাঁর সমর্থকেরা যা করেছেন, এর আগে কোনো মূলধারার রাজনৈতিক শক্তিকে তা করতে দেখা যায়নি। গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে রাজপথে নেমে বিক্ষোভ করার পরিবর্তে তাঁরা সেনানিবাস এলাকায় আক্রমণ করে এবং পাকিস্তানের জেনারেলরা কীভাবে জীবন যাপন করছেন, তা নাগরিকদের দেখান (বিশাল প্রাসাদ, সুইমিং পুল আর কয়েক একর জমিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে ময়ূর)।
ইসলামাবাদ হাইকোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে গ্রেপ্তার হওয়ার কিছুক্ষণ আগে এক বক্তব্যে ইমরান খান এই ইঙ্গিত দেন, সেনাপ্রধান আসিম মুনির হলেন সেই ব্যক্তি, যিনি পিটিআইকে ধ্বংস করতে চাইছেন।
এর আগে পাকিস্তানের সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়াকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলেছিলেন ইমরান খান। যদিও মনে করা হয়, ইমরান খানকে ক্ষমতায় আনা ও টিকিয়ে রাখতে ভূমিকা ছিল জেনারেল বাজওয়ার। একই সঙ্গে ইমরান খান দাবি করেন, পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের এক জেনারেল তাঁকে হত্যার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। ইমরান খান ও তাঁর সমর্থকেরা একাধিক জনসমাবেশে সেই জেনারেলকে ‘বেপরোয়া ও উগ্র’ আখ্যায়িত করেন।
অতীতে পাকিস্তানের অনেক রাজনীতিককে প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেনাবাহিনীর ভূমিকার সমালোচনা করতে দেখা গেছে। কিন্তু সেনাবাহিনীর একজন কমান্ডারের বাসভবনে আগুন, সেনা সদর দপ্তরে নারী বিক্ষোভকারীদের হট্টগোল এবং বীর সেনানীদের ভাস্কর্য ভাঙার ঘটনা দেখে অভ্যস্ত ছিলেন না পাকিস্তানিরা।
অতীতে পাকিস্তানের অনেক রাজনীতিককে প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেনাবাহিনীর ভূমিকার সমালোচনা করতে দেখা গেছে। কিন্তু সেনাবাহিনীর একজন কমান্ডারের বাসভবনে আগুন, সেনা সদর দপ্তরে নারী বিক্ষোভকারীদের হট্টগোল এবং বীর সেনানীদের ভাস্কর্য ভাঙার ঘটনা দেখে অভ্যস্ত ছিলেন না পাকিস্তানিরা।
ইমরান খান ও তাঁর সমর্থকেরা এসব করায় এ ধরনের ধরপাকড় ও সাঁড়াশি অভিযান যে হবে, তা ইমরানবিরোধী প্রায় সব দলকে নিয়ে গঠিত বর্তমান জোট সরকারের দিক থেকে প্রত্যাশিতই ছিল।
ইমরান খান শিবিরের অভিযোগ, আসন্ন জাতীয় নির্বাচন বানচালের চেষ্টা চালাচ্ছে সরকার। একাধিক মতামত জরিপে উঠে এসেছে, এই নির্বাচন হলে ইমরান খানেরই জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। বর্তমান জোট সরকারে থাকা দলগুলোর অনেক রাজনীতিক ইমরানের দল পিটিআইকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধের দাবি তুলেছেন।
তালেবানের প্রতি সহানভূতিশীল হওয়ায় একবার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সমালোচনা করেছিলেন জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত সদস্য আলী ওয়াজির। এ ঘটনার পর তাঁর দুই বছরের কারাদণ্ড হয়েছিল। এমনকি তাঁকে জাতীয় পরিষদেও ঢুকতে দেওয়া হয়নি। বেলুচিস্তানে কয়েক হাজার নেতা–কর্মীকে গুম করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে পাকিস্তানের আদালত বা মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলো নীরব।
তাহলে শতাধিক মামলার পরেও ইমরান খান কীভাবে এখনো স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছেন? অনেকের ধারণা, ইমরান খান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মধ্যে মেরুকরণ ঘটিয়েছেন। অনেক সেনা কর্মকর্তা ও তাঁদের পরিবার ইমরান খানের গুণমুগ্ধ। গ্রেপ্তারের পর একদিন পুলিশি হেফাজতে থাকার পরই পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি তাঁকে আদালতে হাজির করার নির্দেশ দেন এবং বলেন, ‘আপনাকে দেখে ভালো লাগছে।’ তাঁকে অতিথিশালায় রাখার নির্দেশ দেন। পরদিন এক বিচারক তাঁকে জামিন দেন।
ইমরান খান পাকিস্তানের এমন কিছু নির্বাচনী এলাকায় জয় পেয়েছিলেন, যেসব এলাকার মানুষ আগে রাজনীতি আর রাজনীতিকদের ঘৃণা করতেন। ইমরান খান সুশাসন ও ন্যায়বিচারের যে বার্তা দিয়েছিলেন, তা জনপ্রিয় হয়েছিল। যদিও ইমরান খান ক্ষমতায় থাকার সময় দুর্নীতি বেড়েছিল পাকিস্তানে এবং একই সঙ্গে অনেক বিরোধী রাজনীতিককে জেলে ঢোকানো হয়েছিল।
কিন্তু ক্ষমতা থেকে ইমরান খানকে অপসারণ, তাঁর প্রতি জনসমর্থন আরও বাড়িয়েছে। এর মধ্যে বেশির ভাগ হলেন নারী ও তরুণ, যাঁরা এর আগে ভোট দেননি এবং রাজনৈতিক সমাবেশে যাননি।
ইমরান খানের এসব সমর্থকদের প্রায়শ ‘রাজনৈতিক নির্বোধ’ বলা হয়ে থাকে। অভিযোগ আছে, ইমরানের এসব সমর্থক পাকিস্তানের বর্তমান রাজনৈতিক সংকটকে ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে দেখেন না এবং তাঁদের মতে, এখন যা ঘটছে, পাকিস্তানের ইতিহাসে আগে কখনো তা ঘটেনি। তাঁরা নিজেদের এমন এক আন্দোলনের অংশ মনে করেন, যে আন্দোলনে দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিকদের পতন ঘটবে।
ইমরান খানের মতো তাঁর এসব সমর্থকও একদা পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে ভালোবাসতেন। কিন্তু এখন সেই তারাই পাকিস্তানে চলমান সব রকম সংকটের জন্যই সেনাবাহিনী দায়ী বলে মনে করেন।
সেনা নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ইমরান খানের বারবার আক্রমণাত্মক অবস্থানের পরও অনেকের ধারণা, তিনি সত্যিকার অর্থে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা খর্ব করতে চান না। তিনি শুধু আগের মতোই তাঁর প্রতি জেনারেলরদের ভালোবাসা চান। তিনি চান, তাঁকে ও তাঁর দলকে জেনারেলরা সহযোগিতা করুক।
ইমরান খান পাকিস্তানের এমন কিছু নির্বাচনী এলাকায় জয় পেয়েছিলেন, যেসব এলাকার মানুষ আগে রাজনীতি আর রাজনীতিকদের ঘৃণা করতেন। ইমরান খান সুশাসন ও ন্যায়বিচারের যে বার্তা দিয়েছিলেন, তা জনপ্রিয় হয়েছিল। যদিও ইমরান খান ক্ষমতায় থাকার সময় দুর্নীতি বেড়েছিল পাকিস্তানে এবং একই সঙ্গে অনেক বিরোধী রাজনীতিককে জেলে ঢোকানো হয়েছিল।
কিন্ত ৯ মে ইমরান খানকে গ্রেপ্তারের পরে দেশজুড়ে তাঁর সমর্থকদের সহিংসতার জেরে সেনাবাহিনীর শীর্ষ পর্যায় ‘যথেষ্ট হয়েছে, আর নয়’ নীতি নিয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। সেনাপ্রধান আসিম মুনির ৯ মে ‘পাকিস্তানের ইতিহাসের একটি কালো দিন’ বলেছেন।
ইমরান খান হয়তো পাকিস্তানে একটি ‘লোকরঞ্জনবাদী’ রাজনৈতিক ধারার গোড়াপত্তন করেছেন। কিন্ত ইমরান খানকে সরাতে তাঁর পূর্বসূরিদের মতোই একই পদ্ধতির আশ্রয় নিয়েছে সেনাবাহিনী।
কয়েক ডজন দুর্নীতির মামলা, নির্বিচার গ্রেপ্তার এবং হামলার নিয়ে সেনাবাহিনীর ‘স্পষ্ট বার্তার’ মধ্য দিয়ে এটাই স্পষ্ট হয়েছে যে ইমরান খান তাঁর ‘চূড়ান্ত সীমা’ (রেড লাইন) অতিক্রম করেছেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীও তাঁদের মধ্যে যাঁরা ইমরান খানের প্রতি সহানুভূতিশীল, তাঁদের খুঁজছে।
এ ছাড়া সেনাবাহিনী ইমরান খানের দল পিটিআইকে ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। এ লক্ষ্যে দলটির কর্মী–সমর্থকদের নির্বিচার গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। একই সঙ্গে ৯ মে সেনানিবাসে হামলার সঙ্গে জড়িত সন্দেহভাজন পিটিআই নেতা-কর্মীর বিচার সামরিক আইনে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ইমরান খানের দলের অনেক জ্যেষ্ঠ নেতা পিটিআই থেকে পদত্যাগ করার ব্যাপক চাপে আছেন। ইতিমধ্যে কেউ কেউ পদত্যাগ করেছেন। অনেকে পদত্যাগ করবেন বলে গুঞ্জন রয়েছে। দলত্যাগী নেতাদের দাবি, সেনাবাহিনীর প্রতি ইমরান খানের দ্বান্দ্বিক অবস্থান মেনে নিতে পারছেন না তাঁরা।
অতীতে দেখা গেছে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী যখনই বেসামরিক নেতৃত্বের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়েছে, তারা কোনো না কোনো একটা উপায় বের করেছে। অন্যদিকে ইমরান খান তাঁর কর্মী–সমর্থকদের ‘দাসত্বের বদলে মৃত্যুর পথ বেছে নিতে’ বলেছেন। এতে একটা অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। আগেও এমন রাজনৈতিক অচলাবস্থায় ভুক্তভোগী হয়েছেন সাধারণ মানুষ। এবারও তার ব্যতিক্রম হবে বলে মনে হয় না।