বিশ্লেষণ

পাকিস্তান আর কত রাজনীতিবিদের ‘বধ্যভূমি’ হয়ে থাকবে 

১৯৪৭ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে পাকিস্তানে যত ‘উজির-ই-আজম’ এসেছেন, তাঁদের মধ্যে জনপ্রিয় পেশাজীবী রাজনীতিবিদের সংখ্যা বেশি নয়। অনেকেই তাঁরা মেয়াদ শেষ করে পদ ছাড়তে পারেননি।

ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দেশজুড়ে বিক্ষোভের ডাক দিয়েছিলেন পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান
ফাইল ছবি রয়টার্স

দক্ষিণ এশিয়ার কোনো নেতার জানাজায় কত মানুষ অংশ নিলেন, তাকে অনেক সময় রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করতে দেখা যায়। ১৯৬৩ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর যে জানাজা হয়, তা ছিল ‘ইতিহাসের বৃহত্তম’। কিন্তু সোহরাওয়ার্দীকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১৩ মাসের বেশি টিকতে দেওয়া হয়নি। তাঁর মৃত্যুকে ঘিরেও রহস্য ছিল। রহস্য আছে প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের অস্বাভাবিক মৃত্যু নিয়েও। 

এই দুজনের পর দেশটিতে জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। তাঁর বেলায় কোনো রহস্য রাখা হয়নি। প্রথমে ক্ষমতাচ্যুত এবং পরে প্রশ্নবিদ্ধ এক বিচারপ্রক্রিয়ায় ফাঁসি দিয়ে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের ইতি টানা হয়। তাঁর কন্যা বেনজির ভুট্টোকেও জীবন দিয়ে রাজনীতি থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। তাঁর হত্যার কোনো বিচার হয়নি এবং সেই বিচার কেউ জোরেশোরে চায়ও না! 

১৯৪৭ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে পাকিস্তানে যত ‘উজির-ই-আজম’ এসেছেন, তাঁদের মধ্যে জনপ্রিয় পেশাজীবী রাজনীতিবিদের সংখ্যা বেশি নয়। অনেকেই তাঁরা মেয়াদ শেষ করে পদ ছাড়তে পারেননি। ১৮ বার এ রকম ঘটেছে। 

ইমরান খানের বেলায় শেষ পর্যন্ত কী হবে, কেউ আর জানে না? ইতিমধ্যে তাঁর বন্দিজীবন শুরু হয়েছে। রাজনীতিবিদ হিসেবে তাঁর ওপর পাঁচ বছরের নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। অর্থাৎ তাঁকে রাজনৈতিকভাবে হত্যার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে।

প্রশ্ন উঠেছে, পাকিস্তান এ রকম প্রক্রিয়া রুখতে পারছে না কেন? দেশটি কেন রাজনীতিবিদদের বধ্যভূমি হয়ে থাকছে? এর পেছনে ভূরাজনৈতিক কোনো যোগসূত্র আছে কি? 

প্রচারমাধ্যমে ইমরানের ছবিতেও নিষেধাজ্ঞা

১২ আগস্ট পর্যন্ত মেয়াদ থাকলেও তিন দিন আগে ৯ আগস্ট মধ্যরাতে পাকিস্তানের সর্বশেষ নির্বাচিত পার্লামেন্টের মেয়াদ শেষ করে দেওয়া হয়। গত বছর পদত্যাগের আগে এই সংসদে সবচেয়ে বেশি আসন ছিল (১২৩টি) পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ বা পিটিআইয়ের। অথচ পরিষদের মেয়াদ শেষের দিন ওই দলের কারও কথাবার্তা প্রচারমাধ্যমে দেখা যায়নি। ইমরান আর তাঁর দলের ইতিবাচক কোনো সংবাদ প্রকাশ না করার ব্যাপারে প্রচারমাধ্যমের ওপর প্রচণ্ড চাপ আছে। ইমরানের ছবিও কম দেখাতে বলা হয়েছে। তাঁর নাম না বলে তাঁকে ‘পিটিআইয়ের চেয়ারম্যান’ বলার নির্দেশ রয়েছে। প্রচারমাধ্যমকে এসব নির্দেশনা দিয়েছে ‘প্রেমরা’ নামে পরিচিত ‘মিডিয়া রেগুলেটরি কর্তৃপক্ষ’ এবং বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা। বিবিসিতে ক্যারোলিন ডেভিস এসব নিষেধাজ্ঞার বিস্তারিত এক বিবরণ দিয়েছেন গত ৮ জুন তাঁর লেখায়। ইমরানের ক্ষমতায় থাকার শুরুর দিকে একই নির্দেশনা ছিল নওয়াজ শরিফের বেলায়। শরিফদের মোকাবিলায় তখন ইমরান ও সেনাবাহিনীর ‘মধুচন্দ্রিমা’ চলছিল। 

বিশ্বজুড়ে প্রতিবছর যখন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারের (আরএসএফ) ‘মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে’ পাকিস্তানের ক্রমাবনতি দেখানো হয়, তখন এর পেছনে দেশটির সামরিক প্রশাসনের ভূমিকা কমই আলোকপাত করা হয়। আরএসএফের সর্বশেষ প্রতিবেদনে ১৮০ দেশের মধ্যে পাকিস্তানের ঠাঁই হয়েছে ১৫০তম জায়গায়। 

ইমরানের ‘ভুল’গুলো

ইউরোপ-আমেরিকা অনেক সময় পাকিস্তানের গণতন্ত্রহীনতার খারাপ সূচকগুলো নিয়ে মাতম করে। কিন্তু দেশটি রাজনীতি ও সংবাদমাধ্যমের ‘বধ্যভূমি’ হয়ে ওঠায় তাদের সহানুভূতি ছিল বলে ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের সুসম্পর্কের গোড়াপত্তনকারী ছিলেন সোহরাওয়ার্দী। ১৯৫৬ সালে আইজেন হাওয়ার প্রশাসনকে পাকিস্তান থেকে মধ্য এশিয়ায় রুশদের ওপর গোয়েন্দা নজরদারির অনুমতি দিয়েছিলেন তিনি। পাকিস্তানের সর্বোচ্চ খেতাব নিশান-ই-পাকিস্তান প্রথমবার দেওয়া হয় একজন মার্কিন প্রেসিডেন্টকেই। তা-ও সোহরাওয়ার্দীর আমলেই। কিন্তু ইসকান্দার মির্জা ও আইয়ুব খান যখন সোহরাওয়ার্দীকে অপদস্থ করেন, তখন ওয়াশিংটন চোখ বন্ধ রাখে। সোহরাওয়ার্দীর চীনবান্ধব নীতি এর কারণ বলে মনে করা হয়। 

একই কথা বলা যায় জুলফিকার আলী ভুট্টোর বেলায়। কিসিঞ্জার পাকিস্তানি এই নেতার প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের অবাধ্য হয়ে পারমাণবিক কর্মসূচি চালাতে গিয়ে কেবল রাজনীতি করার অধিকার নয়, প্রাণও হারাতে হয় তাঁকে। তাঁর কন্যা বেনজির যাঁর শাসনামলে নিহত হন, সেই জেনারেল মোশাররফ ‘সন্ত্রাসবিরোধী অনন্ত যুদ্ধে’ দক্ষিণ এশিয়ায় ওয়াশিংটনের প্রধান মিত্র ছিলেন। সংগত কারণে বেনজিরের মৃত্যু নিয়ে খুব বেশি উচ্চবাচ্য হয়নি।

ইমরানমুক্ত দৃশ্যপটে তখন যিনি সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক অংশীদার হবেন, তাঁর জন্যও ‘বধ্যভূমি’ অপেক্ষায় থাকবে। দৃশ্যমান ‘রাষ্ট্র’-এর ভেতর থাকা অদৃশ্য ‘রাষ্ট্র’ বেশি শক্তিশালী হলে এ রকম সমস্যা হয়। বিদেশিরাও অনেক সময় সে-ই ‘সমস্যা’য় ইন্ধন দেয়। অন্তত পাকিস্তানে বহুবার দিয়েছে! 

ইমরান খানকে নিয়েও পশ্চিমে ব্যাপক উচ্ছ্বাস ছিল। অনেকের হয়তো মনে আছে, ২০১২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সাময়িকী নিউজ উইক ইমরানকে নিয়ে প্রচ্ছদ করে ‘কিং খান’ শিরোনামে। একই বছর টাইম ম্যাগাজিনও ইমরানকে নিয়ে প্রচ্ছদকাহিনি করে। তাঁকে ‘পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী’ হিসেবে ইঙ্গিত দেয়। ইমরান নিজে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিউজ উইকটাইম-এর সেসব প্রচ্ছদ শেয়ার করতেন। সেই ইমরানের ক্ষমতাচ্যুতি, কারাবরণ এবং রাজনীতি থেকে নির্বাসন এখন ওয়াশিংটনের কাছে ‘পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়’। আর ইমরানও মনে করছেন, তাঁর বর্তমান করুণ হালের পেছনে বাইডেন প্রশাসনের হাত আছে! 

২০২১ সালের আগস্টে আফগানিস্তান থেকে ন্যাটো বাহিনীর বিদায়ে ইমরানের ভূমিকায় ওয়াশিংটন বেজায় নাখোশ ছিল। গোয়েন্দা সংস্থা ‘ইন্টার সার্ভিস ইন্টেলিজেন্স’-এর তখনকার মহাপরিচালক জেনারেল ফয়েজ হামিদকে দিয়ে ইমরান তালেবানকে অন্ধভাবে মদদ দেন, যা পশ্চিমা সৈনিকদের লজ্জাজনকভাবে কাবুল ছাড়ার তাৎক্ষণিক সংকট তৈরি করে। যে গোয়েন্দা বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে ইমরান তখন এই কৌশল নিয়েছিলেন, তারাই এখন তাঁর রাজনৈতিক মৃত্যু নিশ্চিত করতে ব্যস্ত।

তবে ইমরান নিজের কফিনে শেষ পেরেকটি নিজেই লাগিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের দ্য ইন্টারসেপ্ট-এ গত সপ্তাহে বের হওয়া এই তথ্য ইতিমধ্যে বিশ্বের সব পত্রিকায় বেরিয়ে গেছে যে ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের মুখে ২০২২-এর ফেব্রুয়ারিতে ইমরানের রাশিয়া সফর কীভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের কাছে তাঁর ‘আইসোলেশন’ বা বিচ্ছিন্নতা নিশ্চিত করেছিল। একই মাসে ইমরান চীনে শীতকালীন অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেও যান, যুক্তরাষ্ট্র যা কূটনৈতিকভাবে বর্জন করেছিল।

ওয়াশিংটনের ইচ্ছা-অনিচ্ছার সঙ্গে এমন দূরত্ব বাড়ার মুখেই ইমরান জাতীয় পরিষদে অনাস্থা ভোটের মুখে পড়েছিলেন। ইন্টারসেপ্ট ৯ আগস্ট লিখেছে, ওই ভোটে ইমরানের পরাজয় নিশ্চিত করতে দেশটির ‘ডিপস্টেট’ ভূমিকা রেখেছিল।

একটি রাজনৈতিক সংস্কার উদ্যোগের অপমৃত্যু

ইমরানের উত্থান ও বর্তমান অবস্থা পাকিস্তানের জন্য এই অর্থে ‘ক্ষুদ্র ঘটনা’ যে দেশটিতে দশকের পর দশক এ রকম ‘নাটক’ চলছে। তবে এবারের অধ্যায়ে বাড়তি হতাশার কারণ আছে। ইমরান কারারুদ্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ এক রাজনৈতিক সংস্কার আন্দোলনও বিপর্যস্ত হলো। পিটিআই দেশটির রাজনীতিকে পরিবারতান্ত্রিক ঐতিহ্য এবং দ্বিদলীয় অবস্থা থেকে মুক্ত করেছিল। শরিফ ও ভুট্টো বংশীয়দের মুসলিম লিগ ও পিপলস পার্টি পাঞ্জাব ও সিন্ধুর কুলীনদের মাঝে ছদ্ম এক প্রাদেশিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাও তৈরি করেছিল। পিটিআই এটি ভেঙে দিতে সক্ষম হয়। 

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে রাষ্ট্র সংস্কারের তাগিদ ও আকুতি কত তীব্র, তা পিটিআইয়ের বেলায় দেখা যায়। মাত্র দুটি নির্বাচন পার হয়েই দলটি প্রধান দলে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। ২০০২-এ ৯২ আসনে ভোট করে তারা মাত্র ১টি আসন পায়। ভোট পায় ১ শতাংশের কম। ২০১৮ সালের নির্বাচনে তারা ৫২ শতাংশ ভোট এবং ১১৬টি আসন পায়। পরে আরও কয়েকটি আসন বাড়ে তাদের। 

দ্বিদলীয় ব্যবস্থায় মুসলিম লিগ মূলত পাঞ্জাবে, ভুট্টোরা মূলত সিন্ধুতে এবং ইসলামপন্থী দলগুলো সাধারণত ফ্রন্টিয়ার এলাকায় ভালো করত। পিটিআই হয়ে উঠেছিল জাতীয় ভিত্তিক দল। মুসলিম লিগ ২০১৮ সালে পাঞ্জাবের প্রাদেশিক পরিষদে যখন ১৬৬টি আসন পায়, সিন্ধুর পরিষদে তখন ১টি আসনও পায়নি, বেলুচিস্তানে পায় কেবল ১টি। আবার পিপিপি সিন্ধুতে তখন পায় ৯৯টি আসন, পাঞ্জাবে পায় ৬টি; বেলুচিস্তানে ১টিও নয়। অর্থাৎ এই দুই দল কেবল একটা প্রদেশের শক্তির জোরে চলত—পিটিআই সে জায়গায় জাতীয় ভারসাম্যপূর্ণ দল হয়ে ওঠে। তারা ২০১৮-এর নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদগুলোর মধ্যে ফ্রন্টিয়ারে ৮৫টি, সিন্ধুতে ৩০টি, বেলুচিস্তানে ৭টি এবং পাঞ্জাবে ১৮১টি আসন পায়। এভাবেই পাকিস্তানে প্রাদেশিক বৈষম্য দূর করার একটা রাজনৈতিক কাঠামো হিসেবে নিজেকে হাজির করে পিটিআই। এ রকম দল যত শিকড় বিস্তার করত, পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র তত চ্যালেঞ্জে পড়ত। পিটিআইয়ের সফলতার মূলে ছিল কুলীনতন্ত্র ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে আমেরিকা-ইউরোপের ভূমিকার প্রশ্নেও পিটিআই সমালোচক ছিল। ইমরান খান তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করে কাশ্মীর প্রশ্নে ওআইসিকে সক্রিয় করে তুলতে সক্ষম হন। কিন্তু শাসক হিসেবে মাত্র তিন বছর সুযোগ দেওয়া হয়েছে তাঁকে। সোহরাওয়ার্দীকে দেওয়া হয় মাত্র ১৩ মাস। ভুট্টোকে দেওয়া হয় পাঁচ বছরের সামান্য বেশি। ১৯৭০-এর ভোটের ফলাফল মেনে না নিতে ভুট্টোকে উসকানি দিয়েছিলেন জেনারেলরাই। তাঁকে ফাঁসিও দিয়েছেন তাঁরাই। ইমরানের উত্থানে সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়ার সহায়তা ছিল। ইমরানকে জেলে ঢোকাতে নির্দয় ভূমিকায় দেখা গেল একই পদে থাকা নতুন জেনারেল আসিম মুনিরকে। তাঁরাই চিরস্থায়ী এক রাজনৈতিক বধ্যভূমিতে রাজনীতিবিদদের আনা-নেওয়া করেন। 

পাকিস্তানের সর্বশেষ জাতীয় পরিষদের মেয়াদের শেষ দিন সেখানে ভাষণ দিতে গিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিলাওয়াল ভুট্টো দেশের রাজনীতিকে ‘মাইন ফিল্ডে’ পরিণত করার জন্য জেনারেলদের নয়, পুরোনো রাজনীতিবিদদের দোষারোপ করেছেন। তাঁর এই বক্তব্য পুরো সত্য নয়, অর্ধসত্য। বিলাওয়ালের পক্ষে পুরো সত্য বলা সামনে আরও দুরূহ হবে। কারণ, দেশটির ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর নাম আসছে।

বিলাওয়াল যেদিন রাজনৈতিক অঙ্গনকে মাইনফিল্ডের সঙ্গে তুলনা করেন, সেদিনই দেশটির সবচেয়ে মর্যাদাসম্পন্ন দৈনিক ডন জাতীয় পরিষদের পাঁচ বছরের ভূমিকার একটা মূল্যায়ন ছেপেছে। শিরোনাম ছিল ‘দ্য পার্লামেন্ট দ্যাট মার্ডারড ডেমোক্রেসি’ (এই পরিষদেই দেশের গণতন্ত্র খুন হলো)। ডন-এর ভাষায়, ‘পাকিস্তানের গণতন্ত্র আগে হাসপাতালের বিছানায় ছিল। সে অবস্থাতেই এবার নিহত হলো।’ বলা বাহুল্য, এই দফায় প্রধান ‘শহীদ’ ইমরান খান। 

পাকিস্তান ইমরানকে ধারাবাহিকভাবে বহুগামী ক্রীড়াবিদ, সফল ক্রিকেট অধিনায়ক, সমাজকর্মী, ইসলামি সমাজ কায়েমের সংগঠক এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখেছে। ইমরানের এসব পরিচয়ের তালিকায় ‘রাজনৈতিক শহীদ’ কথাটি এখনই যুক্ত করতে রাজি নন পিটিআইয়ের কর্মীরা। তাঁদের এখন অপেক্ষার পালা। ডিপস্টেটের ভাষ্য হলো, দেশে স্থিতিশীলতার স্বার্থে এভাবে মাঝেমধ্যে তাদের ধাত্রীর ভূমিকা নিতে হয়! 

ইমরানকে জেলে পুরে পাকিস্তানে যে কিছুদিনের জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এল, সেটা সত্য। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের জন্যও এটা স্বস্তিকর। কাশ্মীর প্রশ্নে পিপিপি ও মুসলিম লিগের চিরায়ত নমনীয় ভূমিকার কারণে এই পাকিস্তানকে নিয়ে ভারতও কিছুটা উদ্বেগমুক্ত। সবার বিজয়সূচক এই অবস্থা তৈরি হলো একটা ছদ্ম-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। মুসলিম লিগ ও পিপলস পার্টি আপাতত এই অভ্যুত্থানে একসঙ্গে মদদ দিলেও সামরিক আমলাতন্ত্র তাদের মধ্যেও বিভেদ বাধাবে। মুসলিম লিগের নওয়াজ শরিফ সহজে লন্ডন থেকে ফিরতে পারবেন না, যেমনটি তিনি আশা করেছিলেন। তবে তাঁর দল ডিপস্টেটের সঙ্গে সমঝোতা করার চেষ্টা করছে। ইতিমধ্যে রাজনীতি থেকে চিরস্থায়ীভাবে নির্বাসিত হয়ে আছেন তিনিও। 

যেহেতু পার্লামেন্টের মেয়াদ শেষ, সে কারণে পাকিস্তান এখন শাসিত হবে ‘কেয়ারটেকার সরকার’ দিয়ে। আইন অনুযায়ী, এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাজ তিন মাসের ভেতর নির্বাচন করা। ইতিমধ্যে গতকাল এই সরকারের প্রধান নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এবার শিগগির নির্বাচন হবে না বলে শোনা যাচ্ছে। কারণ হিসেবে নির্বাচনী আসন পুনর্বিন্যাসের কথা বলা হচ্ছে। তার মানে, অনির্বাচিত এ সরকারের অধীনে পাকিস্তানকে অনিশ্চয়তায় ভরা অনেকটা সময়—অন্তত ছয়টি মাস কাটাতে হবে। এ সময়ে দেশ আমলাদের হাতে শাসিত হবে। প্রকৃত চালকের আসনে থাকবেন গোয়েন্দা সংস্থা এবং সামরিক নেতাবৃন্দ। এর মধ্যে আরও কিছু রাজনৈতিক ভাঙাগড়া শেষে জেনারেলরা যখন নিশ্চিত হবেন ভোট হলে তাঁদের জন্য নিরাপদ একটা সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে, তখন পাকিস্তান আরেকটি নির্বাচন আশা করতে পারে। 

ইমরানমুক্ত দৃশ্যপটে তখন যিনি সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক অংশীদার হবেন, তাঁর জন্যও ‘বধ্যভূমি’ অপেক্ষায় থাকবে। দৃশ্যমান ‘রাষ্ট্র’-এর ভেতর থাকা অদৃশ্য ‘রাষ্ট্র’ বেশি শক্তিশালী হলে এ রকম সমস্যা হয়। বিদেশিরাও অনেক সময় সে-ই ‘সমস্যা’য় ইন্ধন দেয়। অন্তত পাকিস্তানে বহুবার দিয়েছে! 

আলতাফ পারভেজ ইতিহাস বিষয়ে গবেষক