পারমাণবিক অস্ত্রধারী পাকিস্তানকে ‘বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশগুলোর একটি’ বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। বাইডেনের এমন মন্তব্যে হতবাক পাকিস্তান সরকার। একসময় পাকিস্তান ছিল এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম মিত্র। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সেই সম্পর্কে টানাপোড়েন দেখা দেয়। এমন পরিস্থিতিতে ওয়াশিংটনের সঙ্গে সম্পর্ক মেরামতের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল ইসলামাবাদ।
বাইডেনের মন্তব্যের পর পাকিস্তান সরকার ও দেশটির রাজনৈতিক নেতারা প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। ওই প্রতিক্রিয়া শুনে মনে হয়েছে, বাইডেন তাঁর মন্তব্যে আসলে যা বোঝাতে চেয়েছেন, তা ধরতে পারেননি পাকিস্তানের নেতারা। তাঁরা বরং মনে করেছেন, পাকিস্তানের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে। এ অস্ত্রের সুরক্ষার বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে যে উদ্বেগ চলে আসছে, তার জেরেই মার্কিন প্রেসিডেন্টের ওই মন্তব্য।
এর কারণও অবশ্য আছে। সেটি হলো, পাকিস্তানকে বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশগুলোর একটি বলার কোনো কারণ ব্যাখ্যা করেননি বাইডেন। ফলে এটাই মনে হচ্ছে যে বাইডেনের মন্তব্যের অর্থ বের করতে একপ্রকার বেগ পেতে হচ্ছে পাকিস্তানের সরকার ও নেতাদের। সেখান থেকেই এ ভুল–বোঝাবুঝির সূত্রপাত।
বাইডেন ওই মন্তব্য করেছিলেন গত বৃহস্পতিবার। তিনি বলেছিলেন, ‘আমার মনে হয় পাকিস্তান হয়তো বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশগুলোর মধ্যে একটি। কারণ, দেশটির হাতে থাকা পারমাণবিক অস্ত্রের কোনো সমন্বয় নেই।’ তিনি এ মন্তব্য করেছিলেন আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র যেসব বৈশ্বিক হুমকির মুখে পড়ছে, তা নিয়ে কথা বলার সময়। পাকিস্তানের নাম নিয়েছেন বলে যে তিনি শুধু একটি দেশকেই হুমকি হিসেবে দেখছেন, বিষয়টি এমন নয়।
পারমাণবিক অস্ত্রের সুরক্ষা বলতে শুধু এই অস্ত্র নিরাপদে রাখা এবং শত্রুপক্ষের হাত থেকে রক্ষা করতে একটি দেশের সক্ষমতা—এমনটা মনে করে না ওয়াশিংটন। তাদের মূল উদ্বেগ হলো, এই অস্ত্র চরমপন্থীদের হাতে চলে যেতে পারে।
এ নিয়ে কথা বলেছেন ইসলামাবাদের এয়ার ইউনিভার্সিটির অ্যারোস্পেস অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ অনুষদের ডিন আদিল সুলতান। একসময় তিনি পাকিস্তান স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যানস ডিভিশনের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। পাকিস্তানের হাতে থাকা পারমাণবিক অস্ত্রের নিরাপত্তার বিষয়টি দেখভালের দায়িত্বে রয়েছে এ সংস্থা। আদিল সুলতান বলেন, ‘বাইডেন খুব সম্ভবত পারমাণবিক অস্ত্রধারী একটি দেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্র কতটা সুরক্ষিত, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেননি।’
পাকিস্তান নিয়ে বাইডেনের মন্তব্য ও এর প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে আদিল সুলতান বলেন, ‘বাইডেনের মন্তব্যের ভুল অর্থ বের করে গণমাধ্যম ও প্রায় সব রাজনৈতিক দল প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে। এ নিয়ে বিতর্কের জেরে আমরা হয়তো এমন একটি বিষয় (পারমাণবিক অস্ত্রসংক্রান্ত হুমকি) সামনে আনছি, যা নিয়ে আগে কখনো আলোচনা হয়নি।’
কিছুদিন ধরে বাইডেনের অগ্রাধিকার দেশগুলোর তালিকায় নেই পাকিস্তান। তারপরও কোনো কারণ ছাড়া নিশ্চয়ই তিনি ওই মন্তব্য করেননি। পাকিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতি হয়তো সম্প্রতি তাঁর সামনে তুলে ধরা হয়েছে। হতে পারে এর জেরেই বৃহস্পতিবার পাকিস্তান নিয়ে মুখ খুলেছেন তিনি।
অনেকে হয়তো ভাবতে পারেন, পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্রের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার বিষয়টি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এখন আর কোনো মাথাব্যথা নেই। তবে এমন ধারণা করা ভুল হবে। গত মাসেই যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী প্রতিরক্ষামন্ত্রী এলি র্যাটনার এ নিয়ে কথা বলেছেন। তাঁর ভাষ্য, পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষাবিষয়ক অংশীদারত্বের যে সম্পর্ক, সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের মূলে রয়েছে সন্ত্রাস দমন ও পারমাণবিক অস্ত্রের সুরক্ষা।
পারমাণবিক অস্ত্রের সুরক্ষা বলতে শুধু এ অস্ত্র নিরাপদে রাখা এবং শত্রুপক্ষের হাত থেকে রক্ষা করতে একটি দেশের সক্ষমতা—এমনটা মনে করে না ওয়াশিংটন। তাদের মূল উদ্বেগ হলো, এ অস্ত্র চরমপন্থীদের হাতে চলে যেতে পারে। বিষয়টি নিয়ে ডনের সঙ্গে কথা বলেছেন ওয়াশিংটনভিত্তিক সংস্থা কার্নেগি নিউক্লিয়ার পলিসি প্রোগ্রামের উপপরিচালক টোবি ডালটন।
পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্রের সুরক্ষাব্যবস্থা হয়তো ভালো। এরপরও দেশ হিসেবে পাকিস্তান অনিরাপদ। কারণ, গত দশকে সশস্ত্র গোষ্ঠী তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে দেশটিতে যে শঙ্কা দেখা দিয়েছিল, তা আবার ফিরে এসেছে। আমার মনে হয়, এ কারণেই বাইডেন ওই মন্তব্য করেছেন।টোবি ডালটন, উপপরিচালক, কার্নেগি নিউক্লিয়ার পলিসি প্রোগ্রাম
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম টুইটারে ওই আলাপচারিতায় টোবি ডালটন বলেন, ‘পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্রের সুরক্ষাব্যবস্থা হয়তো ভালো। এরপরও দেশ হিসেবে পাকিস্তান অনিরাপদ। কারণ, গত দশকে সশস্ত্র গোষ্ঠী তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে দেশটিতে যে শঙ্কা দেখা দিয়েছিল, তা আবার ফিরে এসেছে। আমার মনে হয়, এ কারণেই বাইডেন ওই মন্তব্য করেছেন।’
পাকিস্তান এখন রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক সংকট ও জঙ্গিবাদের মতো বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত। ফলে দেশটির স্থিতিশীলতা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। বিগত মাসগুলোয় রাজনৈতিক মেরুকরণ চরমে পৌঁছেছে, আরও গভীর হয়েছে অর্থনৈতিক সংকট। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে নতুন করে ঋণ নিয়েছে পাকিস্তান, তারপরও দেশটির মানুষের আর্থিক দুর্দশা বেড়েই চলেছে। এমন এক পরিস্থিতিতে শুধু যুক্তরাষ্ট্র কেন, বিশ্বের যেকোনো দেশ পাকিস্তানের দিকে তাকালে শুধু সমস্যাই দেখতে পাবে।
পাকিস্তান নিয়ে বিদেশিদের এ মূল্যায়ন আরও জটিল করে তুলেছে টিটিপির পুনরুত্থান ও নতুন করে সন্ত্রাসবাদ বেড়ে যাওয়া। আর এটা হয়েছে আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতায় আসার পর থেকে। সোয়াত উপত্যকাসহ খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের নানা অংশে নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতি নিয়ে পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা কমিটি বৈঠক করেছে। এ বৈঠক ডাকার অর্থ এটাই মনে হচ্ছে, পাকিস্তান যে সংকটের চরম পর্যায়ে রয়েছে, তা স্বীকার করে নিয়েছে সরকার।
পাকিস্তানে স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র হঠাৎ করে আগ্রহ দেখাচ্ছে, বিষয়টি এমন নয়। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আমলেও বিষয়গুলো দেশটির পররাষ্ট্রনীতির অগ্রাধিকার তালিকার শীর্ষে ছিল। সেগুলোই আবার আলোচনার টেবিলে উঠে এসেছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, বাইডেনের মন্তব্যে গণমাধ্যমসহ পশ্চিমা দেশগুলোতেও পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্রের সুরক্ষা নিয়ে নতুন করে সন্দেহের জন্ম দেবে।