পাকিস্তানের চলতি সপ্তাহে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে জাতীয় পরিষদ নির্বাচন। আইনি কারণে এই নির্বাচনে অংশ নিতে পারছেন না দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। এর জেরেই এবারের নির্বাচন পুরোপুরি সুষ্ঠু হচ্ছে না বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকেরা। তবে ভোটে অংশ না নিলেও পাকিস্তানে জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে এগিয়ে আছেন তিনি।
তারকা ক্রিকেটার থেকে পুরোদস্তুর রাজনীতিক বনে যাওয়া ইমরানকে এক সপ্তাহের মধ্যে তিন মামলায় দীর্ঘমেয়াদে কারাদণ্ডের সাজা দেওয়া হয়েছে। পাকিস্তানের রাজনীতি থেকে ১০ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে তাঁকে। এর জেরেই চলতি নির্বাচনে লড়তে পারছেন না তিনি।
পাকিস্তানের জনগণের ব্যাপক সমর্থন নিয়ে ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী হন ইমরান। দেশটির যে প্রভাবশালী সেনাবাহিনীর সমর্থনে তিনি ক্ষমতায় এসেছিলেন, সেই সেনাবাহিনীই তাঁর পতনের কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। ২০২২ সালের এপ্রিলে পার্লামেন্টে এক অনাস্থা ভোটে ক্ষমতাচ্যূত হন ইমরান খান ও তাঁর দল পাকিস্তান তেহরিক–ই–ইনসাফ (পিটিআই) নেতৃত্বাধীন জোট সরকার।
সরকার পতনের পর ঝুঁকিপূর্ণ এক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন ইমরান খান। সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে নজিরবিহীন প্রচারণা শুরু করেন তিনি। ইমরানকে প্রথমবার গ্রেপ্তারের পর গত মে মাসে তাঁর সমর্থকেরা সেনাবাহিনীর এক কমান্ডারের প্রধান কার্যালয়ে হামলা চালান। পরে তাঁকে আবারও গ্রেপ্তার করা হয়। বর্তমানে তাঁর বিরুদ্ধে প্রায় দুই শ মামলা রয়েছে। ইমরানের দাবি, তাঁকে রাজনীতির ময়দান থেকে সরাতেই এসব মামলা করা হয়েছে।
ইমরান খানকে রাষ্ট্রদ্রোহিতা, দুর্নীতি ও শরিয়াহ আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে তিন দফায় কারাদণ্ডের সাজা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে দুটি অভিযোগে সাজা পেয়েছেন তাঁর তৃতীয় স্ত্রী বুশরা বিবিও। তোশাখানা দুর্নীতি মামলার পাশাপাশি শরিয়াহ আইন অনুযায়ী বিবাহবিচ্ছেদের পর তিন মাস অপেক্ষা না করেই ইমরানকে বিয়ে করার অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।
ইমরান খান ছিলেন পাকিস্তানের জাতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক। কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে নিজের ক্রিকেট দলকে জিতিয়ে আনার ইতিহাস রয়েছে তাঁর। ১৯৯২ সালে তাঁর নেতৃত্বে পাকিস্তানের হাতে উঠেছিল বিশ্বকাপ। ইমরানের খেলা দেখে বড় হয়েছেন এমন লাখো পাকিস্তানি তাঁকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় এনেছিলেন।
বর্তমানে ৭১ বছর বয়সী সেই ইমরান এখন কারাগারে। নির্বাচন ঘিরে দমন–পীড়নে তাঁর দল পিটিআইও বিপর্যস্ত। তবে পাকিস্তানের অতীত রেকর্ড বলছে, দেশটিতে অনেক রাজনীতিবিদ দীর্ঘ মেয়াদে সাজার রায় পাওয়ার পরও নিজেদের পক্ষের শক্তি ক্ষমতায় আসার পর দায়মুক্তি পেয়েছেন।
পাকিস্তানের মানুষের মধ্যে ইমরান এখনো তুমুল জনপ্রিয়। তবে তাঁর নেতৃত্ব ছাড়া পিটিআইয়ের ভবিষ্যৎ এখন অনেকটাই অনিশ্চিত। আগামী বৃহস্পতিবারের নির্বাচনে নিজেদের ‘ক্রিকেট ব্যাট’ প্রতীক না পাওয়ায় পিটিআইয়ের প্রার্থীদের স্বতন্ত্রভাবে লড়তে হচ্ছে। এ নির্বাচনে তাঁরা কী ফল করেন, তা থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যেতে পারে—আর কতটা সময় ইমরানকে কারাগারে থাকতে হবে।
সপ্তম শতক থেকে চতুর্দশ শতক পর্যন্ত ইসলামের স্বর্ণযুগ ছিল। এ সময় মুসলিম বিশ্ব সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও বৈজ্ঞানিকভাবে ব্যাপক অগ্রগতি পেয়েছিল। ইসলামের এই স্বর্ণযুগের আদলে পাকিস্তানকে নতুন করে গড়ে তুলতে দেশের মানুষকে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন ইমরান।
তবে সংকটময় পাকিস্তানের অর্থনীতিকে টেনে তুলতে তেমন কিছুই করে দেখাতে পারেননি ইমরান। সে সময় উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বিপুল বৈদেশিক ঋণ ও রুপির দুর্বল মানের কারণে চরম দুর্দশায় ছিলেন পাকিস্তানিরা। এই সুযোগ কাজে লাগিয়েই পার্লামেন্টে ইমরানের বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোটের আহ্বান জানিয়েছিল পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) ও পাকিস্তান মুসলিম লিগ–নওয়াজ (পিএমএল–এন)।
পাকিস্তানের রাজনীতিতে ব্যাপক আধিপত্য থাকা এই পিপিপি ও পিএমএল–এনকে হটিয়েই ২০১৮ সালে ক্ষমতায় এসেছিলেন ইমরান। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরও দল দুটির অনেক নেতার ওপর চড়াও হয়েছিলেন তিনি। তাঁদের অনেক নেতাকে দুর্নীতির অভিযোগে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। তবে ইমরানের পতনের পর পিএমএল-এন নেতা নওয়াজ শরিফসহ অনেকে মুক্তি পেয়েছেন।
ইমরান খান ক্ষমতায় থাকাকালে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপরও হস্তক্ষেপ করেছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের। তবে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর সবচেয়ে বড় ভুল ছিল পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়ানো। বলা হয়ে থাকে, পাকিস্তানে কোনো দলের ক্ষমতায় আসা কিংবা সরকার থেকে পতন নির্ধারণ করে থাকে এই সামরিক বাহিনী।
ইমরান খান বেড়ে উঠেছেন পাকিস্তানের লাহোরে অভিজাত পরিবারে। পড়াশোনা করেছেন যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। ক্রিকেট তাঁরকা ছাড়াও একজন প্রেমিক হিসেবে খ্যাতি ছিল তাঁর। বিভিন্ন দাতব্য কর্মকাণ্ডেও যুক্ত ছিলেন। এর অংশ হিসেবে মায়ের নামে গড়ে তুলেছিলেন ক্যানসার হাসপাতালও।
১৯৯৬ সালে পিটিআই গড়ে তোলেন ইমরান। অনেক বছর ধরে পার্লামেন্টে পিটিআই থেকে একমাত্র সদস্য ছিলেন তিনি। জেনারেল পারভেজ মোশাররফের সামরিক সরকারের সময় আস্তে আস্তে বেড়ে ওঠে তাঁর দল। এরপর বেসামরিক সরকারের সময়ও পিটিআইয়ের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে।
২০১৩ সালের নির্বাচনে রাজনীতিতে বড় শক্তিতে পরিণত হয় পিটিআই। এর মাত্র পাঁচ বছর পরই ক্ষমতায় আসে দলটি। রাজনীতির মাঠে নিজের লড়াই বর্ণনা করতে গিয়ে প্রায়ই ক্রিকেট থেকে উপমা দিতেন ইমরান। একবার টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি শেষ বল পর্যন্ত লড়াই করে যাব।’